নির্বাচিত কলাম
যে কারণে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না শি জিনপিং
শৈবাল দাসগুপ্ত
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার
জি-২০তে ভারতের অংশগ্রহণ ভারতের নেতৃত্বের জন্য একরকম অনুমোদন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার বেশ কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। তার মধ্যে আছে ৫১টি দেশের সমন্বয়ে তৈরি আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি-২০’র সদস্য করা। অর্থনৈতিক উত্থানের কারণে ভারতের প্রভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশ হিসেবে উঠে আসছে। সফলভাবে তারা চাঁদের পৃষ্ঠে চন্দ্রযান উৎক্ষেপণ করেছে। ভারতের নেতৃত্বকে সমর্থন দিতে চাইবেন না শি জিনপিং, যেখানে সীমান্তে ভারতের সঙ্গে চীনের বিরোধ অব্যাহত আছে, বিরোধপূর্ণ সীমান্তে স্টোনওয়াল প্রচেষ্টা। এ ছাড়া দুই দেশ সম্প্রতি একে অন্যের দেশের সাংবাদিকদের বহিষ্কার করেছে।
নয়াদিল্লিতে ৯ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে দু’দিনের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। এতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং অন্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে মিটিং প্রথমেই এড়ানোর চেষ্টা করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি শিডিউল অনুযায়ী উপস্থিত থাকা বাতিল করেছেন।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলেন, বেইজিংয়ে বসে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যা নির্দেশনা দেবেন সে মতোই চলবেন প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং। তিনি নিজের থেকে কোনো উদ্যোগ দেবেন এমনটা মনে হয় না। চীনের অন্য বেশির ভাগ নেতাদের মতোই তিনি এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের প্রোফাইলের উত্থান ঘটাবেন না। কারণ, শি জিনপিং চান না তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদেরকে বড় করে তুলুন।
অজুহাত খোঁজা
অন্য পর্যায়ে চীনের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইঙ্গিত দিয়েছে যে, শি জিনপিং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মিটিংয়ে যোগ না-ও দিতে পারেন। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে এশিয়া প্যাসিফিক নেতাদের নিয়ে সেই মিটিং। এক বিবৃতিতে চীনের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চীনা নীতি নিয়ে ওয়াশিংটনের দ্বিমুখী ত্রুটি খুঁজে পেয়েছে তারা। সত্যিকার অর্থে ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে সান ফ্রান্সিসকো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে দেখাতে হবে যে, আসলেই তাদের আন্তরিকতা আছে। উল্লেখ্য, বালিতে জি-২০’র আগের সম্মেলন হয়েছে। অন্যদিকে এশিয়া প্যাসিফিক নেতাদের আসন্ন সম্মেলন হতে যাচ্ছে সান ফ্রান্সিসকোতে। মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, চীনকে খাটো করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যদিয়ে চীনের অর্থনীতিকে খর্ব করা হয়েছে। তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি এবং সামরিক সহায়তা অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তাইওয়ান ভূখ-কে নিজেদের বলে দাবি করে চীন। এর বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে অস্ত্র সহায়তা দেয়ার বিরোধিতা করছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সান ফ্রান্সিসকোর বৈঠকে শি জিনপিংয়ের যোগদান এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে চীন। সান ফ্রান্সিসকোর ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বেশ কিছু বিশ্বনেতা যোগ দেবেন। এই বৈঠকেই চীনের নেতা শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন- এমনটাই আশা করা হচ্ছিল। বাইডেন বলেছেন, শি জিনপিংয়ের এই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি অসন্তুষ্ট। তা সত্ত্বেও তিনি এখনো আশাবাদী সান ফ্রান্সিকোর মিটিংয়ে যোগ দেবেন শি জিনপিং। বাইডেন বলেন, আমি অসন্তুষ্ট। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হবে- এটা আশা করি।
কেন বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনার এই সুযোগ হাতছাড়া করছেন শি জিনপিং, অথচ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিজেকে একজন বিশ্বনেতা এবং শান্তি প্রণেতা হিসেবে উপস্থাপন করার নীতি আছে তার। কেন তিনি সেই নীতির বিপরীতে যাবেন?
চীনা অর্থনীতি নিয়ে আসলে জটিল প্রশ্ন এড়ানোর এটা হচ্ছে চীনা প্রেসিডেন্টের পরিষ্কার প্রচেষ্টা। তাদের অর্থনীতি বিশ্বজুড়ে আর্থিক বাজারের ওপর একটি ভয়াবহ প্রভাব রাখে। করোনা মহামারির সময় শেষেও চীনের অর্থনীতির পতন হয়েছে মারাত্মকভাবে। ২০২৪ সালও তাদের ভালো যাবে না। এ জন্য বৈশ্বিকভাবে তাদের প্রভাবও হ্রাস পেয়েছে। চীনে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র প্রায় মাসেই চীনা কোম্পানিগুলোর পথে নতুন নতুন বাধা সৃষ্টি করছে। এর ফলে চীনের অভ্যন্তরে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি অর্থনৈতিক নীতির পুনর্মূল্যায়ন করছে। কয়েক দশকের মধ্যে শহুরে যুব কর্মসংস্থান সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গেছে। এতে দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়েও চিন্তিত তারা। সহজ কথায় এই মুহূর্তে বিশ্বমঞ্চে নিচের শাসনের পক্ষে অবস্থান নিতে অক্ষম শি জিনপিং।
শি নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করছেন
ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িত থাকার কারণে সম্মেলনে যোগ দেবেন না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ¬াদিমির পুতিন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক ইভেন্টে শি জিনপিং এবং পুতিন একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, বৈশ্বিক ইস্যুগুলোতে সমন্বয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। পুতিনের অনুপস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেন থেকে শুরু করে তাইওয়ান পরিস্থিতি পর্যন্ত ইস্যুগুলোতে একপেশে হয়ে পড়তে পারেন শি জিনপিং।
উপরন্তু জি-২০তে সৌদি আরব, আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক বাদে চীনের খুব কমই বন্ধু আছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে যদি চাপের মুখে পড়ে তাহলে এই দেশগুলো চীনের পক্ষে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। চীনের ঘনিষ্ঠ অংশীদারদের বেশির ভাগই অনুন্নত দেশ। তারা জি-২০ এর অংশ নয়। এসব দেশে অবকাঠামো খাতে ও অন্যান্য খাতে চীনের অর্থায়ন প্রয়োজন। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরে নৌমহড়ায় যোগ দিয়েছে ফিলিপাইন। এটাকে গুরুতর সামরিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছে চীন। অস্ট্রেলিয়ার ওই মহড়া পরিচালিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে এবং তা চীনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ। চীন ওই সাগরের বেশির ভাগ অংশ নিজেদের বলে দাবি করে। এ এলাকা থেকে মাঝে মধ্যেই ফিলিপাইনের নৌবহরকে তাড়িয়ে দেয় চীনের নৌবাহিনী।
জি-২০তে ভারতের অংশগ্রহণ ভারতের নেতৃত্বের জন্য একরকম অনুমোদন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার বেশ কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। তার মধ্যে আছে ৫১টি দেশের সমন্বয়ে তৈরি আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি-২০’র সদস্য করা। অর্থনৈতিক উত্থানের কারণে ভারতের প্রভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশ হিসেবে উঠে আসছে। সফলভাবে তারা চাঁদের পৃষ্ঠে চন্দ্রযান উৎক্ষেপণ করেছে। ভারতের নেতৃত্বকে সমর্থন দিতে চাইবেন না শি জিনপিং, যেখানে সীমান্তে ভারতের সঙ্গে চীনের বিরোধ অব্যাহত আছে, বিরোধপূর্ণ সীমান্তে স্টোনওয়াল প্রচেষ্টা। এ ছাড়া দুই দেশ সম্প্রতি একে অন্যের দেশের সাংবাদিকদের বহিষ্কার করেছে।
ভারতকে সমর্থন করেন বাইডেন: ভারতকে নেতৃত্বে এমন ভূমিকায় নিতে যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহী, যা বিশ্বে চীনের প্রভাবের প্রতিকূল হিসেবে কাজ করে। নয়াদিল্লিতে উপস্থিত হয়ে এমন পরিস্থিতিকে সমর্থন করার মতো মেজাজে নেই শি জিনপিং।
৯ই সেপ্টেম্বর শুরু হচ্ছে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। এর দু’দিন আগে ৭ই সেপ্টেম্বর ভারতের অবস্থানকে সমৃদ্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনা করতে নয়াদিল্লি সফরে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এই ঘোষণাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে, নয়াদিল্লির সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না শি জিনপিং। এর পরপরই ওই ঘোষণা এসেছে। জি-২০’র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পর্যটন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিভিন্ন সেক্টরিয়াল মিটিংয়ে ভারতের অনেক প্রস্তাব আটকে দিয়েছে চীন। বেইজিংয়ের লক্ষ্য হলো ভারতকে সফলতা দাবি করা থেকে বিরত রাখতে বৈঠক শেষে একটি যৌথ বিবৃতির সম্ভাবনাকে আটকে দেয়া।
শিডিউল সময়ের আগেই নয়াদিল্লি এসে জো বাইডেন ভারতে তার ওজন বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। জি-২০’কে যৌক্তিকভাবে সফল করার চেষ্টা করছেন। যাহোক যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেন ইস্যুতে একটি রেজ্যুলুশন সামনে ঠেলে নাও দিতে পারেন, কারণ, চীন এবং রাশিয়ার প্রতিনিধিরা যেকোনো উপায়ে তার বিরোধিতা করবেন।
(অনলাইন এনডিটিভিতে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)