ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাফ কথা

বাংলাদেশের এখন গভীর অসুখ দায় কার?

কাজল ঘোষ
২৮ মে ২০২৩, রবিবার
mzamin

বর্তমানের মার্কিন এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতা এতটাই বিস্তৃত যে, লোম বাছতে গিয়েই না কম্বল উজাড় হয়ে যায়। আর বর্তমানের এই অপমানকর পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী রাজনীতিকরাই। এই ভিসা নীতি ঘোষণায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি চরম সংকট এবং লজ্জাষ্কর বিষয়। এ নিয়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এক টেবিলে বসতে পারেনি। এই লেখাটি যখন লিখছি তখনো পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও প্রস্তাব আসেনি আসুন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সুরাহা আমরাই করি। সকলে মিলে একটি অবাধ নির্বাচন আয়োজনে কাজ করি। নির্বাচন, দেশ পরিচালনা, স্বাধীন বিদেশ নীতি অনুযায়ী বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে পথ চলার অধিকার অন্য কারও হাতে তুলে দেয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই, এই কথাটি আমাদের যারাই সরকারে আছেন বা যারা আগামীতে সরকার পরিচালনায় থাকবেন তারা কবে অনুধাবন করবেন?

নানা কারণে বাংলাদেশ দুনিয়ার সর্বত্র আলোচনায়। বিশেষত আগামী সাধারণ নির্বাচন প্রশ্নে। সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণা। ভিসা নীতি ঘোষণার পরে অনুষ্ঠিত একেবারে শেষ নির্বাচনের ফলাফলটি বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হওয়া যাবে।

বিজ্ঞাপন
গাজীপুরে ভোটের হিসাব- নিকাশ এলোমেলো করে দিয়েছে সব আলোচনা। অনেকেই বলেছেন এটা নাকি আমেরিকার ভিসা নীতির ঝড়ো হাওয়া। নির্বাচনের ঠিক আগের রাতে ব্লিনকেনের টুইট, মার্কিন পরররাষ্ট্র দপ্তরের আনুষ্ঠানিক বার্তা আর ডনাল্ড লু’র তৃতীয় মাত্রায় উপস্থিতি বদলে দিয়েছে মাঠ পরিস্থিতি। যত আলোচনাই হোক না কেন গাজীপুর অনেকগুলো রেকর্ড গড়েছে। এক. এই নির্বাচনে সরকারি দলের সকল শক্তির বিরুদ্ধে একজন জাহাঙ্গীর লড়ে প্রমাণ করলেন তৃণমূলের চাওয়াই বড়। দুই. সাধারণত দেখা যায় পিতামাতার ছেড়ে দেয়া কুরসিতে সন্তানরা আসীন হন। কিন্তু এখানে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। মা সন্তানের ছেড়ে দেয়া আসনে বসলেন। তিন. এটাও বোধকরি অনন্য এক রেকর্ড যে, মা ও ছেলের নগরপিতা হিসাবে দায়িত্বপালনের। চার. জায়েদা খাতুন যিনি একেবারেই ঘরের বাইরে বের হন না। খুব একটা জনমানুষের ভিড়ে চলফেরা নেই সেই মানুষটি ছুটলেন আমজনতার দোরগোড়ায়। পাঁচ. কোর্ট, কাছারি, দুদকের চাপের কাছেও জাহাঙ্গীর দমলেন না। এটা বোধকরি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন তাই মা’কে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে মাঠে রেখেছিলেন। সেই জেদই জিতিয়েছে জাহাঙ্গীরকে। আর তার ছায়ার কাছেই বিদায় নিতে হলো আজমত উল্লাকে। কিন্তু ঘরে ফিরে টক অব দ্য পলিটিক্স হচ্ছে, ভিসা নীতি নিয়ে মার্কিন ঘোষণা। 

ব্লিনকেনের বিবৃতিটি আবারও পড়ি। বুধবার রাতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা বিবৃতিতে তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন দিয়ে অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের ধারা ২১২(এ)(৩)(সি) (“৩সি”) এর অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছে। এ নীতির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে। বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তারা, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যরা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও এই নতুন ভিসা নীতির আওতায় পড়বেন। 

গত ৩রা মে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানায়। ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠনের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেয়া এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা- এ সকল কাজকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা হিসেবে বিবেচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, আইনশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, নাগরিক সমাজ এবং মিডিয়া-প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যারা এগিয়ে নিতে চান, তাদের সমর্থন দিতেই যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি ঘোষণা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতি ঘোষণার পর আমাদের সরকারি ও বিরোধি রাজনৈতিক পক্ষগুলো কি বলছেন। সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর টেকসই অঙ্গীকারের পাশে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্পদায়ের দৃঢ় সমর্থনকে বাংলাদেশ সরকার সর্বদাই ইতিবাচক বিবেচনা করে। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বলেছে নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা নয়। আমাদেরও এটা কথা, এই নির্বাচনে যারা বাধা দেবে, তাদের অবশ্যই প্রতিহত করা হবে। এই সরকার আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে চায়। সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা একটা কথা বারবার বলে আসছি। আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে, অবাধ সুষ্ঠুভাবে করবো। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ভিসা নীতি ঘোষণাকে বলেছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্যভাবে আয়োজন করার সকল প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য এবং একই সঙ্গে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার স্বাধীনতা ও অধিকার চর্চাকে সহিংসভাবে দমনের যে কোনো নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে অবস্থান নিয়েছে তা বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিরই সুস্পষ্ট প্রতিধ্বনি।

মার্কিন এই ভিসা নীতি জারিকে সবার জন্যই চাপ হিসেবে দেখছেন কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা। এই নিষেধাজ্ঞার আওতা বিস্তৃত। নির্বাচন, গণতন্ত্র, মত প্রকাশ এমনকি সংবাদ প্রকাশে বাধার কারণ হবে এমন যে কেউই এর আওতায় পড়বেন। একাধিক টকশো ও পত্র-পত্রিকায় বিশেষজ্ঞরা এর দায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরই চাপিয়েছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন সংঘটনে ক্রমাগত ব্যর্থতাই দেশকে আজ এমন এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা। সুতরাং এই পরিস্থিতির উত্তরণে দল-মত নির্বিশেষে সকলকেই একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। 

কথা হচ্ছে, নেতারা দেশ চালাবেন। রাজনীতি বা রাজার নীতি আমজনতার কাজ নয়। কিন্তু প্রতিটি নাগরিক মাত্রেই অধিকার রয়েছে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার। বিশ্বের বুকে আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে পথ চলার। আর নাগরিকদের সেই অধিকার ও মর্যাদাবোধ রক্ষার দায়িত্ব বর্তায় যারা দেশ পরিচালনা করবেন তাদের উপর। আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতিতে অপমানিত বোধ করেছি, হতাশা অনুভব করছি। যদিও আমি বা আমার পরিবারের কেউই এখনো যুক্তরাষ্ট্র যাইনি বা আমার পরিবারের কোনো সদস্য সে দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য নেই। কিন্তু আমার লাল-সবুজ পাসপোর্ট আমার কাছে অহঙ্কার। আমি বা আমার পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে গৌরব করি। আজ যখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে নাইজেরিয়া বা সোমালিয়ার কাতারে ফেললো তখন হতাশা বা অপমান বোধ যে কারোরই জন্যই। কিন্তু এর পেছনে দায়ী কারা? চোখ বন্ধ করেই বলা যায় রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল সর্বোপরি যারা দেশে একের পর এক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছেন, দুর্বল করে দিয়েছেন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও আমাদের নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে পারিনি। বিচারালয়কে শক্তিশালী করতে পারিনি। দেশে সুশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক দলগুলোই। না হলে নব্বইয়ের পর দুই তিনটি নির্বাচন ছাড়া সকল নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ, সকল নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ। দুঃখজনক, আমরা ভারতের মতো একজন টিএন শেষন পাইনি। যে দেশবাসীর আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। সত্যিকার মেরুদণ্ড নিয়ে প্রমাণ করেছে ইলেকশনে নির্বাচন কমিশনই সবকিছু। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের কার্যক্রম সকল মহলে প্রশংসিত। দেশের সকল রাজনৈতিক দল কেবল ক্ষমতা আর ক্ষমতা এ নিয়েই মশগুল এবং তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফলে সকল প্রতিষ্ঠানই নগ্ন দলীয়করণের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কালে কালে পুরো দেশটাই যেন একটা বড় ক্ষতে আক্রান্ত। না হলে যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক স্যাংশন জারি করার সুযোগ কি পেতো? আমরাই দূতদের বাড়ি বাড়ি ধরনা দিয়ে দেশের পররাষ্ট্র নীতিকে নতজানু করে তুলেছি। বুধবার রাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণার পরদিন সকালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি মার্কিন দূতাবাসে চলে গেলেন পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করতে। কিন্তু দিনের পর দির নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে রাজপথে বিরোধী দলের আন্দোলন, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ কীভাবে করা যায় এর আগ পর্যন্ত তিন দল এক টেবিলে বসার প্রয়োজন অনুভব করেনি। আমাদের রাজনীতিকরা এভাবেই দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনার মোড়লীকরণে সুযোগ করে দিয়ে থাকেন। আপনাদের হয়তো মনে থাকবে স্যার নিনিয়ান স্টিফেনের কথা, তারানকোর কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে চলমান সংকট নিরসনে যারা এর আগে দু’দলকে এক টেবিলে বসিয়ে আলোচনা করেছিলেন। যত দিন যাচ্ছে এর মাত্রাও বাড়ছে। বর্তমানের মার্কিন এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতা এতটাই বিস্তৃত যে, লোম বাছতে গিয়েই না কম্বল উজাড় হয়ে যায়। আর বর্তমানের এই অপমানকর পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী রাজনীতিকরাই। এই ভিসা নীতি ঘোষণায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি চরম সংকট এবং লজ্জাষ্কর বিষয়। এ নিয়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এক টেবিলে বসতে পারেনি। এই লেখাটি যখন লিখছি তখনো পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও প্রস্তাব আসেনি আসুন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সুরাহা আমরাই করি। সকলে মিলে একটি অবাধ নির্বাচন আয়োজনে কাজ করি। নির্বাচন, দেশ পরিচালনা, স্বাধীন বিদেশ নীতি অনুযায়ী বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে পথ চলার অধিকার অন্য কারও হাতে তুলে দেয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই, এই কথাটি আমাদের যারাই সরকারে আছেন বা যারা আগামীতে সরকার পরিচালনায় থাকবেন তারা কবে অনুধাবন করবেন?

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status