নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
বাইডেনের কাছে কি চায় সৌদি আরব?
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১০ জুলাই ২০২৩, সোমবার
কেউ বলতে পারেন, সৌদি আরবকে এই সুবিধা দেয়া হলে তাতে ইরানের বিরুদ্ধে জোট পাকাপোক্ত হবে। ইরান হলো ইসরাইল ও সৌদি আরবের শত্রু। সৌদি আরবের যে সেনাবাহিনী আছে, তাদের শক্তির জন্য তেমন পরিচিত নয়। ফলে কোনো যুদ্ধ হলে তাদের ওপর ভরসা করতে পারে না ইসরাইল। অন্যদিকে মার্চে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সৌদি আরব। ফলে সেখানে এক তালগোল পাকানো অবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া থেকে এ জন্য সৌদি দূরত্ব বজায় রাখবে এমনটাও ভাবা সমীচীন নয়। পারস্য উপসাগরীয় অন্য দেশগুলোর মতোই বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতায় পক্ষ অবলম্বন করা এড়াতে চায় সৌদি আরব। এর অর্থ এই নয় যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ত্যাগ করছে
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সৌদি আরব। তার চেয়ে আরও বড় পরিচয় দেশটির।
এসব নিয়ে ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, মার্কিনিদের জন্য প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের উত্তর রেডি করা ছিল। তিনি এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিনিময় চান। তা হলো- অস্ত্র, নিরাপত্তা প্যাক এবং সৌদি আরবে পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা (স্বর্ণ নয়, ভালোবাসার ধাতব ইউরেনিয়াম)। একে সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে চুক্তির চেয়ে অন্যভাবে বলা যেতে পারে সৌদি আরব-আমেরিকার মধ্যকার চুক্তি।
এই চুক্তির পক্ষে যারা তারা মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন যুগের সূচনার জন্য এই মূল্য উপযোগী। সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে সৎ দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তারা বিনিময়যোগ্য নিরাপত্তা চুক্তি চায়, যেটা লেনদেনমূলক নয়। রাষ্ট্র হিসেবে প্রথম ৭২ বছরে আরবের মাত্র দুটি দেশ- মিশর ও জর্ডানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেছে ইসরাইল। ২০২০ সালের চার মাসে তারা আব্রাহাম একর্ডের মাধ্যমে আরবের আরও চারটি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা হলো- বাহরাইন, মরক্কো, সুদান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। আরব অঞ্চলে ইসরাইলের সম্পর্ককে বিস্তৃত করাকে অগ্রাধিকারে নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তার উত্তরসূরি জো বাইডেনও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন।

একসময় পছন্দনীয় কূটনৈতিক একটি গেম ছিল। তাতে অনুমান করা হতো, এর পরে কোন আরব রাষ্ট্র! এক্ষেত্রে সব সময় বড় একটি পুরস্কার হিসেবে দেখা হয় সৌদি আরবকে। কারণ, ওই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ সৌদি আরব। কূটনীতিতে সে হেভিওয়েট। তাছাড়া ইসলামের জন্মভূমি সৌদি আরব। ডিসেম্বরে ইসরাইলে ক্ষমতায় আসে উগ্রপন্থি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে যতটুকু অগ্রসর হয়েছিল, তা অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায়। প্রকাশ্যে সৌদি আরবের কর্মকর্তারা এখনো সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিষয়ে নীরব। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন চুক্তি হওয়ার মতো প্রকৃতপক্ষেই একটি সুযোগ আছে।
অন্য সূক্ষ্ম ইঙ্গিতও আছে। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যদি ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’ মেনে নেয় ইসরাইল, শুধু তখনই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে পারে সৌদি আরব। ২০০২ সালে আরব লীগ ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনা অনুমোদন দেয়। এতে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিনিময়ে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথা বলা হয়েছে।
সম্প্রতি রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান। কিন্তু সেখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। পক্ষান্তরে ফয়সাল বিন ফারহান তার বক্তব্যে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ের পরিবর্তে তিনি বলেছেন, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করা হলে তাতে সীমিত সুবিধা পাওয়া যাবে। ইসরাইলের কাছে দাবি উপস্থাপনের পরিবর্তে সৌদি আরব এখন তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরছে। তারা চায় একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা চুক্তি। যার অধীনে সৌদি আরবকে সুরক্ষা দিতে বাধ্য থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। তারা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের সহজলভ্যতা চায়। তারা আরও চায়, সৌদি আরবে একটি বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করুক। এর আওতায় সৌদি আরব তার ভেতরেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে।
আরব-ইসরাইল চুক্তিকে দৃঢ় করতে সবসময় সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭৯ সালে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের পর থেকে মিশরকে কমপক্ষে ৫০০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আব্রাহাম একর্ডের অধীনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনো তা সরবরাহ দেয়নি।
সৌদি আরব অর্থ বা অস্ত্রের চেয়েও বেশি কিছু চায়, যা পূরণ হবে বলে মনে হয় না। একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে হলে তা সিনেটে অনুমোদিত হতে হবে। যা এ সময়ে সহসা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অস্ত্র বিষয়ক চুক্তিও কংগ্রেসে এবং একই সঙ্গে উভয় দলের আইনপ্রণেতাদের অনুমোদন প্রয়োজন। তারা এসব অস্ত্র সৌদি আরবে পাঠাতে উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে পারমাণবিক কর্মসূচি হবে আরও বেশি বিতর্কিত। সৌদি আরব অনুসরণ করতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথ। তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতের সহজলভ্যতার জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে। কিন্তু নিজেদের প্রয়োজনে যদি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সক্ষমতা অর্জন করে কোনো দেশ, তাহলে তাতে আঞ্চলিকভাবে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। কারণ, এরই মধ্যে ইরান অস্ত্র তৈরিতে প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম প্রস্তুত করেছে বা করছে। ফলে ওয়াশিংটনে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয় দলই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে একমত হতে পারেন। তারা মনে করতে পারেন সৌদি আরবকে এই সুবিধা দেয়া হলে তা হবে খারাপ দৃষ্টান্ত।
এ কারণে একটি চুক্তিকে দ্রুততার সঙ্গে সামনে ঠেলে দেয়া বড় সমস্যা। পক্ষে নানা রকম যুক্তি দিতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থকরা। কেউ বলতে পারেন, সৌদি আরবকে এই সুবিধা দেয়া হলে তাতে ইরানের বিরুদ্ধে জোট পাকাপোক্ত হবে। ইরান হলো ইসরাইল ও সৌদি আরবের শত্রু। সৌদি আরবের যে সেনাবাহিনী আছে, তাদের শক্তির জন্য তেমন পরিচিত নয়। ফলে কোনো যুদ্ধ হলে তাদের ওপর ভরসা করতে পারে না ইসরাইল। অন্যদিকে মার্চে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সৌদি আরব। ফলে সেখানে এক তালগোল পাকানো অবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া থেকে এ জন্য সৌদি দূরত্ব বজায় রাখবে এমনটাও ভাবা সমীচীন নয়। পারস্য উপসাগরীয় অন্য দেশগুলোর মতোই বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতায় পক্ষ অবলম্বন করা এড়াতে চায় সৌদি আরব। এর অর্থ এই নয় যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ত্যাগ করছে। আবার তারা চীনের সঙ্গে লোভনীয় সম্পর্কও ছাড়বে না। রাশিয়ার সঙ্গে তেলের অংশীদারিত্বও ছেড়ে দেবে না।
এক্ষেত্রে আরও একটি উপযুক্ত যুক্তি হতে পারে। তা হলো, সৌদি আরব যদি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে অন্য আরব দেশগুলোকেও তাই করতে হবে। কিন্তু আলজেরিয়া, লেবানন এবং তিউনিশিয়ার মতো দেশগুলোর সম্ভবত জনমত তা উপেক্ষা করে। কুয়েত ও কাতারের আমীররা তাদের প্রতিবেশীকে অনুসরণ করবে। বহু দশক ধরে পশ্চিমা কূটনীতিকরা ইসরাইল-ফিলিস্তিন লড়াইকে আঞ্চলিক সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখে আসছেন। আরব বসন্ত এক্ষেত্রে ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে। কয়েক দশকের ইতিহাস অনেক ভয়ঙ্কর। কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা মধ্যপ্রাচ্যকে সহিংস অস্থিরতায় নিমজ্জিত করেছে। এক্ষেত্রে ইসরাইল তেমন কোনো ভূমিকা পালন করেনি।
পাঠকের মতামত
সৌদি আরব মুসলমানদের পবিত্রতম দুইটি স্থাপনা রয়েছে সত্য, কিন্তু সেই সৌদি আরব শাসন করছে রাজতন্ত্র নামক একটা শাসন ব্যবস্থা, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। তদুপরি সৌদি জণগনের জন্য যে আইন, তা রাজপরিবারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যে সালমান বিন রহমান বর্তমানে সৌদি প্রধানমন্ত্রী, সেত ঠান্ডা মাথায় সাংবাদিক খোসেগীকে হত্যার মূল পরিকল্পনা - বাস্তবায়ন কারী। সে কি ইসলাম ধর্মের অনুসারী হওয়ার যোগ্য?
মন্তব্য করুন
নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন
নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত
বেহুদা প্যাঁচাল/ অর্থমন্ত্রীর এত বুদ্ধি!
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ বাংলাদেশের অর্থ পাচার, ভারতের আনন্দবাজার, ইউরোপের কালো তালিকা
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ নির্বাচন ঘিরে একই প্রশ্ন, আমেরিকা কি ম্যানেজ হয়ে যাবে?
আন্তর্জাতিক/ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পশ্চিমাদের অবস্থান
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, সরকারের নীরবতা, অ্যাকশনে অন্যরাও?

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]