নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
বেফাঁস মন্তব্য, সিইসি আসলে কি চাইছেন?
শামীমুল হক
১৫ জুন ২০২৩, বৃহস্পতিবারসাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বলেছিলেন- হরতালকারী ও মৌলবাদীরা এই ভবনের স্তম্ভ ধরে টানাটানি করায় ভবন ধসে পড়তে পারে। ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের কারণ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। এমন আরও বক্তব্য দেশের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলেও এমন বেফাঁস মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। আরেকজন দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশন গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকেও মেয়র ও দলীয় পদ হারাতে হয়েছে। এছাড়া মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী শুধু মন্ত্রিত্ব নয়, দল থেকেও তাকে বিতাড়িত হতে হয়েছে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিপক্ষ নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার, কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা দেশের রাজনীতির সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। অনেক সময় দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মাধ্যমেই কনিষ্ঠরা এসব কাজে উদ্দীপ্ত হন
কথায় বলে, বেশি কথায় দন্ত নষ্ট। বেশি খেলে পেট হয় নষ্ট। এজন্য জ্ঞানী-গুণীরা বেশি কোনো কিছু করতেই নিষেধ করেছেন। আসলে যেকোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে দায়িত্বশীলদের ভাবতে হয়। কারণ কথা একবার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলে তা আর ফেরত নেয়া যায় না। এ কথার জন্য পৃথিবীতে কতো কিছু যে হয়ে গেছে। ইতিহাস এর সাক্ষী। অথচ আমরা বিশেষ করে বাংলাদেশিরা সকল বিষয়ে পাণ্ডিত্য দেখাতে যাই। আর এতেই বাধে বিপত্তি। অথচ উন্নত দেশগুলোতে দায়িত্বশীলরা দাঁড়ি, কমাও হিসাব করে কথা বলেন। বাংলাদেশের অবশ্য মুখে যা আসে তা বলে ফেলা এবং পরবর্তীতে আবার অস্বীকার করা নিয়মে পরিণত হয়েছে। অহরহ তা ঘটছে। আর বেফাঁস মন্তব্য তো আরও একধাপ এগিয়ে। সকাল বিকাল দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ বেফাঁস মন্তব্য করে যাচ্ছেন। যেন এমন মন্তব্য করার জন্যই তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন। অতীত, বর্তমান এক তালেই চলছে। ভবিষ্যতে কী হবে কে জানে? একটু অতীতে ফিরে দেখা যাক- ২০০২ সাল। দিনটি ছিল ৯ই মে। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। একটি মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হারান আলতাফ হোসেন চৌধুরী। ছিনতাইকারীর গুলিতে বাবার কোলে থাকা ২০ মাসের নওশিন নামের এক শিশুর মৃত্যুর পর স্বজনদেরকে সান্ত্বনা জানাতে গিয়ে মন্ত্রী বলেছিলেন আল্লাহ্র মাল আল্লাহ্ নিয়ে গেছে। এ মন্তব্য বিস্ফোরক হয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিরোধীরা লুফে নেয়। সাধারণ মানুষ তার এ ধরনের বক্তব্যকে তিরস্কার করে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়।
আরেক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বলেছিলেন- হরতালকারী ও মৌলবাদীরা এই ভবনের স্তম্ভ ধরে টানাটানি করায় ভবন ধসে পড়তে পারে। ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের কারণ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। এমন আরও বক্তব্য দেশের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলেও এমন বেফাঁস মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। আরেকজন দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশন গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকেও মেয়র ও দলীয় পদ হারাতে হয়েছে। এছাড়া মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী শুধু মন্ত্রিত্ব নয়, দল থেকেও তাকে বিতাড়িত হতে হয়েছে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিপক্ষ নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার, কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা দেশের রাজনীতির সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। অনেক সময় দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মাধ্যমেই কনিষ্ঠরা এসব কাজে উদ্দীপ্ত হন। মুরাদ হাসানের ঘটনা এরই একটি প্রতিফলন। তবে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা সরকারের একটি ইতিবাচক দিক। কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বেফাঁস মন্তব্য করেই মন্ত্রিত্ব ও দলের পদ হারান।
লতিফ সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর আলম, মুরাদ হাসানের মন্তব্যের ধরন ও পরিসর ভিন্ন। কারও বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননা, কারও বিরুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে খারাপ মন্তব্যের অভিযোগ।
লতিফ সিদ্দিকী প্রকাশ্য সভায় বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। আর তিনি যা বলেছেন, তা অস্বীকার করেননি। জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তিগত কথোপকথন ফাঁস হয়ে ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মুরাদ হাসান একটি ফেসবুক লাইভে এসেই অরুচিকর মন্তব্য করেন বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই অভিনেত্রী মাহিয়া মাহির সঙ্গে মুরাদ হাসানের কথাবার্তার একটি অডিও ফাঁস হয়। এ ছাড়া আরেকটি লাইভে এসে নারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মুরাদের অশালীন মন্তব্যও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।
২০১৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলীগ জামাত নিয়ে কটূক্তি করায় লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্ব যায়। একই সঙ্গে নিজ দল আওয়ামী লীগ থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন। তাকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে দেয়া কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়, ‘আপনার এ বক্তব্য কেবল গর্হিত ও অনভিপ্রেতই নয়, বাংলাদেশ ও মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি আঘাতস্বরূপ। তা আওয়ামী লীগের নীতিবিরোধী এবং আদর্শ ও গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মন্তব্যের জেরে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক ডজন মামলা হয়। জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তার গ্রেপ্তার ও বিচার চেয়ে হরতালও ডাকে কয়েকটি ইসলামী দল। লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।
গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন। এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় গাজীপুরের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। জবাবে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ‘সুপার এডিট’- করা বলে দাবি করেন জাহাঙ্গীর আলম। এরপর জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। মেয়র পদও হারান তিনি। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। তার মা জায়েদা খাতুনকে নিয়ে মাঠে নামেন। শেষ পর্যন্ত জায়েদা খাতুন জয়ী হন।
দেশের বড় রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানা মন্তব্য করেন। যেগুলো শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও যথেষ্ট। জ্যেষ্ঠ নেতাদের এসব কথা অনেক সময় কনিষ্ঠদের উদ্দীপ্ত করে। আসলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন কথা বলা, অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। অনেক সময় এটা বলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বড়রা বললে ছোট নেতারা তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এসব প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত না করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়াটা যুক্তিযুক্ত। এমন কঠোর ব্যবস্থা লতিফ সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর আলম ও মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে যেমন নেয়া হয়েছে, তেমন নেয়া হয়েছে আলতাফ হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে। তারপরও কি বেফাঁস মন্তব্য বন্ধ হয়েছে?
তবে সোমবার সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চরমোনাই পীরের ওপর হামলা প্রসঙ্গে, উনি কি ইন্তেকাল করেছেন? এ মন্তব্য করেন। সিইসি কি উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছেন তিনিই বলতে পারবেন। তবে দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন সিইসি কি তাহলে ইন্তেকালের অপেক্ষায় ছিলেন। আর কেউ ইন্তেকাল করলেই তিনি অ্যাকশনে যেতেন? আর না হয় একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হয়ে তিনি এমন বেফাঁস মন্তব্য করতে গেলেন কেন? বর্তমান সিইসি সত্যিই খুব স্মার্ট। কথাও বলেন সুন্দর ভাষায়। তাইতো তিনি বরিশাল সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীমের ওপর হামলা ও রক্তাক্ত হওয়ার বিষয়ে বলেছেন, রক্তাক্তের ব্যাপারটি আপেক্ষিক। উনি কি ইন্তেকাল করেছেন? আমরা উনার রক্তক্ষরণ দেখিনি। আমরা শুনেছি হাতপাখার প্রার্থীকে পেছন থেকে একজন ঘুষি মেরেছে। ঘটনা জানার পর আমরা সঙ্গে সঙ্গে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ভোট কার্যক্রম ওই কারণে বাধাগ্রস্ত হয়নি। তারপরও পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, রিটার্নিং কর্মকর্তাকে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বরিশালে একজন মেয়র প্রার্থী ও তার সমর্থকদের মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে, তাহলে ভোটকে শান্তিপূর্ণ বলা যাবে কিনা- সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সিইসি এ কথা বলেন।
একটি কথা বলতেই হয়। মানুষ মাত্রই ভুল করে। আর তাই কথাবার্তা বলার সময়ও অপ্রাসঙ্গিক, ভুল বা বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেন। অথচ যা করা উচিত নয়। দায়িত্বশীলদের ভেবে-চিন্তে কথা বলতে হয়। নতুবা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে হয়। তবে কিছু মানুষ আছেন, যারা সব বিষয়ে কথা বলবেন। কথা বলতেই হবে তাকে। আর এটা করতে গিয়ে তিনি বিপাকে পড়েন। সমালোচনার মুখে পড়েন। সাধারণ মানুষের কাছে হেয় হন। এ বিষয়টি কি রাজনৈতিক নেতা কিংবা দায়িত্বশীলরা ভাবেন না? রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নিতে পারে। কয়েকটি ক্ষেত্রে নেয়াও হয়েছে। কিন্তু সিইসি’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে? তিনি তো সাংবিধানিক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আর তাই সিইসিকে ভেবে-চিন্তে কথা বলা খুবই দরকার। এমনিতেই সিইসি সহ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি বিরোধীদের সমর্থন নেই। তাদের অধীনে নির্বাচনেও যাচ্ছেন না তারা। এ অবস্থায় যদি এমন বেফাঁস মন্তব্য করা হয়, তাহলে তো বিরোধী দলগুলো সিইসি থেকে হাজার মাইল দূরে থাকবে। সিইসি কি তাহলে- সেটাই চাচ্ছেন?