ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

খোলা চোখে

জোর যার মুল্লুক তার

রুমিন ফারহানা
২১ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

নির্বাচনের আগে বড় দুই দল সমর্থিত দুই প্যানেলই সমান তালে প্রচারণা চালিয়েছে, ভোট চেয়েছে, একসময় তো পাল্লা দিয়ে খাওয়ানোর চল ছিল। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সকল প্রার্থীই বারের সদস্যদের জন্য নানান খাবার আয়োজন করতেন। অর্থাৎ নির্বাচন ঘনিয়ে আসলেই পুরো বারজুড়ে একটা উৎসবের পরিবেশ তৈরি হতো। দুই দিন ধরে চলা নির্বাচনের দ্বিতীয় দিন বিকালের পর থেকে শুরু হতো নতুন উত্তেজনা। নির্বাচনের ফল গণনার প্রতি মুহূর্তেই অস্থিরতার, বিশেষ করে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের পদ ঘিরে থাকতো টান টান উত্তেজনা। অনেক রাতে ভোট গণনা শেষ হলে  ঘোষণা করা হতো ফলাফল। একদম দলীয় ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ আইনজীবীরা অত রাত অবধি অপেক্ষাও করতো না।

আগামী নির্বাচন কেমন হতে যাচ্ছে এই নিয়ে যাদের মনে নানা সন্দেহ, উৎকণ্ঠা কাজ করছে তাদের জন্য সুখবর আছে। যতই দিন গড়াচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে নির্বাচনের রূপ। একদিকে বিরোধী দলগুলোর একটাই দাবিÑ এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বিরোধী দল তথা বিএনপি’র সঙ্গে ন্যূনতম কোনো সংলাপ নয়।

বিজ্ঞাপন
সুতরাং এখন পর্যন্ত যা  দেখা যাচ্ছে তাতে এটি বললে ভুল হবে না যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে একরকম অনড় আওয়ামী লীগ। বিএনপিরও স্পষ্ট কথা- তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের সর্বশেষ যে রূপ দেখা  গেছে, ২০১৮ সালে তাতে পুরো বিষয়টিকে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ বললে ভুল হবে না। 

 

 

জাতীয় নির্বাচন তো অনেক জটিল বিষয়, সেখানে বাজিটা অনেক বড়। আমাদের মতো  দেশে যেখানে ক্ষমতায় থাকা না থাকাটা অনেক বড় পার্থক্য তৈরি করে সেখানে একটা নির্বাচনে হারার ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না। বিশেষ করে কোনো সরকার যদি  মেয়াদের পর মেয়াদ অনির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় থাকতে পারে জবাবদিহিতার ন্যূনতম কোনো বালাই ছাড়া তাহলে তো কথাই  নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো সামান্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, এফবিসিসিআই বা সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনের মতো যেখানে খুব বেশি পাওয়া কিংবা হারাবার  নেই সেখানেও নির্বাচনের এই ভয়ঙ্কর রূপ কেন?

কিছুদিন আগে হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমরা  দেখলাম প্রার্থীরা বলছে- ‘শুধু একে-৪৭ নয়, প্রয়োজনে যা করা দরকার সবই করবো’ কিংবা ‘যারা যারা নৌকায় ভোট  দেবেন না, তাদের চিহ্নিত করা হবে। সোজা কথা, আমার কবরস্থানে তাদের কবর দিতে  দেয়া হবে না। এমনকি তাদের মসজিদেও নামাজ পড়তে  দেয়া হবে না’। কেউ বলছেন নৌকা সরকারের। ভোট জোর করে নিতে পারলে, নৌকা মার্কার সরকার পারবে। চেয়ার মার্কা, কলসি মার্কার পক্ষে তা  মোটেও সম্ভব না। কি চমৎকার প্রচারণা। সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে মূলধারার গণমাধ্যমে এসেছে এই প্রতিটি খবর। কিন্তু এদের কারও বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে  তো বাদই দিলাম এমন কি কমিশনের তরফে ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। মজার বিষয় হলো প্রচারণা যেমন ছিল নির্বাচনও তার থেকে ভিন্ন কিছু হয়নি। বেশ বড় সংখ্যক ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, অন্য ইউনিয়নগুলোতে জোর জবরদস্তি করে, অন্য প্রার্থীদের কর্মীদের কেন্দ্র থেকে শুরু করে এলাকা ছাড়া করে তবে জিতিয়ে আনা হয়েছে নৌকার প্রার্থীকে। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যে মাপের সহিংসতা হয়েছে তেমন সহিংসতা পূর্ণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বহুদিন  দেখেনি এদেশের মানুষ। আওয়ামী লীগের নিজ দলের মধ্যে কোন্দলে মারা গেছে একশ’র বেশি মানুষ। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। যে নির্বাচন ছিল উৎসবের তা এখন আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। 
প্রাথমিক ভাবে সরকারের দাবি ছিল তিন শ’ আসনে ইভিএমে  ভোট করার, এখন অবশ্য বাজেটের টানাটানিতে সেখান  থেকে অনেকটাই সরে এসেছে সরকার। সরকারের যুক্তি ইভিএমে  কোনো কারচুপি চলে না। কারচুপি চলে কি চলে না  সেটাও বোঝা গেল এই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রচারণাতেই। যান্ত্রিক কারচুপি হলে ভালো না হলে ম্যানুয়েলই সই। ‘তো এখানে ইভিএম একটা করেছে সরকার। তো কী করতাম। একটু কষ্ট করে গিয়ে আঙুলে চাপ দিয়ে ভোট দিতে হবে। চাপ দিতে না পারলে চাপ  দেয়ার জন্য সেখানে আমি মানুষ রাখবো। ইভিএম না হলে আমি কাউকে খুঁজতাম না, ভোট আমি  মেরে দিতাম। যেভাবে পারি  ভোটটা মেরে দিতাম।’  কথাগুলো বলেছিলেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মুজিবুল হক।  
মুজিবুল হক আরও বলেন, ‘ইভিএমে আইডি কার্ড ঢুকিয়ে দিতে হয়, নইলে হয় না। এটা না হলে আমি রাতেই নিয়ে  ফেলতাম। তো আপনারা একটু কষ্ট করেন, আপনাদের একটু কষ্ট করে ওটা নিয়ে যেতে হবে। গিয়ে মেশিনে ফিঙ্গার দিতে হবে। কথা বুঝেন নি? আমি রাতের খেলোয়াড়, একসঙ্গে ২০ হাজার নিয়ে ফেলি যে ওটা।’

এত গেল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের শেষ ধাপ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথা। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র নির্বাচনই হচ্ছে না আর। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই সংগঠনটির নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে মনোনীত পরিচালক নিয়োগের মাধ্যমে। সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া কারও পক্ষে এই সংগঠনের  প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব ছিল না। আর এখন তো কাগজ-কলমের নির্বাচনটিও হচ্ছে না। ২০১৯-২০২১ মেয়াদে সকল পরিচালক এবং প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য পদে সকলেই নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। একই পরিস্থিতি হয়েছে ২০২১-২০২৩  মেয়াদের গত নির্বাচনে। এই নির্বাচনে অবশ্য ঘটেছে এক মজার কাণ্ড। পরিচালকের মোট পদের চেয়ে প্রার্থী ছিলেন ৪ জন  বেশি। অর্থাৎ সেখানে সরাসরি নির্বাচনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৪ জন তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে আবারো পুনরাবৃত্তি হয় গতবারের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্টসহ সকলেই। 

২০২৩ সালে নজির তৈরি করলো আরও একটি নির্বাচন। সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচন। ২০০৮ সালে হাইকোর্ট এনরোলমেন্টের পর আমি সুপ্রিম  কোর্ট বারের সদস্য হই ২০১০ সালে। এরপর থেকে প্রতি বছর  ভোট দিয়ে এসেছি। নির্বাচনের আগে বড় দুই দল সমর্থিত দুই প্যানেলই সমান তালে প্রচারণা চালিয়েছে, ভোট চেয়েছে, একসময় তো পাল্লা দিয়ে খাওয়ানোর চল ছিল। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সকল প্রার্থীই বারের সদস্যদের জন্য নানান খাবার আয়োজন করতেন। অর্থাৎ নির্বাচন ঘনিয়ে আসলেই পুরো বারজুড়ে একটা উৎসবের পরিবেশ তৈরি হতো। দুই দিন ধরে চলা নির্বাচনের দ্বিতীয় দিন বিকালের পর থেকে শুরু হতো নতুন উত্তেজনা। নির্বাচনের ফল গণনার প্রতি মুহূর্তেই অস্থিরতার, বিশেষ করে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের পদ ঘিরে থাকতো টান টান উত্তেজনা। অনেক রাতে ভোট গণনা শেষ হলে  ঘোষণা করা হতো ফলাফল। একদম দলীয় ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ আইনজীবীরা অত রাত অবধি অপেক্ষাও করতো না। জানতো পরদিন খুব সকালেই জানা যাবে ফলাফল। সেখানে  নির্বাচনে মারামারি, পুলিশ আসা, পুলিশ দ্বারা আইনজীবী আর সাংবাদিক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা কল্পনারও বাইরে। কিন্তু তাই হলো এবার। তছনছ করা হলো আদালত প্রাঙ্গণ। সুপ্রিম  কোর্ট বারে পুলিশ ঢুকলো কার অনুমতি নিয়ে? নির্বাচনটা লুট হলো সবার চোখের সামনে। 

আসলে পুরো সিস্টেম যখন ধ্বংস হয় তখন বিচ্ছিন্ন ভাবে  কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ঠিক থাকতে পারে না। একটা ছোট্ট ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা এফবিসিসিআই অথবা সুপ্রিম  কোর্ট বারের নির্বাচন ঠিক সেই সাক্ষ্যই বহন করে। নির্বাচন তখন আর নির্বাচন থাকে না, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করতে থাকে ‘জোর যার মুল্লুক তার’, মার্কা বা দলের সমর্থনই নির্ধারণ করবে ক্ষমতার আসনে কে বসবে, মানুষের ভোট নয়।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status