ঢাকা, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

খোলা কলম

শিঙ্গাড়া, সেলফি ও এয়ারবাস সমাচার

এহ্সান মাহমুদ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবারmzamin

এইবার শেষ করি সেলফি প্রসঙ্গ দিয়ে। সদ্য সমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, “এটি একটি আনন্দের মুহূর্ত, সবাই আনন্দিত। সেলফি তোলার সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বেশ উচ্ছ্বসিত দেখা গেছে।” অপরদিকে বিরোধীরা দাবি করছেন যে ‘সেলফি দিয়ে বিভ্রান্তির চেষ্টা হচ্ছে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো নড়চড় হবে না।’ এই সেলফি দেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় -‘বিএনপি নেতাদের মুখ শুকিয়ে যাওয়ার’ বিপরীতে বিএনপি মহাসচিবের পরামর্শ ‘ছবি প্রিন্ট করে গলায় ঝুলিয়ে রাখুন’ সবই আমরা শুনলাম

 

রাজধানী ঢাকার একেবারেই কোলঘেঁষে বয়ে চলা ছোট্ট তুরাগ। দূষণ ও দখলের খবরের বাইরে বিগত কয়েক বছর ধরে এর নাম আরও শোনা গেছে বালুমহালের অবৈধ ইজারাদার এবং লাশ উদ্ধারের ঘটনায়। তবে এবার তুরাগের নাম উচ্চারিত হলো বেশ সমীহের সঙ্গে। তুরাগের নামের সঙ্গে উচ্চারিত হলো ফরাসি প্রেসিডেন্টের নাম। সেই ঘটনা-ই বলছি। তারও আগে তুরাগ তীরের এক শিঙ্গাড়া দোকানির প্রসঙ্গ। তুরাগের কথা বলতে গিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এবং শিঙ্গাড়া দোকানির আলোচনা অনেকটা ‘ধান ভানতে শীবের গীতের’ মতো মনে হতে পারে। 

বেসরকারি টেলিভিশন বাংলাভিশনের একটি সংবাদের ভিডিওক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

বিজ্ঞাপন
সেখানে তুরাগ তীরের এক শিঙ্গাড়া দোকানিকে বলতে শোনা যায়, “উনি একটি শিঙ্গাড়া নিয়ে খেলেন। তারপরে আমাকে ধন্যবাদ দিলেন এবং তার গাড়িতে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় তার সঙ্গে যারা ছিলেন, তাদের দিকে তাকিয়ে আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওয়ান বিলিয়ন। এই কথাটি তিনি বললেন। মানে, আমাকে এক বিলিয়ন দেওয়ার কথা বললেন। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরে তার সঙ্গের লোকজনও চলে গেল। আমাকে কিছু দিল না। কিছু পেলাম না।” 

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এই বক্তব্য ঘিরে নানা হাস্যরস ও টিপ্পনি দেখা গেল। শিঙ্গাড়া দোকানির মুখে এক বিলিয়ন অর্থের কথা শুনে অনেকে তাকে লোভী বলছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, মুরুব্বি যদি ইংরেজিটা বুঝতে পারতেন ভালোভাবে, তাহলে আসল বিষয় জানতে পারতেন- ফরাসি প্রেসিডেন্ট আসলে কী বলেছিলেন। একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন- শিঙ্গাড়ার দোকানদার চাচা এক বিলিয়ন অর্থ না পেলেও তার ভিডিও একদিনেই এক মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে! 

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনিও চলে গেছেন। ফরাসিরা শিল্প রসিক জাতি। দুনিয়াজোড়া তাদের খ্যাতি। তার প্রমাণ এই বাংলা মুলুকের লোকেরাও এবার খানিকটা পেল। বাংলাদেশে এসে এখানকার এক বাংলা গানের শিল্পীর বাসায় গেলেন তিনি, গান গাইলেন, গান শুনলেন। নৈশভোজে ফরাসি কবির কবিতা পাঠ করলেন। আবার তুরাগ নদীতে ঘুরতে গেলেন নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থেকে।  বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে একজন শিল্পী এবং শিল্প-রসিক হিসেবে হাজির করতে কোনো কমতি রাখলেন না। ফরাসি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ থেকে উড়োজাহাজে চড়ে রওনা দেয়ার পরেই জানা গেল- বাংলাদেশ ফ্রান্স থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করেছে। আবার একটি স্যাটেলাইটও কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 
আমরা স্মরণ করতে পারি যে, এর আগে গত ৩রা মে বিমানের পরিচালনা পর্ষদ এয়ারবাসের ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল। 

বাংলাদেশ সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন গত ১১ই সেপ্টেম্বর বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘এয়ারবাস কোম্পানির তৈরি ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। ইউরোপীয় উড়োজাহাজ শিল্পে আস্থা রাখার জন্য আমি আপনাকে (বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) ধন্যবাদ জানাই।’ ফরাসি প্রেসিডেন্ট তার বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 
কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন অন্য দেশের প্রেসিডেন্টকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেন, সেটিকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তবে আমাদের দেশে যে এয়ারবাস কেনার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো, সেটি বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এখানে ড. এম এ মোমেন, যিনি বাংলাদেশ বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন; তার একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই। বেশকিছু দিন আগে তার একটি লেখা পড়েছিলাম। বাংলাদেশ বিমান কেন লাভজনক খাতে যেতে পারছে না- এর পেছনে কারণ কী, বিমানের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে চলে আসা অনিয়মের খবর কোনোদিনই কি বন্ধ হবে না- এইসব ভাবতে ভাবতে লেখাটি শেষপর্যন্ত পড়েছিলাম। বাংলাদেশ বিমান এবং বিমানবন্দর নিয়ে মজার মজার কৌতুক প্রচলিত আছে। বিমান এবং বিমানবন্দরকে নানা নামে ডাকা হয়।

 তারমধ্যে একটি হচ্ছে- বিমানবন্দরকে বলা হয় ‘সোনার খনি’। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে স্বর্ণের খনি না থাকলেও ঢাকা বিমানবন্দরে যে পরিমাণ স্বর্ণ আটক বা উদ্ধার করা হয়, তা সোনার খনির সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে পিছিয়ে থাকলেও সংবাদ প্রকাশের বা আলোচনায় থাকার জন্য যথেষ্ট। জনাব এম এ মোমেনের লেখার দিকে আপাতত তাকাই- “এয়ারবাস কোম্পানির বড় ১০ ক্রেতার মধ্যে রয়েছে ইন্ডিগো, এয়ার এশিয়া, ইজিজেট, চায়না ইস্টার্ন, উইজ এয়ার, ডেল্টা এয়ারলাইনস, চায়না সাউদার্ন এয়ার লাইনস, জেট ব্লু এয়ারওয়েজ ও ফ্রন্টিয়ার এয়ার লাইনস। বোয়িং কোম্পানির বড় ১০ ক্রেতার মধ্যে রয়েছে সাউথ ওয়েস্ট, লায়ন এয়ার, রায়ান এয়ার, এমিরেটস, এয়ারলিজ গ্রুপ, ইউনাইটেড এয়ারলাইনস, নরওয়েজিয়ান এয়ারলাইনস, জিক্যাশ ও কাতার এয়ারওয়েজ। ... হালে বোয়িংয়ের নির্মাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা নীতির জুজুর কথা বলে দল-মত নির্বিশেষে আমাদের যথেষ্ট বিরক্তি উৎপাদন করেছে। বিশেষকরে, অর্থ পাচারকারীরা তহবিল নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারেন। ... যুক্তরাষ্ট্রকে শিক্ষা (!) দেয়ার জন্য যদি আমরা পছন্দে কৌশলগত পরিবর্তন আনি, সেটাই বা মন্দ কী? তবে লক্ষ্য স্থির থাকতে হবে যে জাতীয় ও ভূরাজনৈতিক গন্তব্য যা-ই হোক, তা যেন বাংলাদেশ বিমানের স্বার্থের দীর্ঘ মেয়াদি প্রতিকূলে না যায়। .... বোয়িং না এয়ারবাস এ প্রশ্নের আগে আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করতে হবে- বিমান যে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এটা আমরা বিশ্বাস করি তো?” 

বিমানের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের লেখা পড়ে কেবল দুটি প্রশ্ন করতে চাই- ফ্রান্সের কাছে বিমান এবং স্যাটেলাইট ক্রয়ের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া কি কেবলই বিমানের জন্য? এর জন্য আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক কোনো প্রতিশ্রুতি নেই? 
আবার যারা শার্লক হোমস পড়েছেন, তারা এই কেনাকাটার মধ্যে অন্য গন্ধও পেতে পারেন। সেই গন্ধ পাওয়াটা কিছুটা সহজ করেছেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করতে পারি- ‘ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এসে গেলেন। আমাদের বড় মেহমান, খুব ভালো কথা। কিন্তু কী হলো? দেশের মানুষের করুণ অবস্থার মধ্যে বলা হলো ১০টি এয়ারবাস কেনা হবে। আসল লক্ষ্য এই এয়ারবাসে ফিটব্যাক পাওয়া যায়। ফিটব্যাক মানে হচ্ছে কমিশন। বোয়িংয়ে কমিশন পাওয়া যায় না। যে কারণে ১০টা এয়ারবাস কেনা হচ্ছে। দেশের মানুষের অসুখ নিরাময় করতে পারে না, হাসপাতাল তৈরি, স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারে না, তাদের (মানুষ) ভোটের অধিকার দিতে পারে না, সেখানে শুধু কমিশন খোঁজে। যে বিমান (বাংলাদেশ বিমান) ভেঙে পড়ছে, সার্ভিস ঠিকমতো দিতে পারে না,  তাদের জন্যই ১০টি এয়ারবাস কিনে দেবে সরকার। কারণ তাতে চুরি করার সুবিধা হবে এবং তারা ইমিডিয়েটলি বোধ হয় কমিশনও কেটে নিয়েছে।’ এই কথাটি যখন আমরা পড়বো বা শুনবো তখন মনে রাখতে হবে- বিএনপি’র এই নেতা এক সময়ে সরকারে থাকার সময়ে বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। বিরোধী নেতা সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা তাতে সব বিষয়ে সরকারের বিরোধিতা করার যে চর্চা দেখে আসছি, সেখানে জনাব মির্জা ফখরুলের এই মন্তব্য এবং বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য মিলিয়ে দেখলে এখানে কিছুটা ভিন্ন উত্তর পাওয়া যাবে বৈকি! 

এইবার শেষ করি সেলফি প্রসঙ্গ দিয়ে। সদ্যই সমাপ্ত হওয়া জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, “এটি একটি আনন্দের মুহূর্ত, সবাই আনন্দিত। সেলফি তোলার সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বেশ উচ্ছ্বসিত দেখা গেছে।” অপরদিকে বিরোধীরা দাবি করছেন যে ‘সেলফি দিয়ে বিভ্রান্তির চেষ্টা হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো নড়চড় হবে না।’ এই সেলফি দেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় -‘বিএনপি নেতাদের মুখ শুকিয়ে যাওয়ার’ বিপরীতে বিএনপি মহাসচিবের পরামর্শ ‘ছবি প্রিন্ট করে গলায় ঝুলিয়ে রাখুন’ সবই আমরা শুনলাম। 

এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে আমাদের মনে পড়বে- চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিল। সে সময় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছিলেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা বাধা সৃষ্টি করবে, তাদের আমেরিকার ভিসা দেয়া হবে না। 
শুরুতে তুরাগ তীরের যে শিঙারা দোকানির কথা উল্লেখ করেছিলাম, শেষদিকে এসে যেন সেই একই সুর শোনা গেল। শিঙ্গাড়া দোকানির এক বিলিয়ন না পাওয়া আক্ষেপ এবং আমেরিকার ভিসা না পাওয়ার ঝুঁকি একইভাবে মিলিয়ে দেখা যাবে কি?

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

১০

স্বপ্নের স্বদেশের সন্ধানে/ তফসিল ঘোষণা- এরপর কি সব সমাধানের সুযোগ শেষ?

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status