কলকাতা কথকতা
কফি হাউস যেন বিবর্ণ জলছবি
জয়ন্ত চক্রবর্তী, কলকাতা
(৩ বছর আগে) ৬ জুন ২০২২, সোমবার, ১১:৫৭ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১০:৪৫ পূর্বাহ্ন

১৪৬ বছর বয়স হয়ে গেল কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের। দীর্ঘ দেড় শতকে বিদ্রোহের আগুন দেখেছে কফি হাউস। দেখেছে প্রেমের সবুজ শ্যাওলা মাখা চেহারা, দেখেছে বিরহের দু’কুল প্লাবী বেদনা, দেখেছে বৈদগ্ধ, সৃজনধর্মিতা আবার ধ্বংসের আগুনও। ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা, তখন নাম ছিল আলবার্ট হল। ১৯৪৭-এ নাম পরিবর্তন হয়ে হয় কফি হাউস। ১৯৫৮তে কফি হাউস একবার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতেই যেন আত্মীয় বিয়োগ ব্যথায় গর্জে ওঠে বাংলা। আর ঝাঁপ বন্ধ হয়নি কফি হাউসের। ২০০৬ সালে কফি হাউস হেরিটেজ তকমা পায়। সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন, ঋত্বিক ঘটক, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, অপর্ণা সেন কার পা পড়েনি এই কফিহাউসে? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নির্মাল্য আচার্য এই কফি হাউসে বসেই তাঁদের পত্রিকা এক্ষণের পরিকল্পনা করতেন। এঁরা তো বিখ্যাত।

কত সাধারণ মানুষের পোড়া চারমিনারের টুকরো পড়ে আছে এই কফি হাউসে। ইনফিউসন মানে কালো কফি আর সিগারেটের ধোঁয়ায় রচিত হয়েছে কত পরিকল্পনার চিত্রনাট্য। করোনা পরবর্তী সময়ে কফি হাউসের সেই আড্ডাটা সত্যিই আর নেই। মঈদুল, গোয়ানিজ ডিসুজা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আজও কফি হাউসে ছোট ছোট পটে আসে কফি। সঙ্গে সেই বিখ্যাত চিকেন ওমলেট কিংবা টোস্ট। কিন্তু, সেই স্বাদ কি আর আছে? আব্দুল হয়তো নেই তার জায়গা নিয়েছে চোগা চাপকান পরা কোনও বেয়ারা, সিঁড়িতে উঠতে সিগারেট বিক্রেতা ইসমাইল আজ হয়তো ইতিহাস।

ইসমাইল এর জায়গা নিয়েছে অন্য কেউ। কিন্তু কোথায় সেই প্রাণের স্পন্দন। সাত এর দশকে ওঠা চিন এর চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান ওঠা স্লোগানের ভিত্তিভূমি ছিল এই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস। বিদ্রোহের সেই আগুন যেন কফি হাউসের মতো নেতিয়ে পড়েছে। ৭০ দশকের বিখ্যাত কবি, রক্ত মাংসের সম্পাদক গৌতম ঘোষ দস্তিদার বিয়ে করেছিলেন এই কফি হাউসে। ৯০ দশকের সেই বিয়ের ছবি আজও অনেকের মনের দেরাজে সাজানো আছে। এই রকম টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ গাঁথলে কফি হাউসকে কেন্দ্র করে বিশাল একটি মালা তৈরি হয়ে যেতে পারে।
আজও কফি হাউস আবার পোস্ট পান্ডেমিক অবস্থায় জমজমাট। কফির ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হচ্ছে বিশাল হল। চারমিনার এর কটু গন্ধে মৌ মৌ করছে আলবার্ট হল। কিন্তু, কে যেন অদৃশ্য জাদু কাঠির স্পর্শ ছুঁইয়ে প্রাণশক্তি কেড়ে নিয়েছে কফি হাউসের। সুপর্ণ কান্তি ঘোষের কথায় মান্না দের গাওয়া গানটি যেন কফি হাউসের আনাচে কানাচে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে- কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই..।