ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বেহুদা প্যাঁচাল

আরাভের এত দম্ভ নেপথ্যে আসলে কি?

শামীমুল হক
২৩ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

হিরো আলম ভালো বলেছেন। তার কথা অনুযায়ী তাকে এবং সাকিব আল হাসানকে মেডেল দেয়া উচিত। কারণ পুলিশ যা পারেনি। তারা তা করেছেন। তার ভাষ্য-আমরা যদি দুবাই আরাভ খানের ওখানে না যেতাম তাহলে আরাভ যে পুলিশ হত্যা মামলার আসামি তা কেউ জানতেই পারতো না। দুবাইয়ে আরাভ জুয়েলার্স উদ্বোধন নিয়ে সারা দেশে চলছে আলোচনা, সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টকশো গরম হচ্ছে প্রতিদিনই। আরাভ নিজেই বলছেন হ্যাঁ, আমি পুলিশ হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি। কিন্তু আমি এ খুনের সঙ্গে জড়িত নই। আমার অফিসে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

বিজ্ঞাপন
আমার অপরাধ কেন বিষয়টি পুলিশকে জানাইনি। এ জন্য আমার যে বিচার হবে তা মাথা পেতে নেবো। প্রশ্ন হলো-এতই যদি মাথা পেতে নেবে আরাভ তাহলে দেশ ছেড়ে পালালো কেন? দেশে থেকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আত্মসমর্পণ করতে পারতেন আরাভ। সেটা না করে তিনি অন্য আরেকজনকে আরাভ সাজিয়ে আদালতে দাঁড় করান। ওই ব্যক্তি জেলও খাটেন। এদিকে আরাভ নিজে দেশ থেকে পালিয়ে চলে যান ভারতে। তারপর ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই যান। মাত্র তিন চার বছরে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। এটা কীভাবে সম্ভব। বেশক’টি টকশোতে তাকে এই কোটিপতি কীভাবে হয়েছেন তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে দেখা যায়নি। বরং তিনি সাংবাদিকদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করেছেন। কোন সাংবাদিক নাকি তার কাছে পাঁচ কোটি টাকা দাবি করেছেন। ১০০ দিরহাম দিলেই নাকি সাংবাদিক কেনা যায়। এই যখন আলোচনা তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি অডিও প্রকাশ হয়। যেখানে আরাভ আর আল জাজিরার এক সাংবাদিকের কথোপকথন। সেখানে আরাভ জোর গলায় সাংবাদিকদের ৯৫ পার্সেন্টকে কেনা যায় বলে দাবি করেন। কিন্তু একটি প্রমাণও দিতে পারেননি। তাহলে সাংবাদিকদের প্রতি আরাভের এত রাগ কেন? অনুমান করা যায় আরাভের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন সাংবাদিকরা। এতদিন দুবাইয়ে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছিলেন। নিশ্চয় আপথে কুপথে কালো কারবারিতে লিপ্ত ছিলেন। যা দিয়ে তিনি এত টাকার মালিক হয়েছেন। আর এই টাকা দিয়ে তিনি আরাভ জুয়েলার্স উদ্বোধনে বাংলাদেশ থেকে তারকাদের উড়িয়ে নিয়ে যান দুবাইয়ে। এই তারকাদের পেছনেও নিশ্চয় কোটি টাকা খরচ করেছেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় হিরো আলমের এক বক্তব্যে। হিরো আলম ফেসবুক লাইভে সাংবাদিকদের বলেছিলেন দুবাইয়ে যেতে আরাভ যে টাকা দিয়েছেন তা তিনি গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেবেন। যাক যে কথা বলছিলাম- আরাভ কেন সাংবাদিকদের প্রতি এত ক্ষুব্ধ। এর একটাই কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। আর তা হলো- আরাভের গোপন কথা প্রথম সাংবাদিকরাই মিডিয়ায় প্রকাশ করেন। এতেই তোলপাড় শুরু হয়ে যায় সর্বত্র। ডয়েচে ভেলের একটি টকশোতে হাজির হয়ে ডিবি প্রধান বলেছেন, যে সব তারকারা দুবাই গেছেন তাদের প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আবার এও বলেছেন, একবার হিরো আলমকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে তিনি তোপের মুখে পড়েন। যেন হিরো আলমকে ডেকে তিনি নিজেই অপরাধ করেছেন। 

ডিবি প্রধান বলেন, হিরো আলম লম্বা চুল রেখে কনস্টেবলের ড্রেস গায়ে দিয়ে কোড ব্যবহার করেন। যা তিনি করতে পারেন না। এমনিতেও সিনেমা নাটকে পুলিশের ড্রেস পরলে অনুমতি নিতে হয়। হিরো আলম অনুমতি তো নেনই নি, বরং লম্বা চুল রেখে পুলিশের ড্রেস ব্যবহার করেছেন। আপনারা জানেন, পুলিশ কখনো লম্বা চুল রাখে না। এসব নিয়ে তাকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞেস করতে নিলে সবাই আমার পেছনে লেগে যায়। ওই টকশোতে ডিবি প্রধান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। আরাভ যে অন্য একজনকে আরাভ সাজিয়ে আদালতে হাজির করেন এবং দেশ ছেড়ে পালান এটা পুলিশই তদন্ত করে বের করেছে বলেও তিনি জানান। আরাভ খানের নামে এখন পর্যন্ত ১২টি ওয়ারেন্ট রয়েছে বলে জানান ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান খান খুনের মামলার এই আসামিকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হবে বলেও জানান তিনি। আরাভকে নিয়ে অনেক টকশো দেখলাম, কিন্তু তার অর্থের উৎস সম্পর্কে কেউই বের করতে পারেনি। আরাভ নিজেও তা বলেননি। বরং একটি টকশোতে তার জীবন্ত ঈগল এনে দম্ভ করে বলেন, এটি আমি লালন পালন করি। যার দাম দুই থেকে তিন কোটি টাকা। আবার এটাও বলছেন, আমার বাবা হকার ছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ঢাকায় আসেন। তিনি মেট্রিক পাস করেননি গর্বের সঙ্গে এ জবানবন্দিও দেন।  এবার আসা যাক পুলিশ খুনের ব্যাপারে। গত ১৬ই মার্চ নিজের ফেসবুক পেজে এক লাইভে আরাভ খান বলেন, আমি পুলিশ খুনের ঘটনায় জড়িত ছিলামই না। জড়িত থাকলে এত আলোচনার মধ্যে দুবাই থেকে পালিয়ে যেতাম। খুন হয়েছে আমার অফিসে। এ জন্য বিচার হলে মাথা পেতে নেবো আমি। যতটুকু অপরাধ করেছি ততটুকু সাজা হোক এটা চাই। গণমাধ্যমের খবর সব সত্য নয় বলে আরাভ খান বলেন, কোনোটাই পুরোপুরি সত্য না। আল্লাহ যদি পাশে থাকেন যতই শত্রু থাকুক না কোনো প্রবলেম হবে না। গোল্ড বাজারে শত্রু সবারই থাকবে। আমার প্রথম প্রবলেম হলো গোল্ড ব্যবসা শুরু করার সময় কথা দিয়েছিলাম ডিসকাউন্ডে গোল্ড দেবো। অন্যদের থেকেও কমে। সেক্ষেত্রে আমি বড় করে শুরু করেছিলাম। আমার কয়েকজন ব্যবসায়িক বন্ধু শত্রু হয়েছেন। এত কিছুর পরেও সাকিব আল হাসান ভাইকে ধন্যবাদ যে, তিনি পিছু হটেননি। আরাভ খান বর্ণনা দেন, ২০১৮ সালে আমার অফিস বনানীতে ছিল। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ছিল, আপন বিল্ডার্স। ঘটনার দিন বাসায় আমি ভাত খাচ্ছিলাম। বডিগার্ড আমাকে ফোন করে বলে আমার অফিসে একটা মার্ডার হয়েছে। তিনি ছিলেন এসবি’র একজন কর্মকর্তা। এটা সম্পূর্ণ একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আমার অপরাধ হচ্ছে আমি ওই অফিসের মালিক। ওখানে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কিছু কথা কাটাকাটি নিয়ে ঝগড়াটা হয়।

আরাভ বলেন, আমার আমেরিকান গ্রিন কার্ড ও কানাডিয়ান পাসপোর্ট রয়েছে। কই, আমি তো চলে যাইনি। আমাকে অনেকে চলে যেতে বলেছিলেন। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। এলাকায় কেউ বলতে পারবে না আমি কারও সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলেছি। কেউ বলতে পারবে না থানায় কোনো খারাপ রেকর্ড আছে।  ওদিকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান রবিউল ইসলাম। সেখানে বিয়ে করেন। পরে এই রবিউল আরাভ খান নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এখন তিনি দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী। আচ্ছা কীভাবে পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়? প্রথম আলো এক রিপোর্টে বলেছে, পুলিশ কর্মকর্তা মামুন এমরান খানকে বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে বনানীর একটি বাসায় ডেকে নিয়েছিলেন ‘বন্ধু’ রহমত উল্লাহ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে আগে থেকে অবস্থান করছিলেন তিন নারী। বাসার একটি কক্ষে লুকিয়ে ছিলেন দিদার, আতিক, স্বপন সরকারসহ পাঁচজন। তাদের লক্ষ্য ছিল ওই নারীদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে মামুনের কাছ থেকে টাকা আদায় করা। তখন বাসার একটু দূরে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা দেখছিলেন রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান। বনানীর ওই বাসা ছিল আরাভের। যদিও তিনি এটিকে তার অফিস বলে উল্লেখ করেছেন। বাসায় ডেকে আনার পর ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে হাত-পা বেঁধে মামুনকে বেদম মারধর করেন রহমতউল্লাহ, দিদার ও আতিকেরা। ওই রাতেই মামুনের মৃত্যু হয়। পরে রহমত উল্লাহর পরিকল্পনায় বাইরে থেকে দুটি বস্তা ও একটি সাদা কাপড় নিয়ে আসেন রবিউল। সেই বস্তায় ভরে মামুনের লাশ গাড়িতে করে গাজীপুরের একটি জঙ্গলে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়া হয়। মামুন হত্যা মামলার অভিযোগপত্র ও তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য প্রথম আলো তুলে ধরে। তদন্ত সংস্থার সূত্রমতে, মামুন, রহমতউল্লাহ এবং ওই তিন নারী টেলিভিশনে ‘ক্রাইম ফিকশন’ নামে একটি অনুষ্ঠানে অভিনয় করতেন। সেই সুবাদে তাদের পরিচয়। এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই মামুনকে ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা করেন রবিউল, রহমত উল্লাহ ও তাদের সহযোগীরা। ২০১৯ সালের ৩১শে মার্চ এ মামলায় রহমত উল্লাহ, রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সেখানে রবিউল ইসলামকে পলাতক উল্লেখ করা হয়। আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। অবশ্য রবিউল নিজেকে বাঁচাতে চাঁদপুরের আবু ইউসুফ নামের এক যুবককে তার পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করান। বিনিময়ে আবু ইউসুফকে নানা প্রলোভন দেখানো হয়। প্রায় ৯ মাস জেল খেটে সত্য প্রকাশ করেন ইউসুফ। পরে আদালতের নির্দেশে বিষয়টি তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবি’র তদন্তে উঠে আসে, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামি রবিউল নাম দিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ইউসুফ।  এই যে নিজেকে বাঁচাতে এতকিছুর আশ্রয় নিয়েছেন আরাভ, তাতে কি প্রমাণ হয়? তবে এটা সত্য, আরাভ জুয়েলার্স উদ্বোধনে ক্রিকেটার সাকিব, হিরো আলমরা না গেলে এতকিছু সামনে আসতো না। এত আলোচনাও হতো না। রবিউল যে আরাভ হয়ে গেছে তাও থাকতো অজানা। এবার জেনে কি হবে কিংবা হলো সেটা দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status