প্রথম পাতা
সরজমিন কুমিল্লা
সাক্কু-কায়সার দলে ফিরতে চান
মারুফ কিবরিয়া, কুমিল্লা থেকে ফিরে
১৩ মে ২০২৫, মঙ্গলবার
২০২২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মেয়র প্রার্থী হন কুমিল্লা জেলা বিএনপি’র তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কু। তখনই দল তাকে বহিষ্কার করে। এখনো বিএনপি’র বাইরে সাক্কু। অন্যদিকে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় একই সময় বহিষ্কার হন কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের তৎকালীন সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার। বহিষ্কার হলেও দুজনই ফিরতে চান দলে। গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর দলে ফেরার চেষ্টা আরও বেগবান হয়েছে। দলে ফিরে সাক্কু আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চান। অপরদিকে বরাবরের মতো সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন করার ইচ্ছা নিজাম উদ্দিন কায়সারের। অবশ্য দুজনই বলছেন- তারা সবসময় বিএনপি’র সঙ্গে ছিলেন, এখনো আছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়েই তাদের ওঠাবসা। মহানগরে যাবতীয় দলীয় কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
কুমিল্লার বিএনপি রাজনীতিতে সুখ্যাতি রয়েছে মনিরুল হক সাক্কুর। জনপ্রিয়তাও কোনো অংশে কম নেই। ভোটের মাঠে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মেয়র হয়েছেন একাধিকবার। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রথম মেয়রও মনিরুল হক সাক্কু। ২০১২ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী আফজল খানকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালেও তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০২২ সালে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মেয়র প্রার্থী হলে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন। ওই নির্বাচনে তাকে কারচুপি করে হারানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য এখনো ভোটের রাজনীতিতে তার প্রভাব ও গুরুত্ব রয়েছে। অতীতের ভুল ক্ষমা করে বিএনপি কবে তাকে আপন করে নেবে, সেই জল্পনা চলছে স্থানীয় রাজনীতিতে।
মনিরুল হক সাক্কুর দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার রয়েছে। দল তাকে পরিত্যাগ করলেও তিনি দল ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি। ১৯৯৩ সালে সাক্কু কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের সভাপতি হন। ২০১০ সাল পর্যন্ত সেই পদে বহাল ছিলেন। ২০২২ সালে বহিষ্কার হওয়ার আগে তিনি কুমিল্লা জেলা বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৫ সালে উপনির্বাচনে কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে পৌর চেয়ারম্যান হন। এরপর পৌরসভা সিটি করপোরেশনে রূপান্তর হলে তিনি ২০১২ ও ২০১৭ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে মেয়র হন। ২০২২ সালের জুনের তৃতীয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাকে ভোট গণনায় জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়। এক বছর পর আওয়ামী লীগের মেয়র আরফানুল হক রিফাতের মৃত্যু হলে ২০২৪ সালের ৯ই মার্চ উপনির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে নানা কারচুপি ও কেন্দ্র দখল করে বাহারকন্যা তাহসিন বাহার সূচনা মেয়র নির্বাচিত হন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সবশেষ সংসদ নির্বাচনে সাক্কুকে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি মনোনয়ন দিতে মাঠে নামেন গোয়েন্দারা। বাহারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য বলা হয়। প্রলোভন দেখানো হয় ভোটে জিতিয়ে আনার। কিন্তু সাক্কু তা প্রত্যাখ্যান করে আত্মগোপনে চলে যান।
কুমিল্লার রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি মানবজমিনকে বলেন, দল আমাকে বহিষ্কার করলেও আমি দল ছাড়িনি। দলের সঙ্গেই আছি। সবসময় নাগরিক সমস্যা নিয়ে কাজ করছি। ২৭টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে। তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে যাচ্ছি।
দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করে ভুল হয়েছে উল্লেখ করে সাক্কু বলেন, আমার হয়তো দলের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করাটা ভুল হয়েছে। আমি ভুল করেছি। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন না করলে হয় না। এখানে আওয়ামী লীগ একটা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের হাতে ক্ষমতা ছিল। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন সবই তাদের দখলে ছিল। এমন অবস্থায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটা চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। তার মধ্যেও আমাকে আমার নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটার সমর্থক সবার অনুরোধে নির্বাচনের মাঠে থাকতে হয়েছে। মানুষ চেয়েছে যেন আমি ভোটে অংশ নিই। হয়তো হেরে গেছি। হেরে যাওয়াটাও তো কারচুপির কারণে। আর ২০২২ সালে আমার দলেরই এক নেতার আত্মীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমার ভোট কেটেছে। যে কারণে আমাকে হারতে হয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, এ মুহূর্তে আমি দলে ফিরতে চাই। দলীয় চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছি।
এদিকে কুমিল্লা নগরীতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিজাম উদ্দিন কায়সার ছাত্রদলের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসেন। তিনি একসময় সংগঠনটির কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন। পরে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রায় আড়াই দশক ধরে রাজনীতির মাঠে থাকা নিজাম উদ্দিন কায়সার ২০২২ সালের ১৫ই জুনের আগে কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। নির্বাচনে আসার পর ওই বছরের ১৯শে মে তাকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তবে দল বহিষ্কার করলেও কায়সার অন্য কোথাও যাননি। বরং সবসময় বিএনপি’র পক্ষেই নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন এবং বিএনপি’র নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখেছেন। ফলে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের একটি অংশ কায়সারের ভোটের সময় ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালিয়েছেন।
পরবর্তীতে সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে কায়সার মানবজমিনকে বলেন, যেহেতু কুমিল্লার মানুষ আমাকে আগের দুটি নির্বাচনে ভালোবাসা দিয়েছেন সেহেতু সামনেও আমি মনে করি মানুষ আমাকেই এগিয়ে রাখবেন। তাদের ভালোবাসা নিয়ে কুমিল্লা শহরের কাজ করার দায়িত্ব নিতে চাই।
বহিষ্কারাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি বিএনপিরই সৃষ্টি। মানুষ আমাকে বিএনপি হিসেবেই চেনে। স্থানীয় রাজনীতির মেরূকরণ ও নেতাকর্মীদের চাহিদায় সে সময় একটা সিদ্ধান্ত নেয়া লেগেছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েও নির্বাচন করতে হয়েছে। তারপরও কুমিল্লার যত আন্দোলন হয়েছে দলীয় কর্মকাণ্ড আছে সবকিছুর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে। বহিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও আন্দোলন চলাকালীন সময়ে চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে আমার একাধিকবার কথা হয়েছে। ফোন দিয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমি মনে করি সাংগঠনিক যে সিস্টেম রয়েছে সেই সিস্টেমের কারণে আমাকে দলের বাইরে থাকতে হয়েছে। আমি মনে করি দল আবার সিস্টেম অনুযায়ী আমাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে।
দলে ফেরা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও কুমিল্লা জেলা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক আমিন-উর রশীদ ইয়াছিন মানবজমিনকে বলেন, এ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করা যাবে না। যখন যে রকম পরিস্থিতি হবে সে অনুযায়ী বক্তব্য রাখবো।