ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাফ কথা

পুরো দেশকে ১৮ নম্বর রোড করা হউক

কাজল ঘোষ
১১ জুন ২০২৩, রবিবার
mzamin

কোটি কোটি টাকা খরচ করে আতশবাজির ঝলক নগরবাসী সেদিন দেখেছিল। কিন্তু ঠিক এক বছর পরেই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মন্ত্রীদের মুখে এ নিয়ে ব্যর্থতা ও অস্বস্তির নেপথ্যে কি? কী এমন ঘটলো যে তীব্র গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোডশেডিংয়ে মানুষকে নাকাল হতে হচ্ছে? কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে? এটা কি অতিমাত্রায় কুইক বিদ্যুৎ পেতে কুইক রেন্টালনির্ভর হওয়ার সুফল? যদিও সরকার নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছে জ্বালানির অভাবে এই সংকট। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এই সংকট। অথচ পত্রিকার খবর থেকেই আমরা জানতে পারি, ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানিতে যথাযথ সময়ে অর্থ ছাড় না হওয়ায় এমনটি ঘটেছে। কিন্তু যখন ছাড় হলো ততক্ষণে মানুষ বিদ্যুৎ কষ্টে হয়রান। এই অর্থ ছাড়ে দেরির কারণে দেশজুড়ে যে দুর্ভোগ চলছে তার জন্য জাববদিহি কারা করবে

 

সামাজিক মাধ্যমে প্রচুর ক্লিপিংস ঘুরে বেড়াচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের। এর বেশির ভাগই হচ্ছে তৎকালীন সময়ে লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত মানুষকে রাস্তায় নামার দৃশ্য। বিশেষত চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাট ও ঢাকার ডেমরায় মানুষ রাস্তা অবরোধ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশকে গুলি পর্যন্ত চালাতে হয়েছে। ঢাকার একজন সংসদ সদস্যকে জনতার ধাওয়ায় দৌড়ে পালাতে হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে যারা সামাজিক মাধ্যমে পুরনো খবরগুলোকে সামনে আনছেন তারা কি বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলে মনে করে তা করছেন, নাকি লোডশেডিং এভাবে বাড়তে থাকলে মানুষ আগের মতোই রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে তা বোঝাতে চাইছেন। কথা হচ্ছে, যারা মানুষকে স্বস্তি ও শান্তি দেয়ার কথা বলে ক্ষমতায় এসেছেন তাদের কাছেই প্রত্যাশা বেশি। যারা ক্ষমতার বাইরে ৩ বারের মতো তাদের কাছে নয়। বর্তমান সরকার ঠিক এক বছরেরও বেশকিছু আগে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়েছিল। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ২০শে মার্চ পায়রায় বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনকালে এই ঘোষণাটি দিয়েছিলেন। হাতিরঝিলে সে সময় সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব হয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে আতশবাজির ঝলক নগরবাসী সেদিন দেখেছিল। কিন্তু ঠিক এক বছর পরেই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মন্ত্রীদের মুখে এ নিয়ে ব্যর্থতা ও অস্বস্তির নেপথ্যে কি? কী এমন ঘটলো যে তীব্র গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোডশেডিংয়ে মানুষকে নাকাল হতে হচ্ছে? কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে? এটা কি অতিমাত্রায় কুইক বিদ্যুৎ পেতে কুইক রেন্টালনির্ভর হওয়ার সুফল? যদিও সরকার নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছে জ্বালানির অভাবে এই সংকট। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এই সংকট। অথচ পত্রিকার খবর থেকেই আমরা জানতে পারি, ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানিতে যথাযথ সময়ে অর্থ ছাড় না হওয়ায় এমনটি ঘটেছে। কিন্তু যখন ছাড় হলো ততক্ষণে মানুষ বিদ্যুৎ কষ্টে হয়রান। এই অর্থ ছাড়ে দেরির কারণে দেশজুড়ে যে দুর্ভোগ চলছে তার জন্য জাববদিহি কারা করবে? 
প্রথম থেকেই দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে সঠিক পথে হাঁটছে না। এই ধরুন, বর্তমানে ১৭০টি বিদ্যুৎ ইউনিট রয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৪৮টি বিদ্যুৎ উৎপাদনে পুরোপুরি সক্ষম। আর ৭৫টি অর্ধেক সক্ষম, ৪৭টি থমকে আছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক আর না হোক এই সকল প্রতিষ্ঠানকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হবে। এক হিসাবে দেখা গেছে পাঁচ বছরে এই সব প্রতিষ্ঠানকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে নব্বই হাজার কোটি টাকা। 

বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারা বা বন্ধ থাকা সকল প্রতিষ্ঠানকেই এই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে সরকার বাধ্য। অথচ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগাতে মানুষের ওপর বিদ্যুতে বাড়তি মূল্য চাপানো হয়েছে। আমি অর্থনীতির মানুষ নই, কিন্তু সাদামাটাভাবে এটুকু বুঝি, একটি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ দেবে না কিন্তু তাদের রাষ্ট্র বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেবে। আরও সহজ করে বললে এটা বলা যায়, একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন শ্রমিক কাজ করছে না কিন্তু মাস শেষে তাকে বেতন দেয়া হচ্ছে। আর এই বেতন দেয়া হচ্ছে যারা ভুক্তভোগী, কষ্টে আছেন সেইসব আম-জনতার দেয়া করের টাকা থেকেই। কিন্তু এই অঙ্কটা একজন থেকে যদি শতজনে উন্নীত হয় তাহলে কী দাঁড়াবে? এটাই চলছে আমাদের বিদ্যুৎ বিভাগে। এভাবেই ভুল নীতির কারণে প্রথম থেকেই একান্তই সরকারের মহল বিশেষকে সুবিধা দিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাততে সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি খাতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এই লম্বা সময়ে কুইক কুইক করে দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি বিশেষত খনিজসম্পদ অনুসন্ধানে, কয়লা উত্তোলনে মনোযোগ দেয়া হয়নি। তার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশকেই। 

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সড়ক হচ্ছে বনানীর ১৮ নম্বর। কারণ এই রোডে থাকেন সরকারের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা। একাধিক বিদ্যুৎ লাইন থাকায় এখানকার এই সড়কটিতে কখনই বিদ্যুৎ যায় না। ফলে এখানকার মানুষগুলো ভালো আছে। অনেকেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেই রাস্তার বাসিন্দা হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সংবিধান তো বলে সকল মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্র ন্যায়ানুগ আচরণ করবে। তাহলে পুরো দেশকেই ১৮ নম্বর রোডের বাসিন্দা করা হোক, এই দাবি করা কি অযৌক্তিক হবে? 
বর্তমানের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রীরা কথা বলতে শুরু করেছেন। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, লোডশেডিং পরিস্থিতি ঠিক হতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। তিনি বলেন, বেশকিছু দিন ধরে গ্রাহকরা দেখছেন যে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। জ্বালানি হিসেবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেলের জোগান দিতে কষ্ট হচ্ছিলো। এ কারণে লোডশেডিং ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে গেছে। আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, দু’সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি উন্নতি হবে, না হলে ক্ষমা করে দিয়েন। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি একদিনে এই অবস্থায় চলে গেছে তাতো নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ভুল পরিকল্পনা ও অদূরদর্শী চিন্তার মাশুল আজকের বেহালদশার জন্য দায়ী এমনটা জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন। রয়টার্স-এর প্রতিবেদন এ নিয়ে আরও শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। বিপিসি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না ডলার সংকটের কারণে। আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বিপিসি’র কাছে পাবে প্রায় ২৩ মিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে তারা জানিয়ে দিয়েছে, পাওনা টাকা পরিশোধ না করলে তারা বিপিসিকে তেল দেবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দরকারি ফার্নেস অয়েল নিয়েও সংকট রয়েছে। অপরদিকে কয়লা আমদানির অর্থ ছাড়ে দেরি হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে রমপাল ও পায়রা। এই সংকট যে কোথায় নিয়ে যাবে দেশবাসীকে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সঙ্গেই নির্ভর করছে উৎপাদনের চাকা চালু রাখা। এই লেখাটি যখন, তখনই খবর এসেছে বাগেরহাটে ২৬ হাজার ৬২০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে চীনের জাহাজ পৌঁছেছে। যা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হবে। দেখা যাক, পরিস্থিতির কতোটা উন্নতি হয়।    

বিদ্যুৎ পরিস্থিতির বেহাল চিত্র নিয়ে নানা রঙ্গ-রসিকতায় ভরপুর সামাজিক মাধ্যম। যেমন, তীব্র গরমে লোডশেডিংটা উপভোগ করতে চাইছি কিন্তু মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ এসে যন্ত্রণা করছে। প্রয়াত এবিএম মূসা টেলিভিশন টকশোতে লোডশেডিং নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, বিদ্যুৎ যায় না, বেড়াতে আসে কখনো কখনো। শহরে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্নতর হলেও গ্রামের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি চরম খারাপ।  

বাজেট নিয়ে চারপাশে নানা আলোচনা। বিশাল ঘাটতি আর ঋণনির্ভর এবারের বাজেট। বাজারের অবস্থা তো সকলেই অবগত। মূল্যস্ফীতি রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছে। এবারের বাজেট নিয়ে অর্থনীতির শিক্ষক ড. আনু মুহাম্মদ এক স্ট্যাটাসে ‘গণি মিয়া’ প্রসঙ্গ অবতারণা করে বর্তমান পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করেছেন। সেই স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য হুবহু উল্লেখ করলাম। আনু মুহাম্মদ লিখেছেন,  জনস্বার্থবিরোধী নীতি ও দুর্নীতির কারণে দেশ  যেভাবে ক্রমেই ঋণনির্ভর হচ্ছে এবং সেই ঋণের টাকায়, কমিশন দুর্নীতিতে  যেরকম শান-শওকত চলছে তাতে গণি মিয়ার কথা মনে পড়ে। ‘গণি মিয়া’ ছিলেন একজন কৃষক। তার গল্প  ছোটবেলায় আমরা অনেকেই পড়েছি। কৃষক হিসেবে তিনি  মোটামুটি ভালোই চলছিলেন। কিন্তু ভোগবিলাসের প্রতি তার বিশেষ আসক্তি ছিল। কৃষির আয় থেকে তা সম্ভব ছিল না। গল্পে আছে, তার আসক্তি এতই প্রবল ছিল যে, তিনি ঋণ করে হলেও ঘি খেতেন। ঋণের টাকা খুব সহজ, ব্যয়ের সময় গায়ে লাগে না। কিন্তু ঋণ বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে সুদও। যখন সেই ঋণ শোধ করবার সময় হলো তখনই হলো বিপত্তি। সুদসহ ঋণের টাকা শোধ করতে করতে ফতুর হলেন তিনি। ঋণ করে ঘি খেয়ে শেষে পথে বসলেন কৃষক গণি মিয়া। 
কিন্তু এই ‘গণি মিয়ার’ সঙ্গে কি সরকারের পার্থক্য নাই? গুরুতর পার্থক্য আছে। গণি মিয়া ঋণ করে নিজে ভোগ করেছেন, নিজেই তার মাশুল দিয়েছেন। কিন্তু সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যে ঋণের বোঝা তৈরি করছেন তাতে তার বা তাদের কোনো ঝুঁকি বা বিপদ নাই, মাশুলও তাদের দিতে হবে না। কতিপয় গোষ্ঠী বা সরকারের কতিপয় লোকজন সুবিধা ভোগ করবে ঠিকই। কিন্তু এই ঋণ ও তার ব্যয় সম্পর্কে জানবার বা এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেবার কোনো এখতিয়ার যাদের নাই, মাশুল দিতে হচ্ছে ও হবে সেই জনগণকেই।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status