শরীর ও মন
অল্প বয়সে সাদা চুল
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল হাই
৩ জুন ২০২৩, শনিবার‘সাদা যদি হবে ভালো, তবে চুল পাকিলে কান্দো কেন?’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি লেখায় এ কান্নার কথা ছিল। কোনো নারী ভালো, ফর্সা না কালো-এ বিতর্কে তিনি একথাগুলো বলেছিলেন। যাইহোক, আমরা সবাই গায়ের রং সাদা পছন্দ করলেও চুলের ক্ষেত্রে উল্টো।
প্রাকৃতিক নিয়মেই একটা বয়সে মানুষের চুল দাড়ি শুভ্র হয়ে যায়। ৩০ বছর পার হলে প্রতি দশকে ১০% করে চুল সাদা হতে থাকে। জঁষব ড়ভ ঞযঁসন বা সাধারণ নিয়মে বলা হয় ৫০:৫০:৫০। অর্থাৎ ৫০ বছর বয়সে ৫০ ভাগ লোকের ৫০% চুল সাদা হয়ে যায়। পুরুষের বেলায় চুল পাকা শুরু হয় মাথার দুপাশ ও জুলফি থেকে। ধীরে ধীরে সেটা মাথার কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে চুল পাকা শুরু হয় চারদিকের প্রান্তরেখা ধরে এবং কিছুটা সামনে। সুতরাং বয়স্কদের ক্ষেত্রে চুল পাকাটাই স্বাভাবিক এবং ছেলেবেলা থেকেই আমরা দাদা-দাদি বা বয়স্কদের মাথায় পাকা চুল দেখে অভ্যস্ত। এখন সেই ধারণা বদলেছে। এখন আর শুধু দাদা-দাদি মানেই পাকা চুল নয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা অতি অল্প বয়সেই মাথা ভর্তি পাকা চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তরুণদের মধ্যে অনেকেই পাকা চুল নিয়ে দুশ্চিন্তা-বিষন্নতায় ভোগেন। সমাজের চোখে কালো চুল মানেই যৌবন ও তারুণ্য এবং পাকা চুল মানেই বার্ধক্য। সামাজিক এ ধারণাগুলোই অকালে চুলে পাক ধরা রোগীদের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তোলে।
অসময়ে চুল পাকা নিয়ে নানা দেশে নানা গবেষণা হচ্ছে। মূলত আমাদের ত্বক ও চুলের গোড়ার ফলিকলে ত্বক কোষ এর পাশাপাশি বেশ কিছুসংখ্যক মেলানোসাইট নামক পিগমেন্ট কোষ থাকে। ত্বকে এই মেলানোসাইট বা পিগমেন্ট কোষের সংখ্যা প্রতি ৩৬টিতে ১টা হলেও চুলের ফলিকলে এ সংখ্যা প্রতি ৬টিতে ১টি। অর্থাৎ পিগমেন্ট কোষগুলোর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ত্বক থেকে চুলের ফলিকলে বেশিসংখ্যক থাকে এবং এর ফলে চুলের ফলিকল ক্রমাগতভাবে রং উৎপাদনে সক্ষম। চুল সাদা হয়ে যাওয়ার পেছনের আসল কারণই হচ্ছে মেলানোসাইট কোষের মেলানিন বা রং তৈরি করার ক্ষমতা হারানো।
কেন এটা ঘটে এর প্রকৃত কারণ এখনো পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে কিছু কিছু কারণ গবেষণায় উদ্ঘাটিত হয়েছে।
হ অনেকেরই জিনগত কারণে চুলে পাক ধরে। অর্থাৎ আপনার পরিবারে যদি চুল পাকার ইতিহাস থাকে, তবে এর শিকার হবেন আপনিও।
হ আপনার জীবনশৈলীর উপর অনেকটাই নির্ভর করে পাকা চুলের সমস্যা? অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত লোকজনের চুলের স্বাস্থ্য কখনোই ভালো থাকে না ।
-দুশ্চিন্তা করলেও অকালে চুল পাকে
গবেষণায় দেখা গেছে, চুল পাকার পেছনে অত্যধিক দুশ্চিন্তাই অন্যতম কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তার চুল পাকা ছিল না। কিন্তু হোয়াইট হাউসে পাঁচ বছর কাটানোর পরই তার সব চুল সাদা হয়ে যায়। এখানে Super stress বা অত্যধিক দুশ্চিন্তাকে কারণ হিসেবে দেখা হয়।
* ধূমপানের অভ্যেস থাকলে সময়ের আগে চুল পাকার ঝুঁকি দেখা দেয়।
* কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায়: ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-৬, বি-১২, বায়োটিন, ভিটামিন ডি এবং ই-এর ঘাটতি শরীরে থাকলে অসময়েই চুল সাদা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
শরীরে ক্যালশিয়াম, প্রোটিন, আয়রনের অভাব হলেও এই সমস্যা দেখা দেয়।
* অযত্ন, দূষণ এবং সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মির প্রভাবেও অকালে চুল পেকে যায়।
* অকালে চুল পাকার ক্ষেত্রে কিছু হরমোনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যাদের থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা আছে, তাদের অকালে চুল পেকে যেতে পারে।
* কিছু রোগ যেমন Pernicious Anemia, alopecia areata ইত্যাদিতে চুল অকালে পেকে যায়।
*সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন কীভাবে?
* সবার আগে চুলের যত্ন নিন।
ডায়েটে এমন খাবার যোগ করুন যাতে শরীরে যেন কোনোভাবেই ক্যালশিয়াম, আয়রন বা প্রোটিনের ঘাটতি না হয়।
পরিবারে চুল পাকার ইতিহাস থাকলে ও অন্যান্য কিছু রোগ থাকলে আগাম চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। চিকিৎসক আপনার রক্তের থাইরয়েড হরমোন, কপার, ফলিক এসিড, ভিটামিন বি ১২ এর পরীক্ষা দিতে পারেন। তার কথামতো নিয়ম মেনে চুলের যত্ন নিন।
নিয়মিত ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। শাক-সবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিম খান।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন। রোদের আলো যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। ধূমপান সম্পূর্ণভাবে বর্জন করুন। মনে রাখতে হবে সুস্থ চুল সবসময়ই সুস্থ শরীরের প্রতিচ্ছবি। অল্প বয়সে অত্যধিক পরিমাণ চুল পেকে গেলে চুল রং করতে পারেন। বর্তমান যুগে চুলে রং করাও ফ্যাশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেখা গেছে উন্নত বিশ্বে প্রতি ১০ জন পুরুষের মধ্যে ১ জন চুলের রং করেন, মহিলাদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা প্রতি ৬ জনে ১ জন। সুতরাং বিষন্নতায় না ভুগে চুল পছন্দ অনুযায়ী রাঙ্গিয়ে তুলুন- কালো, বাদামী, সোনালী অথবা অন্য যেকোনো পছন্দের রং।
মনে রাখতে হবে, চুল অনেক প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয় হলেও মানুষের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা খুবই কম। চুল মানুষের জন্য মূলত স্টাইল, ব্যক্তিত্ব ও ফ্যাশনেরই একটি অবলম্বন মাত্র। সুতরাং অকালে চুলে পাক ধরলেও চুলকে আপনার ব্যক্তিত্ব ও পছন্দ অনুযায়ী সাজিয়ে তুলুন। ভালো থাকুন।
লেখক: (চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ) জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চেম্বার: ১২, স্টেডিয়াম মার্কেট, সিলেট। ফোন: ০১৭১২-২৯১৮৮৭