ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

নূরে আলম সিদ্দিকী’র ‘আমার গেছে যেদিন’...

কাজল ঘোষ
৩০ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার

সময়টা ১৯৭৪। পার্লামেন্ট অধিবেশন চলছে। তুমুল হইচই তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুল মান্নানকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধু সংসদ নেতার আসনে বসে সবকিছু দেখছেন  হইচইয়ের মধ্যেই সংসদে প্রবেশ করেন এক তরুণ সংসদ সদস্য। ডাকসাইটে ছাত্রনেতা। তিনি বুকে হাত চেপে সংসদে প্রবেশ করছেন। বঙ্গবন্ধু দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে সংসদ সদস্যের নাম ধরে বললেন, কি হয়েছে তোমার বুকে? নিজের আসনে দাঁড়িয়ে তরুণ সংসদ সদস্য ভরাট গলায় বলে ওঠেন, ‘লিডার, পাক মটর বাংলামটর হয়েছে, জিন্না এভিনিউ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়েছে কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী মান্নান সাহেবের সময় এখনো পর্যন্ত মিটফোর্ডের পাক ফার্মেসির নাম বদলায়নি তাই আমার বঙ্গস্থলীতে (পাকস্থলী) ব্যথা। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, আলম মান্নানরে বাঁচাইয়া দিলা।’ যে তরুণ সংসদ সদস্যের কথা বলছি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা নেই কে এই সংসদ সদস্য? যিনি বাকশালের বিরুদ্ধে সংসদে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে দেড় ঘণ্টা বক্তব্য রেখেছিলেন। গণতন্ত্র না হলে দেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বাস্তবায়ন হবে না সেই কথা বলেছিলেন।     

তিনি স্বাধীনতার প্রজ্জ্বলিত ক্যারাভান, ইতিহাসের চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া, বলিষ্ট কণ্ঠস্বর নূরে আলম সিদ্দিকী।

বিজ্ঞাপন
গতকাল ভোরে চলে গেলেন চির অনন্তের পথে। চৈত্রের রৌদ্রদহন শেষে বাসন্তী বাতাসের ভোরে তিনি মিলিয়ে গেছেন প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে। কিন্তু তিনি কি রেখে গেলেন? এই জিজ্ঞাসার উত্তর মিলবে নূরে আলম সিদ্দিকীর লেখায়, কথায়, অনলবর্ষী বক্তৃতার ঊর্মিমালায়। রাজনীতির ঘূর্নী হাওয়ায়ও তিনি খোলস বদলাননি, স্বাধীনতার মূর্ত চেতনা থেকে একবিন্দু নড়েননি। যে চেতনা নিয়ে একাত্তরের উত্তাল মার্চে মাঠ দাবড়ে বেরিয়েছেন, লক্ষ কোটি মানুষকে স্বাধীনতার চেতনায় রাজপথে লড়াই করতে মাঠ তাতিয়েছেন, সেই অমর, অক্ষয়, চেতনার শিখা প্রজ¦লিত করেছেন শেষ দমটুকু পর্যন্ত। 

চার খলিফার অন্যতম নূরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অতি আদরের ‘আলম’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পল্টন ময়দান, রেসকোর্সের লাখো জনতার ভিড়ে এমনকি নিজ ড্রয়িংরুমের আড্ডার টেবিলে জয়বাংলা বলে বলিষ্টকণ্ঠে হুঙ্কার দিয়েছেন শেষ পর্যন্ত। স্বাধীনতার পর প্রথম পার্লামেন্টে সংসদ সদস্য হিসেবে দেশের চলমান সংকট নিয়ে আওয়াজ তুলেছেন, বাকশালের বিরোধিতায় শানিত যুক্তি তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতেই। দীর্ঘসময়ের এই রাজনীতির পদযাত্রায় সবসময় গণতন্ত্রের পক্ষে উদাত্ত উচ্চারণ তার লেখনীতে জাগরুক ছিল। অনলবর্ষী বক্তৃতায় দৃপ্ত শপথ ছিল ধমনীতে। 

এনালগ থেকে বর্তমান সময়ের ডিজিটাল মাধ্যমে যেখানেই নূরে আলম সিদ্দিকী সেখানেই স্বাধীনতার স্বপক্ষে সত্যোচ্চারণ আর বলিষ্ট কণ্ঠে মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে আওয়াজ দিয়েছেন। একেবারে শেষবেলায় নিমগ্ন ছিলেন নিজের ‘আত্মজীবনী’ নিয়ে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বাঁক বদল আর ইতিহাসের গলিপথের জ্বলন্ত স্বাক্ষ্য তিনি রেখে গেছেন তার আত্মজীবনী ‘আমার গেছে যেদিন’ বইতে। যদিও বইটির প্রকাশ দেখে যেতে পারেননি। শেষ দেখাতেও এই বইটি নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। কি কি করা যেতে পারে তার পরিকল্পনা তৈরি করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, আত্মজীবনীটি অনেক মানুষের কাছে তুলে দিতে চান, মানুষ যেনো সত্যিকার ইতিহাসের জন্য বইটির গুরুত্ব বিবেচনা করে। 

দেখা হলেই ভরাট গলায় বলতেন, কি মিয়া তুমি ভাইটারে ভুইলা গেলা নি? আসো না কেন? তোমার জন্য আমার দরোজা চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা। করোনায় কিছুটা শারীরিক দূরত্ব তৈরি হলেও তা মনের ছিল না। প্রায়ই ফোন করতেন। নতুন কোনো লেখা প্রকাশ হলেই বলতেন, আজকের লেখাটা কি ঠিক ছিল? যা বলার তা কি বলতে পেরেছি? এবারো ৭ই মার্চ মানবজমিন প্রথম পাতায় নূরে আলম সিদ্দিকীর লেখা বিশেষ নিবন্ধ প্রধান শিরোনাম হয়েছে। 

শেষ দেখা ১৯শে মার্চ। অনেকটা রাতেই পৌঁছাই গুলশান আজাদ মসজিদ সংলগ্ন বাসায়। ফোনে কথা হয়েছিল। সিদ্দিকী স্যার অপেক্ষা করছিলেন। লম্বা সময় কোভিডের বাধ্যতা থাকায় দেখা হয়নি। কোভিডের কারণে বাসায় প্রবেশের আগেই মাস্ক দেয়া হলো, হ্যাক্সেজলতো ছিলই। দরোজায় থাকা প্রহরীরা অনেকটাই ইতস্তত, এত রাতে? আমি স্যারকে ফোন করতেই, মিয়া ওপরে উইটা আসো? দেখা হতেই বললেন, এখন আর রাত জাগতে পারি না। আজকাল শরীরটা কেমন যেনো দুর্বল লাগে। তবু ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। সহধর্মিণীর শরীরও খুব ভালো যাচ্ছে না, দোয়া করতে বললেন। কথা শুরু হতেই, দেখি চায়ের টেবিল এগিয়ে আসছে, বুঝতে বাকি নেই। স্যার, এত রাতে? আমার বাড়িতে আসছো, কিছু না খেয়ে যাবা, এটা হতে পারে না? আড্ডায় উঠে আসে সমসাময়িক রাজনীতি, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি। ইহিতাসের অনেক ঘটনাও বিবৃত করেন তিনি। নিজের আত্মজীবনী দ্রুত প্রকাশের তাগিদ অনুভব করছিলেন বারবার। বইটি একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কীভাবে সকলের হাতে তুলে দেয়া যায় তা নিয়ে কথা বললেন। নূরে আলম সিদ্দিকীর বয়ানে একাত্তরের অজানা অধ্যায় বা নেপথ্যের কথা ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল মানবজমিনে। 
শেষ কথাটি বলে গেলেন না? 

সবশেষ ফোন করেছিলেন ২৫শে মার্চ বিকালে। তখন ইফতারের সময় কাছেই বলে খুব একটা কথা হয়নি। ভরাট গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। স্যার, পরে ফোন করবো। এটাই ছিল শেষ কথা। এরপর ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করলেও রিসিভ হয়নি। আন্দাজ করতে পারি স্যার নিজের লেখালেখিকেই আরও এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন হয়তো। যখন এই লেখাটি লিখছি তখন রক্তলাল কোন শিমুল বাগানে কোকিল ডাকছে। তার কুহু কুহু সুরে, কেবলই জয়বাংলার কথা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status