নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক
আফ্রিকার ‘ক্যু জোন’
অনিম আরাফাত
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার
নাইজারের সামরিক বাহিনীর দাবি, নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি এবং অপশাসন বেড়ে যাওয়ায় নাইজারের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনী প্রেসিডেন্ট মোহামেদ বাজুমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সে কারণেই ক্ষমতা হস্তগত করতে বাধ্য হয় সেনাবাহিনী। ওই অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পশ্চিমা দেশগুলো। বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে তারা নাইজারকে আর কোনো সহায়তা দেবে না। তবে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সামরিক বাহিনী এখন আস্তে আস্তে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
আফ্রিকার দেশ গ্যাবনে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে সেনাবাহিনী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকার দেশগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৩ বছরে গ্যাবন ছাড়াও মালি, বুরকিনা ফাসো, গিনি, সুদান, চাদ ও নাইজারেও ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। সর্বশেষ গ্যাবনে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে দেশটির সেনাবাহিনী এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলো।
১৯৫০ সালের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মোট ৪৮৮টি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। শুধু আফ্রিকাতেই হয়েছে ২১৪টি অভ্যুত্থান। যার মধ্যে ১০৬টি সফল হয়েছে।
গ্যাবন
অভ্যুত্থান চালিয়ে ক্ষমতা দখলের সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে গ্যাবন। ৩০শে আগস্ট আফ্রিকার এ দেশটির প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গো ওনডিম্বাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এদিনই দেশটির সাধারণ নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়েছিল। যাতে জয় পান পূর্ববর্তী শাসক ওনডিম্বা। কিন্তু দেশটির সামরিক বাহিনী এই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে দেশের ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। কারণ, ওনডিম্বা যে নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন তাতে ছিল কারচুপির প্রচুর অভিযোগ। গত ৫৫ বছর ধরে গ্যাবনের ক্ষমতা এই বঙ্গো পরিবারের হাতে। অবশেষে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে দেশটির বঙ্গো শাসনের অবসান ঘটলো।
আফ্রিকার এ দেশটি অত্যন্ত তেলসমৃদ্ধ এবং এর ৯০ শতাংশ অঞ্চলই বন। একসময় ফ্রান্সের অধীনে ছিল গ্যাবন। তবে স্বাধীনতার পরেও দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ফ্রান্সের ব্যাপক প্রভাব ছিল। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ওনডিম্বাকে ফ্রান্সপন্থি বলেও বিবেচনা করা হয়। গ্যাবনের সেনাদলের দাবি, দায়িত্বজ্ঞানহীন, অপ্রত্যাশিত শাসন ব্যবস্থার ফলে দেশের সামাজিক সংহতির ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। এরফলে দেশ বিশৃঙ্খলার দিকে চলে যাচ্ছে। তাই বর্তমান শাসনের অবসান ঘটিয়ে শান্তি রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেনাবাহিনী।

নাইজার
গ্যাবনের এই সামরিক অভ্যুত্থানের খবর এমন সময় এলো যখন গোটা বিশ্ব সম্প্রতি হওয়া নাইজারের সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে ব্যস্ত ছিল। গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আফ্রিকার দেশ নাইজারে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। সৈন্যরা দেশটির পশ্চিমাপন্থি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজুমকে আটক করে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। পাশাপাশি সংবিধান বাতিল এবং সব প্রতিষ্ঠান ও সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। এরপর একদল সৈন্য জাতীয় টেলিভিশনে ঘোষণা করে যে নাইজারের প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
ক্ষমতা দখল করেই নাইজারের সামরিক বাহিনী দেশের সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া দেশব্যাপী জারি করা হয় কারফিউ। যদিও দেশটির এই সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থান বেশ জনপ্রিয় বলেই মনে হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ সামরিক শাসকদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। তাদের হাতে ছিল রাশিয়ার পতাকা। দেশটির জনগণ অভ্যুত্থানের পর রাশিয়ার সমর্থন ও সহায়তা চেয়েছে। রাশিয়া যদিও এই অভ্যুত্থানের পেছনে নিজের কোনো ভূমিকার কথা স্বীকার করেনি।
নাইজারের সামরিক বাহিনীর দাবি, নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি এবং অপশাসন বেড়ে যাওয়ায় নাইজারের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনী প্রেসিডেন্ট মোহামেদ বাজুমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সে কারণেই ক্ষমতা হস্তগত করতে বাধ্য হয় সেনাবাহিনী। ওই অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পশ্চিমা দেশগুলো। বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে তারা নাইজারকে আর কোনো সহায়তা দেবে না। তবে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সামরিক বাহিনী এখন আস্তে আস্তে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বুরকিনা ফাসো
পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ বুরকিনা ফাসোতে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। ক্ষমতাচ্যুত করা হয় দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোচ মার্ক ক্রিশ্চিয়ান কাবোরেকে। অভ্যুত্থানের এক দিন আগে থেকেই দিনভর গোলাগুলি চলছিল রাজধানীতে। পরদিন সন্ধ্যায় চূড়ান্তভাবে সরকার পতনের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। যদিও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সেনাবাহিনী দাবি করেছিল যে, তারা কোনো সহিংসতা ছাড়াই ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। জানুয়ারি মাসের ওই ক্যুতে ক্ষমতায় বসেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল হেনরি দামিবা। তবে ওই বছরের অক্টোবর মাসেই আবারো ক্যু হয় বুরকিনা ফাসোতে। এবার দামিবাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে। দামিবা বুরকিনা ফাসোর নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি করতে ব্যর্থ হয়েছেন দাবি করে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান করে ত্রাওরের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর আরেকটি অংশ।
শাদ
এর আগে ২০২১ সালে মোট তিনটি সেনা বিদ্রোহ দেখে আফ্রিকার এই ‘ক্যু জোন’। এরমধ্যে প্রথম বিদ্রোহ হয় শাদে। ওই বছরের এপ্রিল মাসে আফ্রিকার শাদের ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। সে সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস ডেবি বিদ্রোহ কবলিত অঞ্চল পরিদর্শনের সময় সেনা বিদ্রোহে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরপরই শাসনক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। হত্যাকাণ্ডের সময় টানা ষষ্ঠবারের মতো ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছিলেন ইদ্রিস ডেবি। তবে তার মৃত্যুর পর দেশটির সরকার ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেয় সামরিক বাহিনী। ৬৮ বছর বয়সী ডেবি ছিলেন দীর্ঘদিন শাসন করা অন্যতম আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধান। ১৯৯০ সালে এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি।
গিনি
একই বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালে গিনির ক্ষমতা দখল করেন দেশটির সেনাবাহিনীর কর্নেল মামাদি দম্বুয়া। সে সময় ক্ষমতাচ্যুত হন দেশটির প্রেসিডেন্ট আলফা কোন্ডে। টেলিভিশনে সংক্ষিপ্ত বার্তায় বিদ্রোহী সেনারা সরকার ও সংবিধান বিলুপ্তির ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে প্রবেশ করে তাকে বন্দি করে গিনির সামরিক বাহিনী। এর আগে প্রাসাদের বাইরে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে যুদ্ধ হয় সেনাসদস্যদের। তবে সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের সঙ্গে পেরে ওঠেনি তারা।
সুদান
২০২১ সালের অক্টোবরে সুদানের সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান দেশটির শাসন কাউন্সিলকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন। আগে থেকেই রাজনৈতিক সংকটে টালমাটাল ছিল দেশটি। সেই সুযোগে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লা হামদকসহ সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী এবং সরকার সমর্থক রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করে সুদানের সামরিক বাহিনী। যদিও দেশটি এখন গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। সেনাবাহিনীকে সরিয়ে সুদানের ক্ষমতা দখল করতে চায় আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফ। এ বছরের ১৫ই এপ্রিল থেকে চলমান এই যুদ্ধে দেড় মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
মালি
এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানগুলো শুরু হয় মালি থেকে। ২০২০ সালের আগস্টে সামরিক অভ্যুত্থান চালিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয় দেশটির সেনাবাহিনীর একটি দল। ধারণা করা হয়, মালির এই অভ্যুত্থানই পরবর্তীতে প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোতে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বুবাকার কেইতাকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীর ওই অংশের মুখপাত্র দাবি করেছেন যে, দেশ যেন আরও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে না যায় সে লক্ষ্যে তারা ক্ষমতা দখল করতে বাধ্য হয়েছেন। সামরিক বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট কেইতা নিজেই পদত্যাগ করেন।
মন্তব্য করুন
নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন
নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত
বেহুদা প্যাঁচাল/ অর্থমন্ত্রীর এত বুদ্ধি!
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ বাংলাদেশের অর্থ পাচার, ভারতের আনন্দবাজার, ইউরোপের কালো তালিকা
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ নির্বাচন ঘিরে একই প্রশ্ন, আমেরিকা কি ম্যানেজ হয়ে যাবে?
আন্তর্জাতিক/ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পশ্চিমাদের অবস্থান
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, সরকারের নীরবতা, অ্যাকশনে অন্যরাও?

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]