নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুই কি এই নগরীর মানুষের নিয়তি?
কাজল ঘোষ
১ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার
এক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধুর বাসায় গেলাম দেখা করতে। ঢাকায় এসেছে অনেকদিন পর। তার পরিবারের অনেক সদস্যই ধীরে ধীরে থিতু হয়েছে সিডনি আর মেলবোর্নে। বন্ধুর শাশুড়ি ঢাকার আজিমপুরের বাসিন্দা। তিনি শ্বাসকষ্টের রোগী। আজ এ ডাক্তার কাল ও ডাক্তার করে করেই কাল কাটে। তিনি একবার বেড়াতে গেলেন মেলবোর্নে ছেলের বাসায়। সেখানে যাওয়ার পর দেখেন কোনো শ্বাসকষ্ট নেই। তিনি তো অবাক! পরিবারের সদস্যরাও অবাক! দেশে ফিরলে ওনাকে যখন দেখতে যাই তখন সবিস্তার বললেন এ নিয়ে। পরিচ্ছন্নতা, ধুলো-বালি নেই যে শহরে তার গল্প শোনালেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে- তার কিছুদিন পরই ঢাকার ময়লা নামক বিষয় ওনার শরীরে প্রবেশ করে আবারও শ্বাসকষ্টের রোগীতে ফিরিয়ে নিয়েছে। আমার আরেক আত্মীয়ের মা বেড়াতে গিয়েছেন বৃটেন। তিনি সত্তর ছুঁই ছুঁই। বার্ধক্যজনিত নানান রোগ তাকে কাবু করেছে। তবু সন্তানের কাছে তাকে ছুটে যেতে হয় বছরে একবার। টিকাটুলীর বাসিন্দা এই মানুষটি নানা কাজে রাস্তায় বের হলে আতঙ্কে থাকেন। পথে হাঁটার মতো কোনো উপায় নেই। পুরো রাস্তা যেন বাজার। বেপেরোয়া গাড়ি চলাচল, কোথাও ম্যানহোলের ঢাকনা নেই, রাস্তায় গর্ত, কোথাও ময়লার স্তূপ। এই শহরে জীবন কাটানো এই মানুষটির আক্ষেপ বিকাল সন্ধ্যায় কোথাও দু’ দণ্ড শান্তি নেই। কোথাও একটু হাঁফ ছেড়ে বসা যায় না। সারাক্ষণ আতঙ্ক নিয়েই বাস করেন। দিনের কিছু সময় পর টেলিভিশনে স্ক্রল দেখেন এই শহরে কি হচ্ছে? একের পর এক বিপর্যয়। কোথাও আগুন লেগেছে। কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা, কোথাও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। এই আতঙ্ক থেকে যখনই তিনি বৃটেন যান স্বস্তি পান। দেশে ফিরে গল্প করেন আর আক্ষেপ নিয়ে বলেন, এতটুকু শান্তিতে বসবাসের ব্যবস্থা কেন আমাদের এখানে এখনও করা যায়নি? আমার নিজের বাবাও ছিলেন শ্বাসকষ্টের রোগী। শেষবেলায় সিওপিডি আক্রান্ত ছিলেন। নানান ওষুধে ওষুধেও তিনি তীব্র শ্বসকষ্ট নামক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হননি। তিনি কি ভীষণ রকমের কষ্ট করেছেন তা নীরবে সয়েছি।

একসময় ঢাকার ফুসফুস বলে পরিচিত স্থানগুলো ঘুরে দেখলেই স্পষ্ট হওয়া যাবে কি ধরনের দূষণ আমাদের গ্রাস করছে। ঢাকা বিশ্ববদ্যালয় এলাকা একসময় ছিল সবুজ চাদরে ঢাকা। এখন সব গাছপালা কেটে সেখানে বড় বড় ভবন নির্মাণের মহোৎসব চলছে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে ছোটবেলায় হাঁটতে গেলে মনে হতো পথ হারিয়ে যাবো? এখন এখানে নানান নির্মাণকাজের ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলুপ্তপ্রায়। রমনাতে বসন্তের ফুল দেখতে গিয়েছিলাম ক’দিন আগে। যে পরিসাণ ফুল গাছ লাগানো হয়েছিল নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার সময় তার অধিকাংশই এখন ধ্বংস প্রায়। কথা বলেছিলাম এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, নানান গাছ লাগাবার প্রস্তাব দেয়া আছে সরকারি দপ্তরে। আন্তরিকতা নিয়ে কাজগুলো করবে সেই মানুষের বড্ড অভাব। তীব্র হতাশা নিয়ে রমনা থেকে ফিরে আসি। নতুন বিতর্ক হচ্ছে নদীকে ছোট করা নিয়ে। যমুনা নদী ছোট করার একটি পরিকল্পনা হয়েছে। আমি অতশত বুঝি না, তবে এটুকু বুঝি প্রকৃতিকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে না দিলে ধ্বংষ অনিবার্য। ন্যাচারাল ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ধ্বংসের সঙ্গে রাষ্ট্র যুক্ত। সেখানকার রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। কি দুর্ভাগ্য আমাদের, যারা দেশ চালান তাদের অনেকেই বিকল্প সুন্দরবন পর্যন্ত গড়ে তোলার কথা বলেছেন। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি বন কীভাবে তৈরি হতে পারে- এটি বোধগম্য নয়। কিন্তু এতসব মানবতের যন্ত্রণা থেকে কি আমাদের পরিত্রাণ আছে? প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে যে ধরনের দূষণের শিকার হচ্ছি তাতে ভেতরে ভেতরে অকাল ক্ষয় আমাদের গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বব্যাংকের একটি সার্ভে রিপোর্ট আমাদের সামনে নতুন উদ্বেগ নিয়ে এসেছে। কিন্তু এটা তো আজকের ঘটনা নয়? এটি ঢাকা নগরীতে ঘটছে দশকে দশকে। ব্যক্তিগত দু’টি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বলি। একটি ভুটান ও অপরটি চীনের খুনমিং। বিশেষ করে ভুটানের কথা বলতেই হবে। সেখানে দেখেছি সরকার তার মোট আয়তনের ৬৫ শতাংশ রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করেছে। যেখানে কোনো ধরনের বন ধ্বংসের কর্মসূচি নেই। শহরের বায়ুকে স্বচ্ছ ও দূষণ মুক্ত রাখতে একেকদিন একেক নাম্বার প্লেটের গাড়ি চালাবার অনুমতি রয়েছে। যেমন, শনিবার যদি এ-সিরিয়াল চলে তবে রোববার বি-সিরিয়ালের গাড়ি চলবে। এতে করে শহরে গাড়ি চলাচলের মাত্রাও অনেক কম থাকে। অন্যদিকে পরিবেশও দূষণমুক্ত থাকে। খুনমিং শহরকে বলা হয়ে থাকে ফুলের শহর। পুরো শহরজুড়ে ফুলের বাগান করা হয়েছে সর্বত্র। খুনমিং ও এর বাইরে যেখানেই বেড়াতে গেছি শুধু চারপাশে নানান বাহারি ফুলে সাজানো। বিস্তৃতভাবে না দেখলেও যতটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে তাতে এই নগরীর প্রশাসকদের পরিবেশ-বান্ধব মনে হয়েছে। ভুটানের থিম্পু বা চীনের খুনমিং-এর তুলনায় যদি নাও যাই তবু ঢাকা নগরীর মানুষতো ফুটপাথ পায় না হাঁটতে। অফিসফেরত কেউ যদি মনে করেন হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরবেন তাহলে তারজন্য ব্যাপক দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা সঙ্গী করেই ফিরতে হয়। হালে বেশির ভাগ ফুটপাথে হকারদের পাশাপাশি দখল নিয়ে নেয় মোটরসাইকচালক বা বাইকাররা।
বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত ১০টি শহরের ৯টির অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। এর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। বাংলাদেশে অকাল মৃত্যুর ২০ শতাংশের জন্য বায়ুদূষণ দায়ী। বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলে ব্যয়সাশ্রয়ী উদ্যোগের মাধ্যমে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ এবং সমন্বিত নীতি সহায়তা। বিশ্বব্যাংকের এই সমীক্ষাটি প্রকাশিত হয়েছে ২৭শে মার্চ সোমবার। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ এবং জনস্বাস্থ্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্র অঞ্চলে কিছু সূক্ষ্ম কণা, যেমন কাচ এবং ছোট ধূলিকণার ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি বছর আনুমানিক ২০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটায়। এ ধরনের চরম বায়ুদূষণের সংস্পর্শে শিশুদের মধ্যে খর্বাকৃতি এবং মেধার দুর্বল বিকাশ থেকে শুরু করে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রভাব দেখা দেয়। এর ফলে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধিসহ দেশের উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং কর্মঘণ্টা নষ্ট করে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেখ উল্লেখ করেন, বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর এর বড় প্রভাব রয়েছে। সঠিক পদক্ষেপ এবং নীতির মাধ্যমে বায়ুদূষণ মোকাবিলা করা সম্ভব। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার অনুমোদনসহ বায়ুর মান ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। শক্তিশালী জাতীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি, বায়ুদূষণ রোধে আন্তঃসীমান্ত উদ্যোগ নিতে হবে। বায়ুর সঙ্গে দূষিত কণা দেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে অন্য দেশেও বিস্তার লাভ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় এ রকম ছয়টি প্রধান এয়ারশেড চিহ্নিত করা হয়েছে। ইন্দো গাঙ্গেয় সমভূমিতে বিস্তৃত এয়ারশেড বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানজুড়ে বিস্তৃৃত। প্রতিটি এয়ারশেডের কণা বিভিন্ন উৎস এবং অবস্থান থেকে আসে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা, কাঠমান্ডু এবং কলম্বোর মতো অনেক শহরে, শুধু এক-তৃতীয়াংশ বায়ুদূষণ শহরের মধ্যে উৎপন্ন হয়। বায়ুদূষণের আন্তঃসীমান্ত প্রকৃতিকে স্বীকৃতি দিয়ে, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান প্রথমবারের মতো ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি এবং হিমালয়ের পাদদেশে বায়ুর গুণমান উন্নত করার জন্য কাঠমান্ডু রোডম্যাপ তৈরি করতে একমত হয়েছে। বাংলাদেশ বায়ুদূষণের প্রভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালে দেশে বায়ুদূষণের প্রভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। দেশে বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এরপরই অবস্থান বরিশাল বিভাগের।
গত রোববার বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত বায়ুদূষণের নতুন তথ্য-প্রমাণ এবং স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব শিরোনামে প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এর আগে বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাং এক প্রতিবেদনে বলেছেন বায়ুদূষণে বছরে ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সে সময় প্রকাশিত প্রতিবেদনে মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি বেশকিছু সম্পদনাশের কথাও বলা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রভাবে যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তার আর্থিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশের সমান। যে অঞ্চলে বায়ুদূষণ বেশি সেখানে বিষণ্নতায় ভোগার সংখ্যাও বেশি। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি বিষণ্নতায় ভুগছেন ৬৫ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সীরা। সামগ্রিকভাবে দেশের বায়ুদূষণযুক্ত এলাকার ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ নারী এবং ১১ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যায়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের ভেতরে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে প্রথমে আছে ঢাকা। ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার বরিশাল বিভাগ। অন্যদিকে সিলেট বিভাগে বায়ুদূষণ অপেক্ষাকৃত কম। এসব সমীক্ষা ছাড়াও গত তিনমাসে একাধিক প্রতিবেদনে ঢাকা নগরীর দূষণে শীর্ষস্থান অর্জনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই নগরীকে সমন্বিতভাবে রক্ষায় এগিয়ে না এলে জীবন বিপন্ন হবে। একদিকে অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল, যেখানে-সেখানে ময়লার ভাগাড়, খাল-নালা দখল করে বাড়ি-ঘর নির্মাণ, ব্যাপক হারে বৃক্ষ নিধন করে পার্কে বা খোলা জায়গায় হোটেল নির্মাণ আরও দূষণের জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানুষের লোভের কাছে সবই অসহায়। এই খাই খাই থেকে যতদিন না মানুষ বের হতে পারবে ততদিন এই দূষণের শীর্ষস্থান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন।