ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

ইমরান খান কি নত হলেন?

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবারmzamin

পাকিস্তান ও পাকিস্তানের বাইরে এমন একটি আলোচনা আছে যে, ইমরান খানের জনপ্রিয়তার কারণে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ)-এর জোট নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়। পাশাপাশি আইএমএফের সহযোগিতা সত্ত্বেও দেশকে বড় অর্থনৈতিক সংকটে রেখেই বিদায় নিয়েছে সাবেক সরকার। জনগণ তাদের পারফরমেন্সে একদমই খুশি নয়। অপরদিকে ইমরান খান যেভাবে সেনাবাহিনীর প্রভাব খর্বে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তা তার জনসমর্থন কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছে। যদিও পাকিস্তানে জনসমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় থাকা যায় না। এখন পর্যন্ত দেশটির কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। এই ইমরান খানের সঙ্গে এক সময়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সেনাবাহিনীর। কিন্তু তিনি এমনভাবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন যা তার আগে কোনো রাজনীতিক করেননি। সেনাবাহিনীর ইশারাতেই যে তাকে বন্দি করা হয়েছে তা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এই গ্রেপ্তারের কারণেও ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।

 

ইমরান খান কী নত হলেন? অ্যাটক জেলে আটক ইমরান প্রতিষ্ঠানগুলো এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত। তার আইনজীবীদের মাধ্যমে এ কথা জানিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো (ইনস্টিটিউশনস) বলতে এখানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন নির্বাচন কমিশন। হতে পারে সেটা সেনাবাহিনীর সঙ্গেও। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও তিনি বসতে প্রস্তুত। এমনটাই হবে বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। কারণ, দেশটিতে সরকার যতটা ক্ষমতাধর, তার চেয়ে তাদের সেনাবাহিনী বেশি ক্ষমতাধর। তাদের অঙ্গুলি হেলনে নির্ধারিত হয় জাতির ভাগ্য। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় অর্ধেকটা সময় কেটেছে সেনা শাসনে। এখনো তারা বেসামরিক শাসনে থাকলেও এসব প্রশাসনের ওপর তাদের ছায়া আছে সব সময়। ফলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিরোধিতা করে তিনি, জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে উৎরে যাবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু তা আর হলো না। 

ইমরানকে কুখ্যাত অ্যাটক জেলেই দিন গুনতে হচ্ছে। সেখানে তিনি সুস্থ আছেন। স্বাভাবিকভাবে খাবার খাচ্ছেন। নিয়মিত শরীরচর্চা করছেন। কিন্তু সব থেকে বড় যে অস্বস্তিতে আছেন, তাহলো তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারছেন না। মুক্ত একজন মানুষ যতটুকু সক্রিয় থাকতে পারেন, কারান্তরালে বসে তার পক্ষে বিন্দুমাত্রও সম্ভব নয়। আলোচনায় নানা কথা। কেউ বলছেন, ইমরান খান রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিদেশে চলে যাবেন। কিন্তু শনিবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তার দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফের (পিটিআই) আইনজীবীরা। তাদেরকে তিনি বলেছেন, দেশ ছেড়ে তিনি কখনোই চলে যাবেন না। সাক্ষাৎ শেষে আইনজীবী ব্যারিস্টার গওহর আলি খান বলেছেন, শনিবার পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ দলের (পিটিআই) বেশ কয়েকজন আইনজীবী জেলখানায় সাক্ষাৎ করেন ইমরান খানের সঙ্গে। তাদেরকে এই সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছিলেন এটিসির বিচারক আবুল হাসনাত জুলকারনাইন। সাক্ষাৎ শেষে ইমরান খানকে উদ্ধৃত করে বক্তব্য রাখেন ব্যারিস্টার গওহর আলি। তিনি বলেন, ইমরান খানকে বেআইনিভাবে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। এতসব সত্ত্বেও তিনি প্রতিষ্ঠানগুলো এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত। এমন আলোচনা হলে তার প্রধান লক্ষ্য থাকবে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। 

ইমরান খান দৃশ্যত যখন একা হয়ে পড়েছেন তখন দেশটির প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল বিবেকের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছেন। আইন সংশোধন করে পার্লামেন্টারিয়ানদের অযোগ্যতার মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর করে যে আইন তড়িঘড়ি করে পাস করে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স (পিডিএ) সরকার, তাকে তিনি অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেন। সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে তিনি প্রচণ্ড চাপে পড়বেন তাও তিনি জানেন। তবু বিবেকের তাড়নায় তিনি ওই রায় দেন। সেনাবাহিনী বা সরকার, কারও লেজুড়বৃত্তি করেননি। আবার ওই রায় দেয়ার পর তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে গেছেন এমন অভিযোগ তোলারও সাহস পায়নি কোনো রাজনৈতিক দল। তার ওই রায়ের ফলে ইমরান খানের  জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু তাকে কূটনৈতিক বার্তা মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। ফলে ইমরানের জন্য বের হয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে যে শতাধিক মামলা আছে, আদালত চাইলেও তা থেকে তিনি সহসাই মুক্তি পাবেন বলে মনে হয় না। কারণ, এক মামলায় তিনি জামিন পেলে আরেক মামলা এসে হাজির হবে। এই লড়াইয়ে টিকে থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়বে ইমরানের জন্য। এটাই কি তিনি বুঝতে পেরে আলোচনায় প্রস্তুত থাকার কথা জানান দিয়েছেন! 

অন্যদিকে অক্টোবরেই দেশে ফেরার কথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএলএন) প্রধান নওয়াজ শরীফের। তিনিও প্রায় একই রকম ভাগ্যবরণ করেন, তৎকালীন সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাড়ি জমান। সেখানেই স্ত্রীকে হারান। লন্ডনে থাকলেও পাকিস্তানের ভেতরকার রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছিলেন তিনি। তার ছোট ভাই শেহবাজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী হলেও, শেহবাজ প্রশাসন, রাজনীতি এবং সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ, সম্পর্ক বজায় রেখেছেন নওয়াজের দেখানো পথেই। এ জন্য ঘন ঘন শেহবাজ শরীফ, নওয়াজ শরীফের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ ঘন ঘন লন্ডন উড়ে গেছেন। উদ্দেশ্য, তার কাছ থেকে দাওয়াই আনা। নওয়াজ যেভাবে বলেছেন, তারা সেভাবে দেশ চালিয়েছেন, প্রশাসন চালিয়েছেন। সর্বশেষ আইন সংশোধন করে তাকে দেশে ফেরানোর পথ সুগম করেছেন তারা। এই সুবাদে অক্টোবরের মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসার কথা নওয়াজের। তিনি যদি দেশে ফেরেন তবে তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে। কারণ, তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে, তার ফয়সালা হতে হবে। ঠিক যেমনটা হচ্ছে থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার ক্ষেত্রে। সিনাওয়াত্রার বিরুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতে জেল ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তিনি আগস্টে দেশে ফিরলেও তাকে বিমানবন্দর থেকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টে। সেখান থেকে জেলে। রাজনৈতিক দরকষাকষির মাধ্যমে তিনি মুক্তি পাবেন বলে বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনা চলছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে সামরিক শাসনে জর্জরিত থাইল্যান্ড হাফ ছেড়ে বাঁচবে। গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে পর্যটনের এই দেশটিতে। ঠিক একই পরিণতি কি ভোগ করতে হবে নওয়াজ শরীফকে? অবশ্য তার দল পিএমএলএন বলেছে, তিনি দেশে ফিরে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নেমে পড়বেন। নির্বাচন করবেন এবং তিনিই হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।  

পাকিস্তান ও পাকিস্তানের বাইরে এমন একটি আলোচনা আছে যে, ইমরান খানের জনপ্রিয়তার কারণে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ)-এর জোট নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়। পাশাপাশি আইএমএফের সহযোগিতা সত্ত্বেও দেশকে বড় অর্থনৈতিক সংকটে রেখেই বিদায় নিয়েছে সাবেক সরকার। জনগণ তাদের পারফরমেন্সে একদমই খুশি নয়। অপরদিকে ইমরান খান যেভাবে সেনাবাহিনীর প্রভাব খর্বে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তা তার জনসমর্থন কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছে। 

যদিও পাকিস্তানে জনসমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় থাকা যায় না। এখন পর্যন্ত দেশটির কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। এই ইমরান খানের সঙ্গে এক সময়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সেনাবাহিনীর। কিন্তু তিনি এমনভাবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন যা তার আগে কোনো রাজনীতিক করেননি। সেনাবাহিনীর ইশারাতেই যে তাকে বন্দি করা হয়েছে তা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এই গ্রেপ্তারের কারণেও ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।

এর আগে গত মে মাসে ইমরান খানের গ্রেপ্তার নিয়ে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল। গোটা পাকিস্তানজুড়ে জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছিল। ইমরানের জনপ্রিয়তা বুঝতে ওই একটি ঘটনাই যথেষ্ট ছিল। তাই দেরি না করে ওই ঘটনার পরপরই ইমরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে শেহবাজ শরীফের সরকার ও সেনাবাহিনী। সত্তর বছর বয়সী এই রাজনীতিক দাবি করেন যে, সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য হলো ‘তাকে বন্দি রেখে তার দলকে ধ্বংস করে দেয়া’। এখন কার্যত তাই দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে যেই চ্যালেঞ্জ করুক, এমনকি সেটা ইমরান খানের মতো জনপ্রিয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হলেও, তাকে সরে যেতে হবে। পাকিস্তানের গোটা ইতিহাসজুড়ে এমন নজিরের অভাব নেই। ইমরান খান হয়তো বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং শেষ পর্যন্ত আপসের রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক/ পিতা ও কন্যার পরিণতি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status