শিক্ষাঙ্গন
মাদক সেবনের নিরাপদস্থল বিশ্ববিদ্যালয়!
মুতাছিম বিল্লাহ রিয়াদ, ইবি থেকে
(২ বছর আগে) ২৮ মে ২০২২, শনিবার, ১২:৫৭ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১:১২ অপরাহ্ন

মাদক সেবনের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। মাদকপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা এবং পুলিশের ভয় না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনে দিনে বাড়ছে মাদকসেবীদের সংখ্যা। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও বহিরগতরা মাদকের আড্ডা বসান ক্যাম্পাসে। যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে মাদকের দৌরাত্ম্যের কারণ হিসেবে প্রশাসনের নীরব ভূমিকাকেই দায়ী করছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন মহল মনে করছেন, পূর্বে মাদকপ্রাপ্তি এত সহজলভ্য ছিলো না। মাদক কেনার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো, দূরদূরান্ত থেকে সংগ্রহ করতে হতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। একটা ফোন কলেই ক্যাম্পাসে সহজেই মাদক মিলছে। কোন জটিলতা ছাড়াই তাই শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসকে বেছে নিয়েছেন নেশাদ্রব্য গ্রহণের নিরাপদস্থল হিসেবে।
সূত্র মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থী আসার পর তাদের বিভিন্ন হলের গণরুমে উঠানো হচ্ছে। তাদের নিয়ে মাদক সেবন করছে সিনিয়ররা। যাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। স্বল্পমূল্যে সহজেই মাদকপ্রাপ্তির ফলে নবীন শিক্ষার্থীরা কিছু বুঝে উঠার আগেই হয়ে উঠেছে মাদকাসক্ত। একের পর এক মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে তারা। ক্যাম্পাসে এসে তারা বিভিন্ন উপায়ে মাদকসেবী চক্রের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। মাদকাসক্তির কারণে পড়াশোনা থেকে দূরে থাকায় একাধিকবার ফেল করে বিভাগ থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। তবে একের পর এক মাদকের ঘটনা ঘটলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরব ভূমিকায় রয়েছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট অনেকের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্ধ্যা নামলেই নিয়মতি মাদকের আসর বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্রিকেট মাঠ, বঙ্গবন্ধু হলের পুকুর ঘাট, ফুটবল মাঠ, মফিজ লেক এলাকা, আবাসিকহলের ছাদে ও স্মৃতিসৌধসহ বিভিন্ন জায়গায়। শিক্ষার্থীদের কাছে ছদ্মবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মচারী ও পার্শ্ববর্তী স্থানীয়রা কৌশলে গাঁজা, মদ, ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হিরোইন প্যাথেডিনসহ বিভিন্ন রকমের মাদক সরবরাহ করে থাকেন। গত ২৫শে মে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক সরবরাহের সময় বহিরাগত আনোয়ার জোয়াদ্দার নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে ১৫০ পিস ইয়াবাসহ আটক করে ইবি থানা পুলিশ। এর আগে ২৩শে মে রাতে ক্যাম্পাসের বঙ্গবন্ধু হল পুকুর পাড় এলাকায় মাদকসেবন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের একদল শিক্ষার্থী। এসময় মাত্রাতিরিক্ত মাদকসেবনের ফলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সৈয়দ আশিকুল হক (আশিক কোরাইশি)। এরআগে আশিকের বিরুদ্ধে সিনিয়রকে মারধরের অভিযোগও রয়েছে। এদিকে গত জানুয়ারিতে মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবন করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের দস্তগির নামের আরেক শিক্ষার্থী। পরে তাকে পূনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ঈদুল ফিতরের ছুটির পর তিনি ক্যাম্পাসে ফিরে ফের মাদক গ্রহন শুরু করে বলে জানা গেছে। গত ২৫শে মে রাতে মাদক গ্রহণের ফলে তিনি আবারও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এক সিনিয়র শিক্ষার্থীকে মারতে উদ্যত হন। পরে প্রক্টরিয়াল বডির উপস্থিতিতে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
শিক্ষার্থী ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও কর্মচারীরাও মাদকে জড়িয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২১ সালের ২৪শে মে ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী শেখপাড়া বাজার থেকে ৮৯ পিস ইয়াবাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি অফিসের কর্মচারী বকুল জোয়াদ্দারকে আটক করে র্যাব। এর আগে ২০১৭ সালে ২০০ পিস ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে আটক হয় ওই কর্মচারী। এছাড়া ২০২১ সালের ১৭ই জানুয়ারি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে গণপিটুনির শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসচালক মোস্তফা কামাল। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে ৬৩ লিটার বাংলা মদসহ আটক হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী চিত্তরঞ্জন ঘোষ।
শহীদ জিয়াউর রহমান হলের মাদকাসক্ত এক আবাসিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, আমাদের এখানে গাঁজা অনেক সহজলভ্য। এখন আমরা বাবা, ডাল, ঘুমের বড়ি, বিভিন্ন সিরাপ এবং দেশের বাহিরের নামি দামি ব্রান্ড খাই। মাদক থেকে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, এখানে খুব ইনটেনশনালি মাদক সরবরাহ করা হয়। সচেতন শিক্ষার্থীদের দাবি, ক্যাম্পাসে মাদকাসক্তদের সংখ্যা বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় মেধা শূন্য হয়ে পড়বে। কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে একসময় প্রত্যেক রুমে রুমে চলবে মাদকের আসর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ড. শেলীনা নাসরিন বলেন, এটা সামাজিক অবক্ষয়। বিষয়টি নিয়ে ভিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। এ বিষয়ে দ্রুতই পদক্ষেপ নেয়া হবে। প্রক্টর ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ক্যাম্পাসে মাদক ঢোকার বিষয় নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সম্প্রতি যে মাদকব্যবসায়ী আটক হয়েছে তাকে রিমান্ডে নিয়ে চক্রটিকে শনাক্ত করা হবে। প্রভোস্টদের মাধ্যমে আবাসিক হলগুলোতে তদারকির ব্যবস্থা করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। ক্যাম্পাসে মাদক সরবরাহের সোর্সগুলো খুজে বের করার চেষ্টা করছি। ক্যাম্পাসে যেন কোনমতেই মাদক না ঢুকতে পারে সেটা নিয়ে দ্রুতই কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।