ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

ব্রিকস: আশা যখন নিরাশা

শুভ কিবরিয়া
২৯ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

কী হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেটা অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়দের দম, বুদ্ধি ও শক্তিমত্তার উপর অনেকটাই নির্ভর করবে। তার উপরে নির্ভর করবে কে কীভাবে খেলতে চান সেই কৌশলের উপর। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রাও ভূমিকা রাখবেন। তবে সেখানে চীন বা ভারতের চাইতে আমেরিকান ভূমিকাই মুখ্য হয়ে উঠবে। অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়দের দলবদল বা জার্সি বদল হতে পারে। ঘাপটি মেরে থাকা অনেকেই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন। বহুপক্ষীয় সক্রিয়তা জোরদার হলে গণতন্ত্র লক্ষ্যচ্যুত হতে পারে। পক্ষগণের আপসহীন, একগুঁয়েমিতা বহু বড় বিপদের দিকে ঠেলতে পারে বাংলাদেশকে। সবচাইতে বড় বিপদের কথা নিজ নিজ পক্ষ বা দলের স্বার্থ বড় হয়ে উঠতে থাকলে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ গৌণ হয়ে উঠতে পারে

ব্রিকস (BRICS)-ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জোটে শেষ অবধি বাংলাদেশের জায়গা হলো না। ভারত, চীনের আগ্রহে ও উৎসাহে ব্রিকসে নতুন সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ জায়গা পাচ্ছে সেই হাইপ বা আওয়াজ বাংলাদেশের মধ্যে ওঠালেও জায়গা মতো ঘটেছে উল্টো ঘটনা। আসলে মুখে মুখে যাই বলুক কাজের সময় আসল কাজটা তারা করেনি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমেরিকার নাক গলানোর বিপরীতে চীন সহায়তা  করবে, এই কথা শোনা গেলেও চীন আসলে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকাই রাখে নাই।  ভারতের মোদি সরকার, বাংলাদেশকে ব্রিকসে জায়গা করে দিতে আপনজনের মতো ভূমিকা রাখবে, সেই প্রত্যাশাও হালে পানি পায় নাই। কেন পায় নাই? কারণ, বিশ্ব রাজনীতিতে বিশেষত এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়াতে চলছে রাজনীতি ও কূটনীতির নানা জটিল সমীকরণ। ভারতের বড় বাজারে চীনের যেমন বাণিজ্যিক আগ্রহ আছে, আমেরিকারও তাতে আগ্রহ কম নাই। আবার চীন-রাশিয়া দুই আমেরিকা বিরোধী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক থাকলেও, আমেরিকার বিষয়ে ভারতের নির্ভরতা ও বাস্তব প্রয়োজনও কম নয়। ফলে, খোলা চোখে ভারত, চীন, রাশিয়ার হিসাবের সরলীকরণ করা যাবে না। যার প্রমাণ মিললো ব্রিকস সম্মেলনে। সেখানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ভারতের আপত্তির কথা এখন শোনা যাচ্ছে নানান মিডিয়ায়। আমেরিকান স্যাংশনের ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে না ঢোকাতে ভারতই নাকি আপত্তি দিয়েছে। এই ব্রিকস সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে পারেন নাই। কেননা, দক্ষিণ আফ্রিকা যেখানে এই ব্রিকস সম্মেলন হয়েছে সেখানে আসলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে এরকম কথা বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পুতিন যুদ্ধাপরাধের অপরাধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় জড়িয়ে আছেন। ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে পশ্চিমারা এই বাঁধনে বেঁধে রেখেছে। ফলে ব্রিকস আদতে চীন, রাশিয়া, ভারতের প্রাধান্যযুক্ত জোট হলেও এখানে আমেরিকার ঘোস্ট পার্টনার হিসেবেই ভারত কাজ করেছে। বলা ভালো বাংলাদেশ সে কারণেই এবার বহুত আওয়াজ তুললেও ব্রিকসে সদস্য হিসেবে জায়গা পেলো না। চীন এখানে বাংলাদেশের পক্ষে শক্তভাবে কোনো অবস্থান নেয় নাই। তার আগ্রহ সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইরানের বিষয়ে। কেননা, এই দেশগুলোকে সে আমেরিকাবিমুখ করে তার দিকে ফিরিয়েছে। আর চীনের জ্বালানি চাহিদার একটা বড় নির্ভরতা হবে এই তিন দেশ। ফলে, ব্রিকসে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইরানকে সদস্য বানাতে চীন যতটা আগ্রহী বাংলাদেশের বিষয়ে সেই আগ্রহ তাদের মুখের কথাতেই থেকে গেছে। অন্যদিকে, ভারত সরাসরি আপত্তিই জানিয়েছে বাংলাদেশের ব্যাপারে। কেননা, এই জোট যাতে আমেরিকাবিরোধী জোটে পরিণত না হয়, ভারত সম্ভবত সেই মিশন নিয়েই বড় ভূমিকা রেখেছে।

চীন: নির্ভরতা কতোটুকু
দক্ষিণ এশিয়াতে চীন আস্তে আস্তে রাজনীতিতে জড়াচ্ছে, প্রকাশ্যে। অন্তত কূটনীতির আওয়াজে, তার অবস্থান টের পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অতি তৎপরতার বিষয়ে চীন প্রকাশ্যে তার বক্তব্য রেখেছে। সদ্য চলা ব্রিকস সম্মেলনেও চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে সমর্থন যুগিয়ে যাবার কথা বলেছেন। বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত সে কথা অনেকবার বলেছেন। চীনে সফর করে আসা বাংলাদেশের চীনামুখী বামপন্থি নেতা যারা সরকারের ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গী, তারাও সে কথা বলেছেন স্পষ্টভাবেই। সুতরাং একথা এখন বলা যায়, চীনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু চীনের যে রাষ্ট্রনৈতিক আচরণ সেটা মনোযোগ সহকারে বিশ্লেষণ করলে একটা কথা সুস্পষ্ট চীনের মুখ্য লক্ষ্য যতটা না রাজনীতি তার চাইতে অনেক বেশি বাণিজ্য। চীনের কূটনীতিও তাই অতিমাত্রায় বাণিজ্যমুখীন। ফলে শ্রীলঙ্কা, চীন, নেপাল কিংবা মালদ্বীপের রাজনীতির পট পরিবর্তনের দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায়, চীন তার রাজনৈতিক মিত্র বলে যাদের চিহ্নিত করেছে, বিপদের দিনে তাদের পাশে মন-প্রাণ এক করে দাঁড়ায়নি কখনো। পাকিস্তানের ইমরান খান, তার সর্বশেষ উদাহরণ। সে সেখানেও নতুন শাসকদের সঙ্গে দরকষাকষি করে তার পূর্বতন বাণিজ্য টিকিয়ে ভবিষ্যতের বাণিজ্যকে সুনিশ্চিত করার পথই বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে, চীন- ভারতের বৈরিতাও একটা ফ্যাক্টর। চীন-ভারতের বাণিজ্যযুদ্ধ যেমন সত্য তেমনি রাজনৈতিক শত্রুতাও চিহ্নিত। কাজেই বাংলাদেশের অধিকতর চীনামুখিনতা ভারতকেও খুশি করবেÑ একথা বলা যায় না। বিশেষ করে ভারতের সামরিক ও বাণিজ্য স্টাবলিশমেন্ট বাংলাদেশের চীনামুখিনতাকে কখনই সুনজরে দেখবে বলে মনে হয় না। তাই পশ্চিমাদের শত্রুতার বিপক্ষে চীনাভরসা কখনই সুখদায়ক অভিজ্ঞতা দেবে এই আশা করা যায় না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অতীতে কখনোই চীনাভরসা টেকসই হয় নাই, নির্ভরতা যোগাতে পারে  নাই।

ভারত: কতোটা আপন
২০২৪ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচন। এ নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদীদের ঠেকাতে সকল বিরোধীরা একজোট হওয়ার চেষ্টা করছেন জোটবদ্ধভাবে। ভারতের ৬০ বছরের কংগ্রেস শাসনের দ্বারা অর্জিত যে কথিত প্রগতিশীলতা তাকে প্রায় হিন্দুত্ববাদী ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি। সমাজের সকল অংশে বিশেষ করে সকল প্রতিষ্ঠানে হিন্দুত্ববাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার আদর্শিক প্রেরণায় কাজ করছে বিজেপি ও তার সকল পার্টনার। কাজেই এবারের লোকসভা নির্বাচন মূলত হিন্দুত্ববাদী আদর্শিক প্রেরণার সঙ্গে ভারতীয় পশ্চিমা গণতন্ত্রীপন্থি উদারবাদীদের একটা আদর্শিক লড়াই হতে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক স্টাবলিশমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচনে ২০১৪ সালের মতো অতীত ভূমিকায় কতোটা ফিরবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। যেখানে আমেরিকা এ ব্যাপারে একটা প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ছড়ি কার হাতে থাকবে সেটা নির্ধারণেও আমেরিকার একটা বড় ভূমিকা থাকবে। ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সামরিক বাণিজ্যের যে পাটাতন তৈরি হয়েছে চীন ও রাশিয়াকে মোকাবিলা করে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলেও ভারতের ভোটের ফলাফলে আমেরিকাকেও ভূমিকা রাখতে হবে নিজ স্বার্থেই। বিশ্বরাজনীতির বর্তমান শক্তিধর আমেরিকাকে ডিঙ্গিয়ে ভারত বাংলাদেশের  ভোটের রাজনীতিতে যেকোনো মূল্যে ২০১৪ সালের বা ২০১৮ সালের মতো সরাসরি বর্তমান সরকারের পক্ষেই ভূমিকা রাখবে এই ভরসা যারা করছেন, তারা সম্ভবত বাস্তবতা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছেন। তারা সাম্প্রতিক ব্রিকসে ভারতের ভূমিকার দিকে চোখ ফেরাতে পারেন।
কী হবে, তাহলে!

কী হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেটা অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়দের দম, বুদ্ধি ও শক্তিমত্তার উপর অনেকটাই নির্ভর করবে। তার উপরে নির্ভর করবে কে কীভাবে খেলতে চান সেই কৌশলের উপর। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রাও ভূমিকা রাখবেন। তবে সেখানে চীন বা ভারতের চাইতে আমেরিকান ভূমিকাই মুখ্য হয়ে উঠবে। অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়দের দলবদল বা জার্সি বদল হতে পারে। ঘাপটি মেরে থাকা অনেকেই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন। বহুপক্ষীয় সক্রিয়তা জোরদার হলে গণতন্ত্র লক্ষ্যচ্যুত হতে পারে। পক্ষগণের আপসহীন, একগুঁয়েমিতা বহু বড় বিপদের দিকে ঠেলতে পারে বাংলাদেশকে। সবচাইতে বড় বিপদের কথা নিজ নিজ পক্ষ বা দলের স্বার্থ বড় হয়ে উঠতে থাকলে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ গৌণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের জল-জলা, সমুদ্র আর খনিজ সম্পদে ভাগ বসাতে পারে বহুজন। আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনার দায়িত্ব চলে যেতে পারে অন্যদের কর্তৃত্বে।
তাই এবারের নির্বাচন এক অর্থে শুধু বাংলাদেশের মাটিতে আমেরিকা-ভারত-চীন বা রাশিয়ার কূটনৈতিক লড়াই নয়, বাংলাদেশের জনগণের নিজ স্বার্থরক্ষার লড়াইও। আমরা প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরে পাবো কিনা, আমাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করার স্বাধীনতা কতোটা আমাদের হাতে থাকবে, সেটাও নির্ধারিত হবে এবারের নির্বাচনে।

পুনশ্চ: একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। এক তরুণ শিষ্য সাধুকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে। ধরেন, আমি একটা স্বপ্ন দেখছি। বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে পথ হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম সামনে একটা বাঘ। আমি অন্য একটা পথ ধরলাম। দেখলাম সেখানেও একদল নেকড়ে দাঁড়িয়ে। এরপর যেদিকেই যাচ্ছি, কোনো না কোনো হিংস্র জন্তুর দেখা পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতিতে আমি কী করবো?’
সাধু মৃদু হেসে বললেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে তোমার উচিত ঘুম থেকে জেগে ওঠা।’

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status