নির্বাচিত কলাম
চলতি পথে
ব্রিকস: আশা যখন নিরাশা
শুভ কিবরিয়া
২৯ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার
কী হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেটা অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়দের দম, বুদ্ধি ও শক্তিমত্তার উপর অনেকটাই নির্ভর করবে। তার উপরে নির্ভর করবে কে কীভাবে খেলতে চান সেই কৌশলের উপর। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রাও ভূমিকা রাখবেন। তবে সেখানে চীন বা ভারতের চাইতে আমেরিকান ভূমিকাই মুখ্য হয়ে উঠবে। অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়দের দলবদল বা জার্সি বদল হতে পারে। ঘাপটি মেরে থাকা অনেকেই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন। বহুপক্ষীয় সক্রিয়তা জোরদার হলে গণতন্ত্র লক্ষ্যচ্যুত হতে পারে। পক্ষগণের আপসহীন, একগুঁয়েমিতা বহু বড় বিপদের দিকে ঠেলতে পারে বাংলাদেশকে। সবচাইতে বড় বিপদের কথা নিজ নিজ পক্ষ বা দলের স্বার্থ বড় হয়ে উঠতে থাকলে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ গৌণ হয়ে উঠতে পারে
ব্রিকস (BRICS)-ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জোটে শেষ অবধি বাংলাদেশের জায়গা হলো না। ভারত, চীনের আগ্রহে ও উৎসাহে ব্রিকসে নতুন সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ জায়গা পাচ্ছে সেই হাইপ বা আওয়াজ বাংলাদেশের মধ্যে ওঠালেও জায়গা মতো ঘটেছে উল্টো ঘটনা।

চীন: নির্ভরতা কতোটুকু
দক্ষিণ এশিয়াতে চীন আস্তে আস্তে রাজনীতিতে জড়াচ্ছে, প্রকাশ্যে। অন্তত কূটনীতির আওয়াজে, তার অবস্থান টের পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অতি তৎপরতার বিষয়ে চীন প্রকাশ্যে তার বক্তব্য রেখেছে। সদ্য চলা ব্রিকস সম্মেলনেও চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে সমর্থন যুগিয়ে যাবার কথা বলেছেন। বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত সে কথা অনেকবার বলেছেন। চীনে সফর করে আসা বাংলাদেশের চীনামুখী বামপন্থি নেতা যারা সরকারের ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গী, তারাও সে কথা বলেছেন স্পষ্টভাবেই। সুতরাং একথা এখন বলা যায়, চীনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু চীনের যে রাষ্ট্রনৈতিক আচরণ সেটা মনোযোগ সহকারে বিশ্লেষণ করলে একটা কথা সুস্পষ্ট চীনের মুখ্য লক্ষ্য যতটা না রাজনীতি তার চাইতে অনেক বেশি বাণিজ্য। চীনের কূটনীতিও তাই অতিমাত্রায় বাণিজ্যমুখীন। ফলে শ্রীলঙ্কা, চীন, নেপাল কিংবা মালদ্বীপের রাজনীতির পট পরিবর্তনের দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায়, চীন তার রাজনৈতিক মিত্র বলে যাদের চিহ্নিত করেছে, বিপদের দিনে তাদের পাশে মন-প্রাণ এক করে দাঁড়ায়নি কখনো। পাকিস্তানের ইমরান খান, তার সর্বশেষ উদাহরণ। সে সেখানেও নতুন শাসকদের সঙ্গে দরকষাকষি করে তার পূর্বতন বাণিজ্য টিকিয়ে ভবিষ্যতের বাণিজ্যকে সুনিশ্চিত করার পথই বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে, চীন- ভারতের বৈরিতাও একটা ফ্যাক্টর। চীন-ভারতের বাণিজ্যযুদ্ধ যেমন সত্য তেমনি রাজনৈতিক শত্রুতাও চিহ্নিত। কাজেই বাংলাদেশের অধিকতর চীনামুখিনতা ভারতকেও খুশি করবেÑ একথা বলা যায় না। বিশেষ করে ভারতের সামরিক ও বাণিজ্য স্টাবলিশমেন্ট বাংলাদেশের চীনামুখিনতাকে কখনই সুনজরে দেখবে বলে মনে হয় না। তাই পশ্চিমাদের শত্রুতার বিপক্ষে চীনাভরসা কখনই সুখদায়ক অভিজ্ঞতা দেবে এই আশা করা যায় না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অতীতে কখনোই চীনাভরসা টেকসই হয় নাই, নির্ভরতা যোগাতে পারে নাই।
ভারত: কতোটা আপন
২০২৪ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচন। এ নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদীদের ঠেকাতে সকল বিরোধীরা একজোট হওয়ার চেষ্টা করছেন জোটবদ্ধভাবে। ভারতের ৬০ বছরের কংগ্রেস শাসনের দ্বারা অর্জিত যে কথিত প্রগতিশীলতা তাকে প্রায় হিন্দুত্ববাদী ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি। সমাজের সকল অংশে বিশেষ করে সকল প্রতিষ্ঠানে হিন্দুত্ববাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার আদর্শিক প্রেরণায় কাজ করছে বিজেপি ও তার সকল পার্টনার। কাজেই এবারের লোকসভা নির্বাচন মূলত হিন্দুত্ববাদী আদর্শিক প্রেরণার সঙ্গে ভারতীয় পশ্চিমা গণতন্ত্রীপন্থি উদারবাদীদের একটা আদর্শিক লড়াই হতে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক স্টাবলিশমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচনে ২০১৪ সালের মতো অতীত ভূমিকায় কতোটা ফিরবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। যেখানে আমেরিকা এ ব্যাপারে একটা প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ছড়ি কার হাতে থাকবে সেটা নির্ধারণেও আমেরিকার একটা বড় ভূমিকা থাকবে। ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সামরিক বাণিজ্যের যে পাটাতন তৈরি হয়েছে চীন ও রাশিয়াকে মোকাবিলা করে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলেও ভারতের ভোটের ফলাফলে আমেরিকাকেও ভূমিকা রাখতে হবে নিজ স্বার্থেই। বিশ্বরাজনীতির বর্তমান শক্তিধর আমেরিকাকে ডিঙ্গিয়ে ভারত বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে যেকোনো মূল্যে ২০১৪ সালের বা ২০১৮ সালের মতো সরাসরি বর্তমান সরকারের পক্ষেই ভূমিকা রাখবে এই ভরসা যারা করছেন, তারা সম্ভবত বাস্তবতা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছেন। তারা সাম্প্রতিক ব্রিকসে ভারতের ভূমিকার দিকে চোখ ফেরাতে পারেন।
কী হবে, তাহলে!
কী হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেটা অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়দের দম, বুদ্ধি ও শক্তিমত্তার উপর অনেকটাই নির্ভর করবে। তার উপরে নির্ভর করবে কে কীভাবে খেলতে চান সেই কৌশলের উপর। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রাও ভূমিকা রাখবেন। তবে সেখানে চীন বা ভারতের চাইতে আমেরিকান ভূমিকাই মুখ্য হয়ে উঠবে। অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়দের দলবদল বা জার্সি বদল হতে পারে। ঘাপটি মেরে থাকা অনেকেই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন। বহুপক্ষীয় সক্রিয়তা জোরদার হলে গণতন্ত্র লক্ষ্যচ্যুত হতে পারে। পক্ষগণের আপসহীন, একগুঁয়েমিতা বহু বড় বিপদের দিকে ঠেলতে পারে বাংলাদেশকে। সবচাইতে বড় বিপদের কথা নিজ নিজ পক্ষ বা দলের স্বার্থ বড় হয়ে উঠতে থাকলে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ গৌণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের জল-জলা, সমুদ্র আর খনিজ সম্পদে ভাগ বসাতে পারে বহুজন। আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনার দায়িত্ব চলে যেতে পারে অন্যদের কর্তৃত্বে।
তাই এবারের নির্বাচন এক অর্থে শুধু বাংলাদেশের মাটিতে আমেরিকা-ভারত-চীন বা রাশিয়ার কূটনৈতিক লড়াই নয়, বাংলাদেশের জনগণের নিজ স্বার্থরক্ষার লড়াইও। আমরা প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরে পাবো কিনা, আমাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করার স্বাধীনতা কতোটা আমাদের হাতে থাকবে, সেটাও নির্ধারিত হবে এবারের নির্বাচনে।
পুনশ্চ: একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। এক তরুণ শিষ্য সাধুকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে। ধরেন, আমি একটা স্বপ্ন দেখছি। বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে পথ হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম সামনে একটা বাঘ। আমি অন্য একটা পথ ধরলাম। দেখলাম সেখানেও একদল নেকড়ে দাঁড়িয়ে। এরপর যেদিকেই যাচ্ছি, কোনো না কোনো হিংস্র জন্তুর দেখা পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতিতে আমি কী করবো?’
সাধু মৃদু হেসে বললেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে তোমার উচিত ঘুম থেকে জেগে ওঠা।’
শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
পাঠকের মতামত
তরুণ শিষ্যকে সাধু উপদেশ দিয়েছিলেন, 'এমন পরিস্থিতিতে তোমার উচিত ঘুম থেকে জেগে ওঠা।’ পরিস্থিতি ভয়ংকর। ডানে, বাঁয়ে, সামনে, পিছে বিপদ আর বিপদ। বিপদ যেন পিছু ছাড়ছেনা। জনগণের গনতান্ত্রিক অধিকার নেই। ভোটের অধিকার নেই। বাকস্বাধীনতা সীমিত। সবকিছু মিলিয়ে মনে হয় একটা গোষ্ঠীতন্ত্র আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে জনগণকে। সবই একই সুতোয় বাঁধা। বাজার ব্যবস্থায় সিণ্ডিকেট, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে তুলে নেয়া, প্রকল্পের অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যয় বৃদ্ধি, বিদেশে টাকা পাচার বহুল আলোচিত ঘটনা। অনেকের অভিযোগ বিচারহীনতার সংস্কৃতিও ওই গোষ্ঠীতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। তাহলে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল আর রইলো কোথায়? এজন্যই জনগণ মূলত: এক অনিরাপদ পরিস্থিতির মোকাবিলার লড়াইয়ে অবতীর্ণ। দ্রব্যমূল্যের চাপ আরো কতোটা ভয়াবহ হলে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মন ভরবে? জনগণের ত্রাহি অবস্থার মধ্যে কথিত উন্নয়নের ঢোল পেটানো রসিকতা বৈ আর কী! গোষ্ঠীতন্ত্রের একটাই লক্ষ লুটপাট। একারণে উপেক্ষিত হয়েছে গনতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুষ্ঠু ভোটাধিকার। প্রায় শতাব্দীকাল ধরে মিশরের জনগণের গনতান্ত্রিক ভোটের অধিকার নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাজারো ঘটনা ঘটে। দীর্ঘকাল পরে ২০১২ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ইসলামি ব্রাদারহুডের নেতা মুরসি জনগণের গনতান্ত্রিক ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন। গনতন্ত্রের বিশ্ব ফেরিওয়ালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইশারায় ২০১৩ সালের ৩রা জুলাই মুরসিকে মিসরের সেনাবাহিনী বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। আমেরিকা গনতন্ত্রের সবক নিয়ে দেশে দেশে আধিপত্য বিস্তার করছে। আমাদের জন্য বিপদের আশংকটা ওখানেই। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পরে বিরোধী দলকে আস্থায় আনতে চেষ্টা না করে দমনপীড়নের পথে অগ্রসর হয়েছে। যার পরিণাম আজকের সংকট। সরকার বুঝতে পেরেছে কিনা জানিনা, ভূরাজনৈতিক কৌশলে স্থায়ী বন্ধু ও শত্রু বলতে কিছু নেই। সবাই নিজ নিজ স্বার্থের ধান্দায় ব্যস্ত। ভারতকে আজীবন মনে রাখার মতো দিয়েও মন পাওয়া যায়নি সেই ভূরাজনৈতিক কৌশলের স্থায়ী বন্ধু ও শত্রু বলতে কিছু নেই তত্ত্ব থেকেই। চীন, রাশিয়া, আমেরিকাও যার যার স্বার্থে বন্ধুত্ব করে, আবার শত্রুতাও করে। বহি:শত্রুর মোকাবিলায় দেশের জনগণই একটি সরকারের আসল শক্তি। কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমাদের জনগণের ঐক্য, জাতীয়তাবোধ অটুট নেই, বিভক্ত হয়ে পড়েছে বা বিভক্ত করা হয়েছে কোনো দুষ্ট লোকের পরামর্শে। জনগণের অনৈক্যের সুযোগে পরাশক্তিরা ঢুকে পড়েছে। তাই এখন এতো বিপদ। প্রতিবেদক উপসংহারে লিখেছেন, "তাই এবারের নির্বাচন এক অর্থে শুধু বাংলাদেশের মাটিতে আমেরিকা-ভারত-চীন বা রাশিয়ার কূটনৈতিক লড়াই নয়, বাংলাদেশের জনগণের নিজ স্বার্থরক্ষার লড়াইও। আমরা প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরে পাবো কিনা, আমাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করার স্বাধীনতা কতোটা আমাদের হাতে থাকবে, সেটাও নির্ধারিত হবে এবারের নির্বাচনে।" সাধুর শেষ উপদেশ, এখন উচিত ঘুম থেকে জেগে ওঠা। একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা। এখানে যেকোনো দলের হারজিতের প্রশ্ন অবান্তর। জনগণের বিজয়ের প্রশ্নটাই মুখ্য। মাননীয় সেতুমন্ত্রী ইদানিং বলেছেন বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে। জনগণ তো জানে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগই শক্তিশালী। দীর্ঘ পনের বছরের দমনপীড়নে বিএনপির মাজা সোজা নেই। তবে সরকারের নেতিবাচক কাজকর্মের ফলে জনগণ বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সরকারের জন্য এখানে যে বার্তা আছে তা বুঝতে হবে। জনগণের নির্ভেজাল সমর্থনে সরকার গঠন করতে হবে। বিরোধী দলকে আস্থায় এনে পথ চলতে হবে। বিভেদ বিভাজনের পথ বর্জন করতে হবে। একমাত্র জনগণের গনতান্ত্রিক ভোটে নির্বাচিত সরকারই পারবে বাংলাদেশকে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করতে।
মিলটন সাহেবের কথাগুলো ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
শুভ কিবরিয়া আমার মনের কথাটাই লিখেছেন। চীন আমাদের বাণিজ্য বা টাকার বন্ধু। টাকার বন্ধু কখনও চিরকাল থাকে না।