ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

মার্কিন রিপোর্ট

টক অব দ্য কান্ট্রি

স্টাফ রিপোর্টার
২৩ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

সোমবার বাংলাদেশ সময় রাতে প্রকাশিত মার্কিন মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্ট এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। রাজনীতির আলোচনার নয়া খোরাক। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের  মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, কারাগারে নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক, রাজনৈতিক বন্দি, কোনো ব্যক্তির অপরাধের জন্য পরিবারের সদস্যদের শাস্তির মুখে পড়ার কথা বলা হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, সাংবাদিকদের অযৌক্তিকভাবে গ্রেপ্তার, মতপ্রকাশ সীমিত করার জন্য ফৌজদারি মানহানি আইন কার্যকর, স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং মিডিয়ার ওপর বিধিনিষেধের বিষয়ও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। ইন্টারনেট স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো বিষয়গুলোও স্থান পেয়েছে স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে। রিপোর্ট প্রকাশের পর রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া এসেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা রিপোর্টকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, মার্কিন প্রতিবেদন একপেশে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উল্টো প্রশ্ন তুলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

বিজ্ঞাপন
প্রশ্ন তুললেও মার্কিন রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেননি আওয়ামী লীগ নেতারা। 
তবে বিরোধী দলগুলো বলছে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনই প্রমাণ করে দেশে মানবাধিকার বলতে কিছু নেই। নির্বাচন নিয়ে যে আপত্তি তারা জানিয়ে আসছেন মার্কিন রিপোর্টে তা আবারো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রিপোর্টে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে তা দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য লজ্জার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে মার্কিন এই রিপোর্ট রাজনীতির মাঠে নয়া খোরাক যোগাবে। 

মার্কিন প্রতিবেদন পক্ষপাতদুষ্ট বললেন তথ্যমন্ত্রী: পক্ষপাতদুষ্ট সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল সকালে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব নিউজ পেপার প্রেস ওয়ার্কার্স ও বাংলাদেশ সংবাদপত্র কর্মচারী ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে উল্লিখিত বাংলাদেশ বিষয় নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, একটি সূত্র থেকে নয়, সরকারবিরোধী এবং পক্ষপাতদুষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে তারা তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছে। সুতরাং সেই প্রতিবেদনটা একপেশে। অবশ্যই পুরো প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করছি না কারণ সেখানে অনেক ভালো কথাও বলা আছে। সার্বিকভাবে আমাদের মানবাধিকার, নির্বাচন, গণতন্ত্র সংক্রান্ত যে সমস্ত বিষয়াদি আছে সেগুলো পক্ষপাতদুষ্ট। হাছান মাহমুদ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়েও তো অনেক প্রশ্ন আছে। ডনাল্ড ট্রাম্প তো এখনো নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেননি। সেটির প্রেক্ষিতে ডনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যেভাবে ক্যাপিটল হিলে হামলা হয়েছে, সে ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা তো আমাদের দেশে কখনো ঘটে নাই। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে তাদের নিজেদের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে যে প্রশ্নগুলো আছে বা তাদের নির্বাচন হওয়ার পর ক্যাপিটল হিলে যে হামলা, সেই বিষয়গুলোর দিকে তাদের তাকানো প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। 
ভবিষ্যতে অন্য কোনো বড় দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার কিংবা নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন দেয় কিনা, সেটিও দেখার বিষয়। 

মার্কিন প্রতিবেদন দেশের জন্য লজ্জার- ফখরুল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে এবং তা দেশের জন্য লজ্জার বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, মার্কিন মানবাধিকার নিয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে লজ্জিত। দেশে এখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা নেই। রিপোর্ট প্রকাশের পরে আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের মতো বানিয়ে কথা বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেরা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। 
গতকাল দুপুরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বিএনপি’র সাবেক মহাসচিব কেএম ওবায়দুর রহমানের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণসভায় তিনি এসব কথা বলেন।

সরকারের আপত্তি রয়েছে-পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী: মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টের বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে উঠে আসা বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি রয়েছে। এই আপত্তির বিষয়গুলো দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় তুলে ধরা হবে।
গত মঙ্গলবার দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের মৌলিক কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো, এগুলোয় আদৌ আমলে নেয়ার কোনো বিষয় আছে কিনা। আপত্তির দিকগুলো ও দুর্বলতা সামনের দিনগুলোয় দুই দেশের মধ্যে কোনো উচ্চ পর্যায়ের সফর বা বৈঠকে তুলে ধরা হবে, যাতে পরবর্তী প্রতিবেদনে তা না থাকে।
মার্কিন প্রতিবেদনের বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, একটি বন্ধুরাষ্ট্র নিয়ে রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। আমরা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বলে থাকি, এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার আগে আমরা যাতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারি। বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় এবং বরাবরের মতো এবারো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। আমি মনে করি, এটি একটি বড় ধরনের দুর্বলতা।
মার্কিন প্রতিবেদনে আরেকটি দুর্বলতা রয়েছে বলে প্রতিমন্ত্রী উল্লেখ করেন। সেটি হলো মার্কিন প্রতিবেদনে উন্মুক্ত সূত্র থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে স্ববিরোধী অবস্থান প্রকাশ পায়। তিনি বলেন, অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে, বাক‌স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের প্রতিবেদনে উন্মুক্ত সূত্রের অনেক উদাহরণ আছে। এতে প্রমাণিত হয় যে খবর তৈরিতে সরকার বাধা প্রদান করে না। ২০২১ ও ২০২২ সালের মার্কিন প্রতিবেদনের মধ্যে গুণগত কোনো তফাত নেই বলে উল্লেখ করেন শাহরিয়ার আলম। বলেন, কোথাও কোথাও আমাদের প্রশংসা করা হয়েছে এবং সেজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় আমরা উন্নতি করেছি, তার প্রতিফলন এই প্রতিবেদনে রয়েছে। 

যা আছে মার্কিন প্রতিবেদনে: যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিগত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বড় প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। ওই রিপোর্টে বলা হয়, অনেক  মানুষকে রাজনৈতিক বন্দি ও আটক হিসেবে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও বিচার করা হয়েছে। এই রিপোর্টে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন ও নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগও আনা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য অনেক ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আছে বিচার বহিভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা। মুক্ত মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় মার্কিন প্রতিবেদনে। 

ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের পাশাপাশি কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তার পরিবারের সদস্যদের শাস্তি দেয়া হয় বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।  রিপোর্টে জোরপূর্বক গুম, অপহরণের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব গুম, অপহরণের শিকার বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বী। এসব অপরাধ প্রতিরোধে, তদন্তে এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে সীমিত প্রচেষ্টা নিয়েছে সরকার। 
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে বলা হয়েছে, ঘন ঘন এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সরকার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ এবং মিডিয়ার রিপোর্টে অব্যাহত গুম এবং অপহরণের তথ্য উঠে এসেছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা এসব সংঘটিত করেছেন বলে অভিযোগ আছে। 
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, যেসব মিডিয়া সরকারের সমালোচনা করেছে, তাদেরকে চাপ দেয়া হয়েছে। মুক্তভাবে অথবা বিধিনিষেধ না মেনে কোনো নিরপেক্ষ মিডিয়া কাজ করতে পারে না। ইন্টারনেট ফ্রিডম বা ইন্টারনেটে স্বাধীনতা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ওই রিপোর্টে বলেছে, ইন্টারনেট সুবিধায় বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার বা এই সুবিধায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে। বহু ঘটনায় তারা অনলাইন কন্টেন্ট সেন্সর করেছে। ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট অনেক নেটওয়ার্ক এবং ভিওআইপি ফোন নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইন দিয়ে। আইনগত যথাযথ কর্তৃত্ব না থাকা সত্ত্বেও অনলাইনে বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ মনিটরিং করছে সরকার। বিরোধী দলগুলো যেসব শহরে র‌্যালি ডেকেছিল সেখানে সরকার অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়েছিল অথবা গতি কমিয়ে দিয়েছিল। 
রিপোর্টে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার সংবিধান দিলেও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা পুরো বছরেই বহুবিধ বিধিনিষেধের মুখোমুখি হয়েছেন। বিরোধী বিএনপিকে নিয়মিতভাবে সমাবেশের অধিকার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে অথবা কর্তৃপক্ষ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভীতি প্রদর্শন করেছে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status