নির্বাচিত কলাম
সরল সম্ভাষণ
পিয়াজের শিক্ষা আদার বেপারীর মসলার খোঁজ
টুটুল রহমান
২১ জুন ২০২৩, বুধবার
মূল্যস্ফীতির হার ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে মানুষ জীবনযাপন করছে। পরিসংখ্যান বলছে, সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা ২০১২ সালের পর সর্বোচ্চ। প্রস্তাবিত বাজেটেও মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তিনি মানুষের কষ্ট লাঘবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
আমরা এতোটাই দুর্ভাগা যে ভালো খবর জীবনে খুব একটা নেই। সব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যদি ভালো থাকি, যদি ভালো কিছু ঘটে তার আনন্দ বলে বোঝানো যায় না। ক’দিন আগেও বিদ্যুতের কি হাহাকার চারিদিকে। ঘনঘন লোডশেডিং, অসহ্য রকমের গরম, রাজধানীতে পানির সংকট, কোথাও কোথাও গ্যাস নেই ঠিকঠাক। ঘোর অনামিশার মধ্যে আমরা হাবুডুবু খেতে লাগলাম।

৫ই জুন সন্ধ্যায় ভারতীয় পিয়াজ হিলি স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ঢোকার পর পরই মিরাকেল ঘটে যায় যেন। খবর আসতে থাকে খাতুনগঞ্জে পিয়াজের দাম ৪০ টাকা কমে গেছে। খুচরা পর্যায়ে প্রভাব পড়তে থাকে। গত কয়েকদিনে পেঁয়াজের দাম অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এমনকি গুদামের সব পিয়াজও বাইরে আসতে শুরু করেছে। আমদানির পরদিন বাজারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম ৯০ টাকায় পাইকারি কেনা পিয়াজ খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করছে ৮০ টাকা। অর্থাৎ লোকসান দিয়ে পিয়াজ বিক্রি করতে হবে।
পিয়াজের এই দরপতনে সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাহলে কি সরকার ইচ্ছে করলে ব্যবসায়ীদের অনৈতিক মুনাফা লুটে নেয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারে? সাধারণ মানুষ এই প্রশ্নই করছে। করোনা পরবর্তী নানা কারণে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি একটি। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। তবে চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিনি কেনার ঘোষণা দেয়ার পর পরই চিনির দামও কিন্তু পড়তে শুরু করেছে। পিয়াজ নিয়ে তৈরি হওয়া এই পরিস্থিতি আমাদের দারুণ এক শিক্ষা দিয়ে গেল। প্রথমত: বাজার সিন্ডিকেট দেশে আছে এটা আবারো প্রমাণ হলো। দ্বিতীয় সরকার চাইলে ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করতে পারে এবং জিনিসপত্রের দাম হাতের নাগালে আনতে পারে।
ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন সরকারের ঘনিষ্ঠজন এবং জাতীয় সংসদের বেশির ভাগ সদস্য সরাসরি না হলেও প্ররোক্ষভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ কারণেই সরকার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি করে? আরও একটি বিষয় কিন্তু এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে সরকার পড়েছিল বিশেষ করে বিদ্যুৎ নিয়ে সেখানে পিয়াজের সংকটটি সমাধা না হলে সরকার আরও বেকায়দায় পড়তো। এ কারণে বিষয়টি দ্রুত সমাধানে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ নিয়ে কথা বলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সঞ্চালন লাইনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে ভারতের ঝাড়খণ্ড থেকে আদানির ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নির্ধারিত সময়ের আগেই অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। ২৬শে জুন থেকে পায়রা তাপ কেন্দ্র পুরোপুরি উৎপাদনে গেলে সমস্যা সমাধান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই কথাগুলো বলছি এ কারণে যে, অতীত অভিজ্ঞতায় যেটা দেখা যাচ্ছে সব কিছুতেই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করতে হয়। কোনো মন্ত্রীকেই প্রধানমন্ত্রী বলার আগে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে জনগণ আজ পর্যন্ত দেখেছে। যে খবর পাচ্ছি কয়লা আনার ডলার মিলেছে। কয়লা আসছে। ১০ই জুন সকালে বাগেরহাটের রামপালেও কয়লা পৌঁছে গেছে। এটা মনে রাখতে হবে সমাধানের এই ঘটনাগুলো কখন ঘটছে? ঠিক নির্বাচনের আগমুহূর্তে। যখন বিদেশিরা নজর রাখছে। আমেরিকা ভিসা নীতি গ্রহণ করেছে। দুটি নির্বাচন বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে সরকার একটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হলে এবং সরকার আন্তরিক হলে নিত্যপণ্যের চড়াদাম নামিয়ে ফেলা সম্ভব- পিয়াজ কিন্তু আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে।
এবার একটু পিয়াজ উৎপাদনের দিকে তাকাই। কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন এবারো পিয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছে। দেশের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ পিয়াজ উৎপাদিত হয়। বাকি ৩০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। কিন্তু কৃষি অধিদপ্তর হিসাব দিচ্ছে দেশে চাহিদার চেয়ে পিয়াজ বেশি উৎপাদিত হয়। উৎপাদনের পরিমাণ ৩৫ লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, পিয়াজের উৎপাদন আরও কম। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৫ লাখ টনের কিছু বেশি পিয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, চাহিদা ২৫ লাখ টনের মতো। পিয়াজ উৎপাদন নিয়ে একেক পক্ষ একেক তথ্য দিচ্ছে। হিসাবের এই গরমিল ও সমন্বয়হীনতা সব সময়ই ছিল। অন্যদিকে ভারতীয় পিয়াজ আসার পর পণ্যটির যৌক্তিক দাম কতো হওয়া উচিত সেটাও প্রকাশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। সংস্থাটি বলছে, ভারতে গত ৩০শে মে পাইকারিতে পিয়াজের টনপ্রতি দর ছিল ১২১ ডলার। এতে কেজিপ্রতি দর পড়ে ১৩ টাকা। পিয়াজে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে পিয়াজ আমদানিতে ‘পড়তা’ (খরচসহ দাম) পড়তে পারে কেজিপ্রতি ২০ টাকার আশপাশে। এরপর যে দামে বিক্রি হবে, সেটাই মুনাফা। বাজারে যদি ৪০ টাকা কেজি দরেও ভারতীয় পিয়াজ বিক্রি করা যায়, তাহলেও আমদানিকারকরা ভালো লাভ করতে পারবেন। অর্থাৎ মুনাফার খোলস ছেড়ে এখনো বেরিয়ে আসতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। যদিও কৃষক পর্যায়ে প্রতি মণ পিয়াজ ১০০০ হাজার টাকা কমেছে।
পিয়াজের আগে আদা কিন্তু আমাদের অনেক ভুগিয়ে কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। যদিও ২৮০ টাকার নিচে আদা পাওয়া যাচ্ছে না। আদার বেপারীরা এক মাসের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। গত কয়েকদিন বাজার ঘুরে দেখতে পেলাম, আদার বেপারীরা এবার মসলা খোঁজ নিতে শুরু করেছেন। সামনে ঈদুল আজহা। স্বভাবতই মসলার চাহিদা বাড়বে। এই সুযোগে মসলার দাম চড়িয়ে মুনাফা লুটে নেয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে জিরার দাম কেজিতে বেড়েছে ১০০ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত। লবঙ্গের দাম ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে প্রতি কেজিতে। দারুচিনি, তেজপাতা ও ধনিয়ার দাম কেজিতে বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। আগেই বেড়ে যাওয়া আদা ও পিয়াজের দাম গত কয়েকদিনে আরও এক ধাপ বেড়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজার ঈদের পর থেকেই পাইকারি বাজারে বাড়তে শুরু করেছে মসলার দাম। প্রতি বছরই কোরবানির ঈদের আগে এভাবে দাম বেড়ে যায়। অন্যদিকে আমদানিকারকরা ডলারের সংকটকে দায়ী করছেন।
এদিকে মূল্যস্ফীতির হার ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে মানুষ জীবনযাপন করছে। পরিসংখ্যান বলছে, সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা ২০১২ সালের পর সর্বোচ্চ। প্রস্তাবিত বাজেটেও মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তিনি মানুষের কষ্ট লাঘবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ বাস্তবায়নে তার মন্ত্রী, বাজার সংশ্লিষ্টরা কি আন্তরিক হবেন? নাকি নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করার এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে। কেননা লক্ষ্য করছি তেল, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, আদা, পিয়াজের পর এসব মুনাফাখোরদের নজর এখন মসলার বাজারে।