ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সরল সম্ভাষণ

রাজনীতির ‘ফাউল টক’

টুটুল রহমান
১ জুন ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

এত গেল রাজনীতিবিদদের কথা। বিশ্লেষকরাও কিন্তু কম যায় না। সম্প্রতি আমেরিকা ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছে। এই ভিসা নীতির পর দেশে-বিদেশে নানা ভিডিও কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভিসা নীতিকে ‘স্যাংশন’  হিসেবে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু এটাতো স্যাংশন নয়, একটা সতর্কতা- এই কথাটা মানুষ গুগলে সার্চ করে এবং আমেরিকান দূতাবাসের ফেসবুক পেজে জানতে পারছে-এটাও এরা ভুলে গেছে। লাগামহীন ভাবে যে যার মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। নব্য রাজনীতিবিদরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল বক্তব্য নিয়ে ডলার ইনকামের আশায় চ্যানেল খুলে বসেছেন এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তার প্রমাণ মিললো তাদের যে পরিমাণ ফ্যান-ফলোয়ার মাঠের রাজনীতিতে তাদের উপস্থিতি চোখে পড়ে না। এদের লাগামছাড়া ভাইরাল বক্তব্যে রাজনীতির প্রতি মানুষ আরও বেশি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে।

এ গল্প সবার জানা।

বিজ্ঞাপন
তবুও আরেকবার বলি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে মওলানা ভাসানী মিটিং করবেন বায়তুল মোকাররমে। কিন্তু পুলিশ অনুমতি দিলো না। কিন্তু মওলানার তো মিটিং করতেই হবে। তিনি পুলিশকে বললেন, আমি মোনাজাত করবো কেবল। তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে হাত উঠালেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মোনাজাত রূপান্তরিত হলো অনলবর্ষী বক্তৃতায়। আইয়ুবের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যত ক্ষোভ ছিল সবই ছিল সেই বক্তৃতায়। ছিল পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা। স্বাধীনতাকামী বাঙালি সেই বক্তব্যের কথামালা, সুধা মোনাজাতের মধ্যদিয়ে পান করেছিলেন। এমনকি উপস্থিত পুলিশরাও সেই মোনাজাতে অংশ নিয়েছিলেন। একটু বিশৃঙ্খলা হলো, একটু উত্তেজনা দেখা দিলো না, কোনো বিষোদগার করলো না অথচ ইতিহাসের এক কালজয়ী রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেন জনতার মওলানা। 

৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু’র বক্তব্য ইতিহাসের শুধু সেরা রাজনৈতিক বক্তব্যই কেবল নয় এটি একটি রাজনৈতিক মহাকাব্য। যা বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন অভিনব শব্দ চয়নে। বাক্যের অব্যর্থ গঠনে এই মহাকাব্য হয়ে উঠেছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। কি ছিল না এই বক্তব্যে? শাসকের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বসন্তে যেমন ফুলে, সবুজ পাতায়, সৌরভে পল্লবিত হয় বৃক্ষরাজি ঠিক তেমনি এই বক্তব্য বাঙালির মনে স্বাধীনতার স্বপ্নকে উসকে দিয়েছিল। কিন্তু এই বক্তব্যে আপনি পাবেন না তিনি কাউকে বিদ্রুপ করেছেন,  হোক শাসক তবুও মানুষ হিসেবে তার মর্যাদাটুকু দিয়ে গেছেন। শোষককে সম্বোধনও করেছেন কি অমায়িকভাবে। রাজনৈতিক শিক্ষা শিবিরে এই রাজনৈতিক বক্তব্য অবশ্য পাঠ্য। 

নব্বইয়ের গণআন্দোলনে স্বৈরাচারবিরোধী বক্তব্য স্লোগান ও বক্তব্যগুলো আপনাদের স্মরণে আছে নিশ্চয়ই। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে সেই বক্তব্য বা কথাগুলোতে কোনো অশালীনতা, অভদ্রতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি কোনো আজগুবি তথ্য দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করার কোনো বক্তব্য সেগুলোতে আপনি পাবেন না। সাধারণ মানুষের মনের কথাগুলো কি দারুণ শব্দচয়নে, কৌশলে রাজনীতিবিদদের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে ভাবলে অবাক লাগে। সেই কথা শুনে মানুষ একাত্ম হয়েছে। মিছিল করেছে, মিটিং করেছে। রাজপথে রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। 

এখন রাজনৈতিক বক্তব্য শোনার জন্য আপনাকে আর পল্টনের ময়দানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। হাতের সেলফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই এই বক্তব্যগুলো আপনার শ্রবণইন্দ্রীয় ভারাক্রান্ত করে তুলবে। রাজনৈতিক দলের তো বটেই, প্রত্যেক নেতার একটি করে চ্যানেল আছে। ফেসবুক পেজ আছে।  কর্মীদেরও আছে। আছে নানান কিসিমের  রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তারাও পেজ খুলে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। এই সমস্ত রাজনৈতিক বক্তব্য, বিশ্লেষণে বিদ্রুপ বিশ্লেষণ, ভুয়া তথ্য গুজব ছড়ানো ছাড়া আর কোনো কিছুই পাবেন না। বিশেষ করে একটি নব্য দল যারা কোটা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এসেছে, এখনো নিবন্ধন পায়নি তাদের প্রত্যেকটি নেতার চ্যানেল আছে। এরা প্রতিনিয়ত বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। পথে ঘাটের বক্তব্যও আপ করছেন। কখনো লাইভে এসে বক্তব্য তুলে ধরছেন। এই বক্তব্যগুলো শুধু সারমর্মহীনই নয়, বিদ্রুপাত্মক, অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি আক্রোসে ভরা, অশালীন এবং পরিণামদর্শী। যাকে এক কথায় বলা যায় রাজনীতির ফাউল টক। 

খুব কাছের অতীতে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিলের একটি বক্তব্য নিয়ে বেশ তোড়পাড় হয়েছিল। বিএনপি জোট সরকাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তিনি ৩০শে এপ্রিল ডেড লাইন বেঁধে দিয়েছিলেন। এনিয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দিনটি পার হয়ে যাওয়ার পর অভিজ্ঞ আর বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের প্রতি মানুষ বিদ্রুপ করেছিলেন। এই কথাটি ফাউল হিসেবে চাউর হয়ে গিয়েছিল। গত বছরের ১০ই ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপির সহ-সভাপতি ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানউল্লাহ আমানের একটি বক্তব্য নিয়ে রীতিমতো তোড়পাড় শুরু হয়েছিল। তিনিও ১০ই ডিসেম্বর থেকে খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেটা তো হয়ই নি বরং মানুষ মনে করে ১০ই ডিসেম্বরে যে আন্দোলনের ফসল বিএনপি ঘরে তুলতে পারতো তাও ভেস্তে গেছে এই বক্তব্যে। প্রথম প্রথম নয়াপল্টনে সমাবেশ করা নিয়ে সরকার খুব বেশি সিরিয়াস ছিল না। কিন্তু আমানের এই বক্তব্যের পর সরকার সিরিয়াস হয়ে যায় এবং কেবল নয়াপল্টনকে কেন সরকারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন কোনো স্থানেই বিএনপি সমাবেশ করতে পারেনি। আমানের এই কথাটিও ‘ফাউল টকে’ পরিণত হয়। এইদিন নিয়ে লাইভে এসে আরও এক ফাউল টক-এর জন্ম দিয়েছিলেন নুরুল হক নুর। তিনি বললেন, দুটো প্লেন রেডি আছে। ২৭ জন তাদের লাগেজ গুছিয়ে রেখেছে। তারা যেকোনো সময়ে উড়াল দেবে। নুরের বক্তব্যের এই দুটি প্লেন ২৭ ব্যক্তির হদিস আমরা না পেলেও এটি যে ভুয়া বক্তব্য ছিল তা তিনি পরে নিজেই স্বীকার করে বলেন। ওইদিন মানুষকে উত্তেজিত করতে এমন একটি প্রসঙ্গে তিনি বক্তব্য দিয়েছিলেন। 

আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে মওলানা ভাসানী মিটিং করবেন বায়তুল মোকাররমে। কিন্তু পুলিশ অনুমতি দিলো না। কিন্তু মওলানার তো মিটিং করতেই হবে। তিনি পুলিশকে বললেন, আমি মোনাজাত করবো কেবল। তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে হাত উঠালেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মোনাজাত রূপান্তরিত হলো অনলবর্ষী বক্তৃতায়। আইয়ুবের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যত ক্ষোভ ছিল সবই ছিল সেই বক্তৃতায়। ছিল পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা। স্বাধীনতাকামী বাঙালি সেই বক্তব্যের কথামালা, সুধা মোনাজাতের মধ্যদিয়ে পান করেছিলেন। এমনকি উপস্থিত পুলিশরাও সেই মোনাজাতে অংশ নিয়েছিলেন। একটু বিশৃঙ্খলা হলো, একটু উত্তেজনা দেখা দিলো না, কোনো বিষোদ্গার করলো না অথচ ইতিহাসের এক কালজয়ী রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেন জনতার মওলানা। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু’র বক্তব্য ইতিহাসের শুধু সেরা রাজনৈতিক বক্তব্যই কেবল নয় এটি একটি রাজনৈতিক মহাকাব্য। যা বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন অভিনব শব্দ চয়নে

এত গেল রাজনীতিবিদদের কথা। বিশ্লেষকরাও কিন্তু কম যায় না। সম্প্রতি আমেরিকা ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছে। এই ভিসা নীতির পর দেশ-বিদেশে নানা ভিডিও কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভিসা নীতিকে ‘স্যাংশন’  হিসেবে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু এটাতো স্যাংশন নয়, একটা সতর্কতা এই কথাটা মানুষ গুগলে সার্চ করে এবং আমেরিকান দূতাবাসের ফেসবুক পেজে জানতে পারছে-এটাও এরা ভুলে গেছে। লাগামহীন ভাবে যে যার মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। 

নব্য রাজনীতিবিদরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল বক্তব্য নিয়ে ডলার ইনকামের আশায় চ্যানেল খুলে বসেছেন এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তার প্রমাণ মিললো তাদের যে পরিমাণ ফ্যান-ফলোয়ার মাঠের রাজনীতিতে তাদের উপস্থিতি চোখে পড়ে না। এদের লাগামছাড়া ভাইরাল বক্তব্যে রাজনীতির প্রতি মানুষ আরও বেশি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। তাদের বক্তব্য আর তথ্যের গরমিলে সচেতনদের কমেন্টস আর গালিতে ভরা এদের কমেন্টবক্স। কিন্তু যারা দায়িত্বশীল রাজনীতি করেন বিশেষ করে বিএনপি’র মতো একটি দলের কোনো ডাক সাইটের নেতার মুখ থেকে কোনো ফাউল টক মানুষ কি শুনতে চায়? না শুনতে চায় না। তাদের কাছ থেকে সঠিক ও পরিশীলিত বক্তব্য প্রত্যাশা করে। 

লেখক: সম্পাদক, অপরূপ বাংলা

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status