নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
একজন ভিসির ফর্মুলা এবং একজন ক্রিকেটারের নাজুক মন্তব্য কতোটা প্রাসঙ্গিক?
রেজানুর রহমান
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার
লেখার শুরুতে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা তুলেছিলাম। আবারো সেই প্রসঙ্গই তুলতে চাই। জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার ও একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্যের সাম্প্রতিক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ প্রসঙ্গটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দু’জনই তরুণ প্রজন্মের আইডল। হতে চাই তার মতো? কার মতো? তানজিমের মতো। ধরা যাক তানজিম বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশকে অনেক সম্মানিত করলো, কিন্তু তার বিশ্বাসের এতটুকু পরিবর্তন হলো না। তাহলে বাংলাদেশ কী আদৌ লাভবান হবে? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অভিভাবক যদি তালেবানি কালচারকে সমর্থন করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে চান সেটা কি সমর্থনযোগ্য? এর জবাব কী?
রুচির দুর্ভিক্ষের কথা তুলেছিলেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। এই নিয়ে কতো যে কথা হলো। কথা এখনো চলছে। সব কথাই ভালো কথা নয়। মামুনুর রশীদের পক্ষে যারা কথা বলেছেন তারা সংখ্যায় অনেক। কিন্তু তারা সংগঠিত নন। বিপক্ষে যারা কথা বলেছেন, এখনো বলেই যাচ্ছেন তারা সংখ্যায় অল্প কিন্তু বেশ সংগঠিত। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তির উপস্থিতি, প্রভাব তেমন একটা চোখে পড়ছে না। বরং সংখ্যা লঘিষ্ঠদের দৌড়-ঝাঁপটাই যেন একটু বেশি। সম্প্রতি এক আড্ডায় প্রসঙ্গ তুললেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। বললেন, কষ্ট হচ্ছে কথাটা বলতে। কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছি। তবুও বলি। আমরা যারা নিজেদেরকে সুশীল সমাজের লোক বলি তারা মোটেই সংগঠিত নই। এটা বড়ই বিব্রতকর। অসম্মানজনক।
কবি, লেখকদের মধ্যে বিভাজন। আদর্শগত দ্বন্দ্ব তো আছেই। কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত... আবার দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও অমিল। ক’ খ’কে পছন্দ করে না। গ’-এর অহংকারটা একটু বেশি। অভিনয়ের ক্ষেত্রেও সিনিয়র- জুনিয়রের দ্বন্দ্ব প্রকট। আমাদের শোবিজে ‘সাইজ করা’ বলে একটা শব্দ আছে। জুনিয়র কেউ সহজেই সিনিয়রদের কাছে পাত্তা পায় না। জনপ্রিয় শিল্পীর সঙ্গে জুনিয়র শিল্পী অভিনয় করার সময় অনেক ক্ষেত্রে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। জুনিয়র শিল্পী ভালো করছে বুঝতে পারলে জনপ্রিয় শিল্পীদের কেউ কেউ ‘সাইজ’ করার অদৃশ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ক্রীড়া ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বিশেষ করে ক্রিকেটে ‘সাইজ করা’ ষড়যন্ত্র অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। ফলে কার্যত কেউ কাউকে মানে না। যার যা খুশি তাই বলে।
তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ জাতীয় দলের তরুণ ক্রিকেটার তানজিম হাসান সাকিব। এশিয়া কাপে তার দুর্দান্ত পারফরমেন্সের কারণে বাংলাদেশের কাছে ভারত হেরে যায়। ফলে তানজিমকে নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয় ক্রিকেট বিশ্বে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। তানজিমের এই সাফল্যের সুন্দর সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া তারই একটি স্ট্যাটাস তাকে মুহূর্তের মধ্যে চরম বিতর্কিত করে তোলে। তানজিম লিখেছেন, স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না। স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না। স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়। স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়। স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়। স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়।
গণতান্ত্রিক সমাজে কথা বলার অধিকার সবারই থাকা উচিত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তানজিমের ফেসবুক মন্তব্যের বিরোধিতা করা উচিত নয়। কিন্তু তিনি যখন দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন তখন তার এই মন্তব্য আলোচনার দাবি রাখে।
তানজিমের প্রসঙ্গ নিয়ে যখন আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে তখন বিদ্রোহের আগুনে ঘি ঢেলেছেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি তালেবানি কালচারকে সমর্থন করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন, এখানে (শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়) ওপেন কালচার ছিল। ছেলেমেয়েরা যা খুশি তাই করতো। কেউ কিছু বলতে পারতো না। কারণ তাদের বয়স ১৮ বছর। কিন্তু আমি বলেছি রাত ১০টার মধ্যে হলে ঢুকতে হবে। তারা এর নাম দিয়েছে তালেবানি কালচার। তালেবানি কালচার নিয়ে আমি খুব গৌরবান্বিত। এটা নিয়েই থাকতে চাই। ওপেন কালচার চাই না।

ভিসি মহোদয়ের কথার শেষ লাইনটির প্রতি গুরুত্ব দিতে চাই। তিনি বলেছেন ওপেন কালচার চাই না। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ওপেন কালচারকে সমর্থন করে না। কিন্তু তালেবানি কালচারকেও সমর্থন করে না বাংলাদেশ। অনেকে হয়তো বলবেন ভিসি মহোদয় কথার কথা বলেছেন। কিন্তু এটা কথার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য যখন প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করবেন তখন সেটা কথার কথা থাকে না। তার কথা বেদ বাক্যে পরিণত হয়। ওপেন কালচার আর তালেবানি কালচার এক জিনিস নয়। তালেবানি কালচারে নারী শিক্ষা অনেকটাই নিষিদ্ধ। তার মানে উপাচার্য মহোদয় কি নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে? ক্রিকেটার তানজিমের কথার সঙ্গে তার কথার কোথায় যেন মিল খুঁজে পাচ্ছি। দু’জনই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ফরিদ উদ্দিন আহমেদ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক। তার কথার অনেক মূল্য আছে। তানজিম বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য। শুধু তার মুখের কথা নয় তার আচার আচরণ ব্যক্তিগত বিশ্বাসও দেশের অসংখ্য তরুণকে প্রভাবিত করে, করবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি যদি তালেবানি কালচারকে পছন্দ করেন, জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন তরুণ খেলোয়াড় যদি নারীকে ঘরের মধ্যেই বন্দি রাখতে চান তাহলে কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য?
লেখার শুরুতে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা তুলেছিলাম। আবারো সেই প্রসঙ্গই তুলতে চাই। জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার ও একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্যের সাম্প্রতিক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ প্রসঙ্গটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দু’জনই তরুণ প্রজন্মের আইডল। হতে চাই তার মতো? কার মতো? তানজিমের মতো। ধরা যাক তানজিম বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশকে অনেক সম্মানিত করলো, কিন্তু তার বিশ্বাসের এতটুকু পরিবর্তন হলো না। তাহলে বাংলাদেশ কী আদৌ লাভবান হবে? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অভিভাবক যদি তালেবানি কালচারকে সমর্থন করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে চান সেটা কি সমর্থনযোগ্য? এর জবাব কী? প্রিয় পাঠক আওয়াজ তুলুন...
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো