ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

মেধাবীরা কেন বিদেশমুখী

মনির হোসেন
১ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার
mzamin

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। ঠিক কতো শিক্ষার্থী বিদেশে যান তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। দূতাবাসগুলোতেও এর সঠিক পরিসংখ্যান  পাওয়া দুষ্কর। তবে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার (ইউনেস্কো) ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য গিয়েছেন। যারা বিদেশে পাড়ি জমান তাদের বেশির ভাগই ডিগ্রি শেষে দেশে ফেরেন না। এরা বিভিন্ন দেশে স্থায়ী হতে চান। জনগণের টাকায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর কেনো বিদেশে চলে যাচ্ছেন মেধাবীরা তার সঠিক কোনো গবেষণাও নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য যাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত জব সিকিউরিটি, সোশ্যাল ডিমান্ড, ইকোনমিক্যাল স্টাবিলিটিসহ বেশকিছু কারণে তারা দেশ ছাড়েন। আর ডিগ্রি গ্রহণের পর দেশে না ফেরার কারণ হচ্ছে, দেশে যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়া। কারণ একজন ডিগ্রিধারী দেশে ফিরে তার এক্সপেক্টেশন অনুযায়ী চাকরি পান না।

বিজ্ঞাপন
পেলেও যথাযথ মূল্যায়ন পান না। তাই তারা দেশে ফিরতে আগ্রহী নন। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে গ্লোবাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মধ্যে থাকতে হবে। কেউ বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে তাতে দেশেরই লাভ। আবার তাদের কীভাবে দেশে কাজে লাগানো যায় তাও ভাবতে হবে। তাহলে দেশের ইকোনমিসহ সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি সম্ভব। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে।  

সম্প্রতি ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দেয়া ৪৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ সংযুক্ত আরব আমিরাত গিয়েছেন ১১ হাজার ১৫৭ জন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ৮ হাজার ৬৬৫ জন, মালেয়শিয়ায় ৬ হাজার ১৮০ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৫ হাজার ৬৪৭  জন, কানাডায় ৫ হাজার ১৩৬ জন, জার্মানিতে ৩ হাজার ৯৩০ জন, যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৯৪ জন, জাপানে ২ হাজার ৮০২ জন, ভারতে ২ হাজার ৭৫০ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ১৭৬ জন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি।

যুক্তরাজ্যের টিসাইড ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত এইচ এম ইমরান হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, আমাদের সোশ্যাল কাইটেরিয়া হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ছে মানে তাকে বিসিএস বা প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি পেতে হবে। কিন্তু চাইলেই সবাই সরকারি চাকরি পায় না। অনেকের আবার এর প্রতি আগ্রহও নেই। অন্যদিকে প্রাইভেট সেক্টরে জব সিকিউরিটি নেই। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমান। তাছাড়া লাইফ সিকিউরিটি বলতে একটি বিষয়তো থাকে। ডেভেলপড্‌ কোনো কান্ট্রিতে সেটেল্ড হতে পারলে পরবর্তী প্রজন্ম সিকিউরড একটা লাইফ লিড করবে- এমনটাও ধারণা অনেকের। দেশে ফেরত না আসার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশে ফিরলে একজন শিক্ষার্থীর যে মেধা রয়েছে তার সঠিক ইউটিলাইজ করার সুযোগ কম। পক্ষান্তরে বিদেশে সেটেল্ড হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে পারা আমি মনে করি দোষের না। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে বলেই রেমিট্যান্স পাঠায়। উচ্চ শিক্ষা শেষে বিদেশে ভালো একটি জব করে রেমিট্যান্স পাঠানো দেশের অর্থনীতির জন্য বেশি কার্যকর বলে মনে করি। 

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি ব্লুমিংটনের পিএইচডি গবেষক সোহানা ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, মেধাবীদের দেশ ছাড়ার অন্যতম কারণ টক্সিক সোশ্যাল কমিউনিটি। একজন মেয়ে হয়ে আমি দেখেছি গ্রাম থেকে শহরে সব জায়গায় পরিবেশটা টক্সিক করে রাখা হয়েছে। সবার কাছে বিয়ে সরকারি চাকরি মুখ্য বিষয়। তাই আমি এসব স্টিগমা থেকে বের হতে চেয়েছি। এ ছাড়া জব সিকিউরিটি, জীবনমান, আশপাশের পরিবেশসহ মৌলিক বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। আমাদের সোশ্যাল স্ট্রাকচার, জব কালচার, ইকোনমিক কালচার সব অসহনীয় হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমাদের সামাজিক স্ট্রাকচারে সাকসেস বলতে কেবল বিসিএস বা প্রথম শ্রেণির জবকে বুঝায়। সেখানে অন্যান্য জবও যে আইডল হতে পারে তা কেউ মানতে চায় না। এমনকি সেটা বোঝানোও মুশকিল। এর কিছু বাস্তবতাও রয়েছে। প্রাইভেট সেক্টরে জব সিকিউরিটি কিংবা ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটির যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে। আর যখন কারও পরিবেশ এ রকম টক্সিক হয়ে যায় তখন সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, তরুণদের কর্মের স্বাধীনতাও থাকা উচিত। বিসিএস ক্যাডার কিংবা প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি করেও সবাই সুখী না- এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। আর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর দেশে না ফেরার কারণ হচ্ছে দেশে ফিরে যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়া। দেশে ফিরলে অবিজ্ঞতা অনুযায়ী একটি চাকরি পাওয়া কঠিন। তাই দেশে ফিরতে চায় না অনেকে। 

সাউথ কোরিয়ার আজু ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত মীর লোকমান মানবজমিনকে বলেন, আর্থ-সামাজিক কারণে মেধাবীরা দেশ ছাড়ছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সব প্রেক্ষাপটই এর সঙ্গে যুক্ত। যারা দেশ ছাড়ছেন তারা এসব ক্ষেত্রে নিজেদের ইনসিকিউরড মনে করেন। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন বলেই দেশ ছাড়ছেন। তিনি বলেন, আমাদের মেধাবীরা দেশকে অনেক কিছু দিতে চায়। কিন্তু উচ্চ শিক্ষা শেষে দেশে ফেরার আগে ভাবে সেখানে সে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সিকিউরড থাকতে পারবে কি-না। বাস্তবতা হচ্ছে দেশে ফিরলে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র পায় না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মানবজমিনকে বলেন, আমরা এখন বিশ্বপল্লীতে বসবাস করছি। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে যায়। সেখানে তারা পড়ালেখা করে। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণাগারে কাজ করবে- এটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের। কিন্তু একই সঙ্গে এসব মেধাবীদের কীভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি তাও ভাবতে হবে। মেধাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। এখন হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির যুগ। এখন চাইলে আমরা বিভিন্নভাবে মেধাবীদের কাজে লাগাতে পারি। প্রযুক্তির সাহায্যে বিদেশে থেকেও তারা চাইলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়া কিংবা গবেষণায় সম্পৃক্ত হতে পারে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে তাদের সেভাবে যেন আমরা মূল্যায়ন করতে পারি। সব মিলিয়ে আমাদের গ্লোবাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মধ্যে থাকতে হবে। এখন এটা বলার সুযোগ নেই যে কেউ দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে বিদেশে চলে যাচ্ছে আর তাতে দেশের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। বরং তাদের দক্ষ করে পাঠাতে পারলে দেশের ইকোনমিসহ সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন সম্ভব। এবং বিষয়টিকে এভাবেই দেখা উচিত বলে মনে করি। 
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status