নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
শান্তি সমাবেশ শিষ্টাচার এবং...
শামীমুল হক
১৪ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার
আসা যাক- শিষ্ট শব্দের আভিধানিক অর্থ কি? এর অর্থ ভদ্র, সুশীল, নীতিবান, শিক্ষিত, মার্জিত, অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে বিনয়ী ও ভদ্র আচরণ করা। ব্যাপক অর্থে সম্মানের আচরণ করার নামই শিষ্টাচার। এর বড় অভাব রাজনীতির অঙ্গনে। কিন্তু দেশের রাজনীতিতে শিষ্টাচারের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য একান্ত জরুরি। আগে রাজনীতিকগণ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, শত্রু ছিলেন না। এখন রাজনীতিকদের অবস্থা দেখলে মনে হয়, তাদের জন্মই হয়েছে একে অপরের শত্রুতা করার জন্য। একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য। অথচ রাজনীতির মূল উদ্দেশ্যই হলো দেশের জনগণের জন্য কাজ করা। সেটা কতোটুকু হচ্ছে? এ নিয়ে সেদিন আলোচনা হচ্ছিল। একজন বললেন, এই যে রাজনীতিকদের এত দোষারোপ করা হচ্ছে, দেশের রাজনীতিতে রাজনীতিক ক’জন আছে? সংসদে রাজনীতিক ক’জন আছে? রাজনীতির জায়গা তো দখল করে আছে ব্যবসায়ী, আমলা, গায়ক ও নায়ক
নব্বই দশকে রাজনীতির মাঠে একে অপরের প্রতি ছিল সম্মানবোধ। ছিল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। একদলের নেতা আরেক দলের নেতার সঙ্গে চায়ের আড্ডায় মেতে উঠতেন। এক গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াতেন। এমনও দেখা গেছে, এক দলের প্রধান যে আসনের প্রার্থী হয়েছেন। সে আসনে অন্য দলের প্রধান যাননি প্রচারণায়। এটা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই নিজেরা এটা করতেন। এটা যে করতে হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়মও নেই। তারপরও শীর্ষ নেতারা রাজনৈতিক শিষ্টাচার হিসেবে এটা মানতেন। সে সময়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এক দলের সঙ্গে আরেক দল কোনো বৈরিতায় যায়নি। তারা আগে- পরে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। কিন্তু রাজনীতিতে সেই শিষ্টাচার কখন যে হারিয়ে গেছে টেরই পায়নি কেউ। এখন বিএনপি কোনো কর্মসূচি দিলে বিপরীতে আওয়ামী লীগও একই সময়ে কর্মসূচি দিচ্ছে। বুধবারের কথাই ধরা যাক। নয়াপল্টনে বিএনপি জনসভা ডেকেছে। একদফা ঘোষণা করা হবে এ জনসভা থেকে- এটা আগে থেকেই বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন। সমমনা দলগুলোও আলাদা আলাদাভাবে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেবে। এটাও সবার জানা। তারপরও আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ ডেকে বসলেন। শোডাউন করলেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে। কিন্তু এ শান্তি সমাবেশ কি শান্তিতে হয়েছে? সেখানে হয়েছে নিজেদের মধ্যে চেয়ার ছুড়াছুড়ি। আর তা মিডিয়ার কল্যাণে দেখেছে দেশবাসী। আচ্ছা এই শান্তি সমাবেশ একদিন আগে কিংবা পরে করলে কি এমন ক্ষতি হতো আওয়ামী লীগের। নাকি বিএনপি একদফা ঘোষণা করবে। অতএব, তাদেরও একদফা ঘোষণা করতে হবে। যেটা তারা করেছে। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হতে হবে- এই ঘোষণা তো সব সময়ই দেয়া হচ্ছে। তাহলে বিএনপি’র সঙ্গে মিল রেখে একই তারিখে কেন করতে হবে? আর একই সঙ্গে দুটি বিশাল জনসভা রাজধানীর বুকে হওয়ায় জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। দশ মিনিটের রাস্তা পেরুতে সময় লেগেছে তিন থেকে চার ঘণ্টা। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় অন্য সড়কগুলোতে চাপ পড়েছে। ফলে দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়তে হয়েছে রাজধানীবাসীকে। শুধু তাই নয়, অনেকেই বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। আসলে কে কীভাবে নিলো তা দেখার সময় নেই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। তাদের সামনে এখন চেয়ার। যে চেয়ার ধরে রাখতে হবে। আরেক পক্ষকে সেই চেয়ারে বসতে হবে। এই চেয়ার দখল নিয়ে যা হচ্ছে দেশে তা বিদেশিদের নজরে এসেছে। আর তাইতো বিদেশিরা এখন নড়েচড়ে বসছে। একের পর এক ডেলিগেট আসছে। সরকার প্রধানসহ সরকারের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে বসছেন। কিন্তু নব্বই দশকের পর রাজনৈতিক অঙ্গন কেন কলুষিত হয়ে উঠলো? কেন প্রতিহিংসা ভর করলো? প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঘৃণ্যতম খেলায় মেতে উঠলো রাজনীতিকরা? শুধু তাই নয়, প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে যে অশোভন ভাষার ব্যবহার মাঝে মাঝে কানে আসে তা কোন ধরনের শিষ্টাচার? দেশের সাধারণ মানুষ কী রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে এ ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ি আশা করে? মোটেইও না। তাহলে কেন এমনটা করা হচ্ছে? আরেকটি প্রশ্ন- এ ধরনের কর্মকাণ্ড কি কখনো দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে? অথচ আমরা কি দেখেছি? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো শিষ্টাচারবর্জিত আচরণ করেননি। প্রতিহিংসার লেশমাত্র ছিল না তার মাঝে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, কারাগারের রোজনামচা প্রভৃতি বইয়ে এ সত্যের প্রতিফলন মেলে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক কাজী জাফরের কথা মনে পড়ছে। তিনি তখন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক। আর সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কাজী জাফর তার দেয়া এক বক্তৃতায় বলেছিলেন- এক রমজানের ঈদে মওলানা সাহেবের জন্য তিনি একটি পাঞ্জাবি উপহার নিয়ে যান। যে ধরনের পাঞ্জাবি পরতে মওলানা ভাসানী পছন্দ করেন ঠিক সে ধরনের পাঞ্জাবি। দুই জনে বসে গল্প করছেন। এক সময় কাজী জাফর উপহার তুলে দেন মওলানা সাহেবের হাতে। আর বলেন, ঈদের জামাতে যেন পাঞ্জাবিটি পরে যান। মওলানা ভাসানী তাৎক্ষণিক বলে উঠেন, জাফর তোমার দেয়া পাঞ্জাবিটা আমি বিকালে পরবো। কাজী জাফর মন খারাপ করে ফেলেন। তখন মওলানা ভাসানী বলেন, জাফর শোন, আজ দীর্ঘ দুই যুগের উপরে ঈদের জামাতে যাই ‘মুজিবরের’ দেয়া পাঞ্জাবি পরে। মুজিবর যদি জেলে থাকে তখন তার পরিবারের পক্ষ থেকে আমার জন্য পাঞ্জাবি পাঠায়। এখন কি সেই দিন আছে? সেই রাজনীতিকরা আছেন। মনে রাখা দরকার, রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ থাকবেই। তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করাও দোষের কিছু নয়। কিন্তু এর একটা সীমা থাকা উচিত। দেশ স্বাধীনের পর শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উন্নয়ন সবক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গন ও ছাত্র রাজনীতিতে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ছাত্র সংগঠনের ভয়ে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতারা যেতে ভয় পান। কিংবা কখনো কর্মসূচি নিয়ে গেলে আক্রমণের শিকার হন। এ থেকে ছাত্রীরাও রক্ষা পায় না। আমরা আসলে কি শিখছি? মূল দলের রাজনীতিকরাই যখন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অমানবিক পদক্ষেপ নিতে দেখে তখন তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতারা কি করবে?

ইতিহাস বলে, আলেকজান্ডার একবার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। তার হাতে রাজা পুরু পরাজিত হয়ে বন্দি হিসেবে তার সামনে এসেছিলেন। আলেকজান্ডার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তুমি আমার কাছ থেকে কী ধরনের আচরণ আশা করো? পুরুর সাদাসিধে জবাব ছিল, রাজার মতো। বলাবাহুল্য, বন্দি পুরুকে আলেকজান্ডার স্বাভাবিক অবস্থাতেই তার সামনে হাজির করেছিলেন, ডাণ্ডাবেড়ি বা কয়েদির পোশাক পরিয়ে নয়। এ থেকে আমরা কি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি?
তাই বলে কি শিষ্টাচার সমাজ থেকে শেষ হয়ে গেছে? না। এখনো শিষ্টাচার আছে বলে সমাজ আছে। রাজনীতি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েনি। এখনো রাজনীতি থেকে শিষ্টাচার একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। তবে এটা ঠিক, একশ্রেণির রাজনীতিকের মধ্যে শিষ্টাচার, মানবিকতা, মানুষের প্রতি সম্মানবোধ একেবারে উবে গেছে। রাজনীতিকের ছত্রছায়ায় বা অঢেল বিত্ত-বৈভবের দম্ভে অনেকে অমানুষ হয়ে সমাজে দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এরাই সাংবাদিক নাদিমকে হত্যা করে নির্দ্বিধায়। ওরা রক্তপিপাসু। প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করা ওদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
আসা যাক- শিষ্ট শব্দের আভিধানিক অর্থ কি? এর অর্থ ভদ্র, সুশীল, নীতিবান, শিক্ষিত, মার্জিত, অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে বিনয়ী ও ভদ্র আচরণ করা। ব্যাপক অর্থে সম্মানের আচরণ করার নামই শিষ্টাচার। এর বড় অভাব রাজনীতির অঙ্গনে। কিন্তু দেশের রাজনীতিতে শিষ্টাচারের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য একান্ত জরুরি। আগে রাজনীতিকগণ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, শত্রু ছিলেন না। এখন রাজনীতিকদের অবস্থা দেখলে মনে হয়, তাদের জন্মই হয়েছে একে অপরের শত্রুতা করার জন্য। একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য। অথচ রাজনীতির মূল উদ্দেশ্যই হলো দেশের জনগণের জন্য কাজ করা। সেটা কতোটুকু হচ্ছে? এ নিয়ে সেদিন আলোচনা হচ্ছিল। একজন বললেন, এই যে রাজনীতিকদের এত দোষারোপ করা হচ্ছে, দেশের রাজনীতিতে রাজনীতিক ক’জন আছে? সংসদে রাজনীতিক ক’জন আছে? রাজনীতির জায়গা তো দখল করে আছে ব্যবসায়ী, আমলা, গায়ক ও নায়ক। আসল রাজনীতিক ক’জন আছে? দেখা যায় সারাজীবন রাজনীতি করে এখন বয়স হয়েছে। তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে রাজনীতি থেকে। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে নব্য পয়সাওয়ালারা। আর সকল জায়গায় ওই নব্য পয়সাওয়ালার দাপট। সারাজীবন রাজনীতি করা রাজনীতিক তা দেখে চোখের পানি ফেলেন নীরবে। আর ওই পয়সাওয়ালার পেছনে ঘুরেন। কি করবেন? রাজনীতি যে তার রক্তে মিশে গেছে। এভাবে দিনে দিনে আসল রাজনীতিকরা ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছে। সে জায়গা দখল করছে অন্যরা। এভাবেই দূষিত হয়ে পড়ছে রাজনীতি।
এই যে এতকিছুর অবতারণা তার সবই বুধবারের দুটি জনসভাকে কেন্দ্র করে। একটি বিএনপি’র। অপরটি আওয়ামী লীগের। একই দিনে দুটি জনসভা রাজধানীবাসীকে যেমন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, তেমনি কার পক্ষে কতো মানুষ তাও প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি কর্মসূচি দিলেই বেশকিছু দিন ধরে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশের ডাক দিচ্ছে। ওই দিন সমাবেশ করে কী শান্তি বয়ে আনছে তারা- দেশবাসী জানে না। কিন্তু এটা যে অপতৎপরতা সেটা দেশবাসী ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। মনে রাখতে হবে, জনগণ এখন আর বোকা নয়। কান পাতলেই বাতাসে ঘুরে বেড়ায় জনগণের কথা।