ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

অর্থনীতি

লাগামহীনভাবে বাড়ছে আয় বৈষম্য

এমএম মাসুদ
১৬ মে ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনাভাইরাস মহামারির বৈরী প্রভাবের পরও দেশের দারিদ্র্যের হার গত ৬ বছরে ৫.৬ শতাংশ কমেছে। এখন সার্বিক দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ। ৬ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালে এ হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ। তবে দারিদ্র্য কমার গতি কমেছে, বৈষম্যও বেড়েছে।

দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী-পুরুষে বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য, এমনকি প্রযুক্তি ব্যবহারেও বৈষম্য রয়েছে। মানুষের আয় যেভাবে বাড়ছে, তার তুলনায় ব্যয় বাড়ছে তীব্রগতিতে। ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আয় বাড়ছে না। অনেককে সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। নিম্নবিত্তের মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বিভিন্ন সরকারি সুবিধা পেলেও বাড়তি ব্যয়ের চাপে পিষ্ট মধ্যবিত্তরা। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা।

বিজ্ঞাপন
শাকসবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন। ফলে দেশে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য কমলেও আয় বৈষম্য বেড়েছে লাগামহীনভাবে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য কমে যাওয়া যেমন সুসংবাদ, আয় বৈষম্য বেড়ে যাওয়া কিন্তু একইভাবে দুঃসংবাদ। একই সঙ্গে বেড়েছে ভোগ বৈষম্য। ফলে বাংলাদেশ একটি উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সাধারণের সংকট আমলে না নিয়ে, তাদের সঙ্গে কথা না বলে শুধু দাতাদের শর্ত মেনে সামনে এগুলে বৈষম্য আরও প্রকট হবে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে ধনীদের সংখ্যা। আর ধনীর আয় যেভাবে বাড়ছে, দরিদ্রের আয় সেভাবে বাড়ছে না। এতে প্রমাণ হয় দেশের সম্পদের একটি বড় অংশ কিছু মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই করতে হলে আয় বৈষম্য কমানোর কোনো বিকল্প নেই বলে জানান তারা। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। আয় বৈষম্য অধিক থাকলে কোনো দেশ ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের দেশ হতে পারে না। তাদের মতে, যে হারে সম্পদ বাড়ছে সে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে কম। ঋণখেলাপির কাছ থেকে অর্থ আদায় না করে তাদের আরও বেশি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কৃষকরা বিদ্যুৎ না পেলেও নানা সুবিধা দেয়া হচ্ছে ধনীদের। বৈষম্যমূলক নীতির কারণে সুবিধাভোগীদের অবৈধ পুঁজি পুঞ্জীভূত হচ্ছে। তাই বাড়ছে বৈষম্য।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথএক্স’র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বিবেচনায় শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন সেখানে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়া বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আজিজ খান। প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস এক সংখ্যায় সিঙ্গাপুরের ৫০ শীর্ষ ধনীর যে তালিকা প্রকাশ করেছে তার অবস্থান সেখানে ৩৪তম। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনাভাইরাস মহামারির বৈরী প্রভাবের পরও দেশের দারিদ্র্যের হার গত ৬ বছরে ৫.৬ শতাংশ কমেছে। এখন সার্বিক দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ। ৬ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালে এ হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ। তবে দারিদ্র্য কমার গতি কমেছে, বৈষম্যও বেড়েছে। বিবিএস’র জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ। ৬ বছর আগে যা ছিল ১২.৯ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে দারিদ্র্য বেশি। গ্রামে এখন দারিদ্র্যের হার সাড়ে ২০ শতাংশ, শহরে এই হার ১৪.৭ শতাংশ। এ সময়ে বছরে গড়ে ০.৯৩ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে দারিদ্র্য কমেছে। এর আগের ৬ বছরে অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে প্রতি বছর গড়ে ১.৩ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে দারিদ্র্য কমেছিল। অর্থাৎ দারিদ্র্য কমার গতি কমে গেছে। 

অন্যদিকে মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। বিবিএস’র তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে আয় বৈষম্য পরিমাপকারী জিনি সহগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৪৯৯ পয়েন্ট। ২০১৬ সালে জিনি সহগ ছিল ০.৪৮২ পয়েন্ট। আর ২০১০ সালে ছিল ০.৪৫৮। সাধারণত ০.৫০০ হলেই একটি দেশকে উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে দিক থেকে অতি সামান্য দূরে আছে বাংলাদেশ। ফলে যারা আয়ের নিম্নসীমায় আছেন, তাদের সম্পদের পরিমাণ আগের চেয়ে আরও কমে গেছে। গরিবদের আয় বৃদ্ধির হারের তুলনায় ধনীরা অনেক বেশি হারে আয় বাড়িয়ে আরও ধনী হয়েছেন। 

উল্লেখ্য, জিনি সহগ শূন্য (০) দ্বারা সম্পূর্ণ সমতা প্রকাশ পায়। আর এ সহগ ১ হলে তা সম্পূর্ণ অসমতাকে নির্দেশ করে। আর ভোগ-সম্পর্কিত জিনি সহগ গত বছর ছিল ০.৩৩৪। 
বিবিএস’র উপাত্ত অনুযায়ী, এই সহগ ২০১৬ সালে ০.৩২৪ এবং ২০১০ সালে ০.৩২১ ছিল।  তাই দেশে আয় বৈষম্য এবং ভোগ বৈষম্য দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিবিএস’র খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাসিক গড় পারিবারিক আয় ২০২২ সালে বেড়ে ৩২ হাজার ৪২২ টাকায় পৌঁছায়। ৬ বছর আগে ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপের তুলনায় এটি প্রায় ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০১৬ সালে মাসিক গড় আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। আর ২০১০ সালে এ আয় ছিল আরও কম ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, মোট আয়ে দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষের অংশ ছিল ২১ শতাংশ আর সবেচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল ২৭ শতাংশ।
অর্থাৎ দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য বাড়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, সেটির প্রমাণ মিললো পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের জরিপেই।

বিবিএস’র ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এবং পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম দু’জনেই এই বৈষম্য বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, উন্নয়নের একপর্যায়ে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, পরে তা কমে আসে। 

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে অর্থনীতি ভালো চলেছে, দারিদ্র্য কমেছে। এটা আমাদের জন্য বিরাট অর্জন। তবে একটি বর্ধনশীল অর্থনীতিতে প্রথমদিকে বৈষম্য বাড়ে।
অন্যদিকে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর মতে, বৈষম্য খুব বাড়েনি। দশমিকের পরে একটা সংখ্যা বসেছে মাত্র। বৈষম্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে।

এদিকে ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব’র ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট-২০২২ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬.৩ শতাংশ ছিল কেবল এক শতাংশ লোকের হাতে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেকের হাতে ছিল ১৭ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ। আর অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ।

কেমন বেড়েছে আয় বৈষম্য?
রাজধানীতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে অভিযান চালাচ্ছে নিয়মিত। সম্প্রতি গুলশানে ভাসাবিতে অভিযান চালানো হয়। ভোক্তা অধিকারের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার সেই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, এবারই আমরা কাপড়ের দোকানে অভিযান চালিয়েছি। ভাসাবিতে গিয়ে আমরা দেখলাম ৮৫ হাজার টাকায় তারা একটা লেহেঙ্গা বিক্রি করছে। তারা আমাদের জানালো, এটি ইন্ডিয়া থেকে এনেছে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রেখেও কাগজ দেখিয়ে বোঝাতে পারেনি যে কতো টাকায় সেটা আমদানি করেছে। এ জন্য আমরা তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা করেছি।
সম্প্রতি তারা এক কাপড়ের দোকানে গিয়ে ২২ হাজার টাকা দামের শার্ট পেয়েছেন। থাইল্যান্ডের ওই শার্টেরও নাকি প্রচুর ক্রেতা।

একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে সোনায় মোড়ানো আইসক্রিমের ক্ষেত্রে। ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল সারিনা এনেছিল এই সোনায় মোড়ানো আইসক্রিম। গত বছরের ১৭ই জুলাই সারিনার ফেসবুক পাতায় একটি পোস্টে বলা হয়, ঢাকার সবচেয়ে দামি আইসক্রিম পাওয়া যাচ্ছে ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকায়। পোস্টের সঙ্গে কাঁচের ছোট বাটিতে সোনায় মোড়ানো আইসক্রিমের ছবিও দেয়া হয়। মুহূর্তেই পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়। হোটেল সারিনার মার্কেটিং বিভাগের সহকারী পরিচালক সৈয়দ মেহরান হোসেন তখন বলেছিলেন, ৭ দিনের মধ্যেই আমাদের ‘ওভারবুকড’ হয়ে যায়। ফলে পরে আর অর্ডার নেইনি।

গত রমজান মাসে ২০ হাজার টাকায় এক কেজি দরে সোনায় মোড়ানো জিলাপি খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। ইন্টারকন্টিনেন্টাল জানায়, আমরা এপ্রিলের শুরুতে বিশেষ এই জিলাপি বিক্রি শুরু করি। এই বিশেষ ধরনের জিলাপি কিনতে আগে থেকে যারা অর্ডার করেছিলেন, তাদের দেয়ার পর এটি ‘সোল্ড আউট’ হয়ে যায়। পুরো রমজান মাসজুড়েই এই জিলাপি বিক্রির প্রস্তুতি আমাদের ছিল। কিন্তু সেটা ৭ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। 
আইসক্রিম কেনার জন্য এক লাখ টাকা দূরে থাক, সেই জিলাপির ২০ হাজার টাকাও একসঙ্গে দেখা কাজে বুয়া নুরুন্নাহারের কাছে স্বপ্নের মতো। 

অর্থনৈতিক সংকটে অনেক দেশের যখন নাজেহাল অবস্থা, তখন বাংলাদেশে কিছু মানুষের ব্যয় নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, আমাদের দেশে যে উন্নতিটা হচ্ছে, সেটা পুঁজিবাদী ধরনের উন্নতি। এতে অল্প মানুষের উন্নতি হবে, মুনাফা পাবে। আর বেশির ভাগ মানুষ যারা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত, তারা বঞ্চিত হবে। ওই বৈষম্যটাই সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। 

অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দেশে একটা গোষ্ঠীর হাতে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ চলে গেছে এবং সে কারণেই ২০ হাজার টাকা কেজির জিলাপিও শেষ হয়ে যায় হু হু করে। এক লাখ টাকা দামের আইসক্রিমও শেষ হতে তেমন সময় লাগে না। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে কিছু মানুষের হাতে ‘ইজি মানি’ চলে এসেছে। যারা ব্যাংকের টাকা লুট করেছে তাদের হাতে অঢেল টাকা। হার্ড ওয়ার্কিং মানি দিয়ে ২০ হাজার টাকা কেজি জিলাপি কেনা সম্ভব না। 
পলিসি রিসার্র্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচাক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, আয় এবং ভোগ বৈষম্য বাড়ার পেছনে ধনীদের হাতে শহুরে ভূমির পরিমাণ বেশি। প্রতি বছর এই জমির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। তারা এই জমি ফেলে রাখছেন। ফলে কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই তাদের আয় বাড়ছে। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এইসব পণ্য ব্যবসা আবার পাইকারি ও আমদানি পর্যায়ে কিছু লোকের হাতে। ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়ার সঙ্গে তাদের আয়ও হু হু করে বাড়ছে। এ ছাড়া যারা যত ধনী তারা তত বেশি কর ফাঁকি দেয়। তাদের কাছ থেকে কর আদায় করা যাচ্ছে না। এর ফলে ধনী আরও ধনী হচ্ছে। যাদের আয় কম তাদের সম্পদে প্রবেশাধিকার সংকুচিত হচ্ছে। ফলে যারা গরিব তারা আরও গরিব হচ্ছে। এটা একটা অসম অর্থনৈতিক অগ্রগতি। তাই ট্যাক্স আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে আয় বৈষম্য কমবে। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, আয় বৃদ্ধির সঙ্গে যদি আয় বৈষম্য বেড়ে যায় তাহলে ফসলটা সমাজের উচ্চবিত্তদের হাতে চলে যায়। সাধারণ মানুষ এর সুফল পায় না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। তার মতে, জিনি সহগ ০.৫ হলে সেদেশকে উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ বলা হয়। আমাদের তো এটা প্রায় ০.৫ হয়েই গেছে। ফলে আমাদের দেশ এখন উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। 
সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের মতে, দুর্নীতির কারণে ক্রমেই বাড়ছে এই বৈষম্য। আমাদের অবশ্যই সিস্টেমের প্রতিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতির সমস্যা দূর করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের কর কাঠামোও দুর্বল।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যাদের জন্য এই আইএমএফ কর্মসূচি নেয়া হয় তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এদের মতামত না নিয়ে আইএমএফ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ আরও একটি বৈষম্যপূর্ণ দেশে পরিণত হবে। তিনি জানান, যাদের জন্য আইএমএফের ঋণ নেয়া, তাদের সঙ্গে অথবা তাদের কল্যাণে যারা চিন্তা করে সেসব প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে থেকে ৫৭০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশ বেশকিছু সংস্কারমূলক কর্মসূচি শুরু করেছে। এমনিতেই বাংলাদেশে বৈষম্য বেশি, আইএমএফের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে বৈষম্য আরও বাড়াবে। 

কেন বাড়ছে বৈষম্য: পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, রাষ্ট্রের সম্পদে সবার সমান এক্সেস না থাকার কারণেও বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন বলেন, যাদের কাছে অতিরিক্ত পুঁজি ও সম্পদ আছে তারা দ্রুত উঠে যাচ্ছে। আর যারা পারছে না তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। এই কারণে একটা বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।

যেভাবে আয় বৈষম্য কমানো সম্ভব: 
দেশের আয় বৈষম্য কমানোর জন্য অনেকেই নানা রকম পরামর্শ দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলোÑ কিছু দিন আগে এক অনুষ্ঠানে কিছু জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ছাড়াও খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী বৈষম্য বাড়ার কথা স্বীকার করে সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা সামগ্রিক দৈন্য হ্রাসের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, সর্বজনীন শিক্ষা ও ছোট উদ্যোক্তাদের সমস্যা দূর করার উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন। করোনার প্রভাবে নতুন করে যেহেতু অনেক লোক দরিদ্র হয়েছে, তাই দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন। বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যাপক সংস্কার। পাশাপাশি জরুরি হচ্ছে বৈষম্য কমাতে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। বৈষম্য বিলোপ সম্ভব হলেই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি বা প্রবৃদ্ধির সুফল প্রান্তজনের কাছে পৌঁছাবে। শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, সঠিক জায়গায় দায়বদ্ধতা সৃষ্টি ও স্বচ্ছতা প্রতিপালনের মাধ্যমে উন্নয়নের সুফল অধিকজনের কাছে পৌঁছাতে পারলেই নিশ্চিত হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status