প্রথম পাতা
দুই খালাকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলো কিশোর
স্টাফ রিপোর্টার
১৩ মে ২০২৫, মঙ্গলবারশুক্রবার দুপুর ১২টা। রাজধানীর শনির আখড়ার বাসা থেকে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বের হয় গোলাম রাব্বানী খান তাজ (১৪)। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পাঞ্জাবি পরা ছিল। কিন্তু প্রাইভেট পড়তে না গিয়ে সে সিএনজি রিজার্ভ করে শেওড়াপাড়ার খালার বাসায় যায়। সেখানে বড় খালা মরিয়ম বেগম তার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। বাসার অন্যরা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তখন সে খালার বাসার মানিব্যাগ থেকে সাইকেল কেনার জন্য ৩ হাজার টাকা চুরি করে ধরা পড়ে। বকাবকি করে বিষয়টি তার মাকে জানানোর হুমকি দিলে বড় খালাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। তখন পাশের রুমে থাকা ছোট খালা সুফিয়া বেগম বাধা দিতে গেলে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে গোলাম রব্বানী তাজ। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বাসার শিলপাটা এনে তাদের দু’জনকে আঘাত করে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর সে বাইরে থেকে দরজা তালা দিয়ে আবার সিএনজি ভাড়া করে শনির আখড়ার বাসায় যায়। খালাদের মৃত্যুর খবর যখন তার বাসায় আসে তখন জানাজা পড়ার জন্য নানা বাড়িতেও যায়। পরে পুলিশ রোববার রাত সাড়ে ৩টায় ঝালকাঠি সদরের নানা বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।
শুক্রবার শেওড়াপাড়ায় আপন দুই বোন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী মরিয়ম বেগমের মেয়ে নুসরাত জাহান বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার ভেতরে দুই বোন হত্যাকাণ্ডের ঘাতককে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গ্রেপ্তারের পর ডিবি’র জিজ্ঞাসাবাদে নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছে ১৪ বছর বয়সী ওই কিশোর।
ডিবি’র জিজ্ঞাসাবাদে তাজ জানিয়েছে, ওইদিন আনুমানিক সাড়ে ১২টায় বড় খালার বাসায় পৌঁছায়। গেটে তালা না থাকায় সে গেট খুলে ২য় তলার তার বড় খালার রুমে নক করলে বড় খালা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেন। বড় খালা তাকে আপ্যায়ন করার জন্য শরবত বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন এবং সেজো খালা (সুফিয়া বেগম) প্লেট ও বাটি ধোয়া-মোছা করে বারান্দার দিকে যান। এই সুযোগে সে বড় খালার রুমে টিভি’র পাশে রাখা মানিব্যাগ থেকে পুরাতন সাইকেল কেনার জন্য ৩ হাজার টাকা চুরি করে। বিষয়টি তার বড় খালা দেখে ফেললে তাকে গালাগালি ও বকাবকি করেন এবং বলেন তোর স্বভাব ভালো হবে না। তুই চুরি করার জন্য আমার বাসায় আসছিস, তোর মাকে এখনই জানাচ্ছি। তখন তার খালা তার মাকে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইল খুঁজতে থাকেন। তখন সে ডাইনিং টেবিলে থাকা লেবু কাটা ছুরি দিয়ে বড় খালার পেটে আঘাত করে। তখন বড় খালা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে মারতে উদ্যত হলে সে পুনরায় আঘাত করে। তার বড় খালা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকারের শব্দ শুনে সেজো খালা পিছনের অন্য একটি রুম থেকে এসে তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। তারপর সে একই চাকু দিয়ে সেজো খালার পেটে আঘাত করলে উনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। বড় খালা তখনো চিল্লাচিল্লি করছিলেন। তারপর সে রান্না ঘরের চুলার পাশ থেকে শিলপাটা এনে বড় খালার মাথায় একাধিক বার আঘাত করে। পরে সেজো খালার মাথায়ও আঘাত করে।
জিজ্ঞাসাবাদে ঘাতক কিশোর আরও জানায়, তারপর সে বাথরুমে গিয়ে তার হাতে ও মুখে লেগে থাকা রক্ত পানি দিয়ে পরিষ্কার করে। এরপর পাশের রুমে গিয়ে তার টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্টে রক্ত লেগে থাকায় চেঞ্জ করে খালাতো বোন মিষ্টির ব্যবহৃত একটি জিন্স প্যান্ট ও তার ব্যাগে থাকা আরেকটি রঙিন টি-শার্ট ও ক্যাপ পরে। পরে দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে চাবি নিয়ে বের হয়ে শনির আখড়া যাওয়ার জন্য রাস্তায় এসে সিএনজিতে ওঠে। কিছুদূর যাওয়ার পর ভিকটিমের বাসার চাবিগুলো ও তার পরিহিত ক্যাপ মেইন রোডে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। শনির আখড়া পৌঁছার পর চুরি করা ৩ হাজার টাকার মধ্যে ৪৫০ টাকা সিএনজি ভাড়া দেয়। বাকি টাকায় রক্ত লেগে থাকার কারণে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। তারপর শনির আখড়ায় সিএনজি থেকে নেমে স্টার্ন শপিং সেন্টারের ৩য় তলার মসজিদের ওয়াশরুমে ঢুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে তার ব্যাগে থাকা সকালে পরিহিত গোলাপি রংয়ের পাঞ্জাবি পুনরায় পরে এবং তার সঙ্গে থাকা ব্যাগের ভিতর থেকে রক্তমাখা কাপড় ভ্যান্টিলেটর দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর বাসার সামনে এসে পরিত্যক্ত বাড়িতে তার জুতা জোড়া ছুড়ে মারে। তারপর বাসায় চলে যায়। কাউকে বুঝতে দেয়নি সে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে এসেছে। দুই খালা হত্যার খবর পেয়ে শোকও প্রকাশ করেছে। পরদিন ১০ই মে বিকালে তার সেজো খালাকে দাফন করার জন্য তার নানুর বাড়ি ঝালকাঠি চলে যায়।
ডিবি মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, আমরা ঘটনার পর থেকেই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করি। একপর্যায়ে আমরা ওই কিশোরকে শনাক্ত করি। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তার অবস্থান শনাক্ত করে নানুর বাড়ি থেকে আটক করি। পরে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা থাকায় ভুক্তভোগী মরিয়ম বেগমের মেয়ের করা হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে তার দেখানো মতে স্টার্ন শপিং সেন্টারের পাশের সুয়ারেজ লাইনের উপর থেকে নীল রংয়ের রক্ত মাখা টি-শার্ট ও ব্লু কালারের রক্ত মাখা দু’টি জিন্স প্যান্ট উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে একটি তার ও একটি তার খালাতো বোন মিষ্টির জিন্স প্যান্ট ছিল। তার বাসার সামনে নির্জন বিল্ডিংয়ের উপর তার ফেলে দেয়া জুতা জোড়াও উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তাজ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আদালতে।