ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

আখেরে জিতবে কে ইমরান খান নাকি সরকার?

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
২০ মার্চ ২০২৩, সোমবার
mzamin

ইমরান খান ক্ষমতায় নেই। ফলে তিনি রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করতে পারেন না। অন্যদিকে তার আছে ব্যাপক জনসমর্থন- এ কথা যে কেউ নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন। ফলে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা চাইছেন, যে করেই হোক ইমরানকে যদি চৌদ্দ শিকের ভেতর ভরা যায়, সামনের নির্বাচনে যদি অযোগ্য করে দেয়া যায়, তাহলে পথের কাঁটা দূর হবে। তাদের পথ হবে মসৃণ। তবে ম্যাজিস্ট্রেট জেবা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইমরান যে ভাষায় হুমকি দিয়েছেন, তাও একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে কেউ আশা করেন না। তিনি তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন প্রকাশ্যে। যা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গেছে। এখন ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হলে তার জনপ্রিয়তায় কী ভাটা পড়বে? ইতিহাস এবং প্রতিবেশীদের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, এতে তার জনপ্রিয়তা বাড়বে

নদীতে যখন জোয়ার থাকে বা নদী খরস্রোতা থাকে, তখন তাকে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা যায় না। এতে জোয়ারের পানিতে ক্ষিপ্রতা সৃষ্টি হয়।

বিজ্ঞাপন
খরস্রোত আরও গতি নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ঠিক রাজনীতির ময়দানও সেরকম। রাজনীতিতে যখন গণজোয়ার সৃষ্টি হয়, তাতে বাধা দিলে তার গতি বাড়ে। জনপ্রিয়তা বাড়ে। ফলে সেই বাধা পক্ষান্তরে বাধাদানকারীদের বিপক্ষেই যায়। এতে আখেরে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কথা মনে হচ্ছে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি দেখে। অনেক দেশেই বিরোধী পক্ষকে, বা প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে নানা কৌশলে বাধা দেয়া হয়। আটকে দেয়া হয় তাদের কর্মকাণ্ড। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নৈতিকতার কাছে হেরে যায় বাধাদানকারীরা। এর ফল তখন তখন পাওয়া যায় না। অপেক্ষা করতে হয়। সময় এবং সুযোগ বলে দেয় এর উত্তর। পাকিস্তানে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত নেতা ইমরান খান। তিনি ক্ষমতা হারিয়েও যেভাবে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছেন, তা বিস্ময়কর। তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে বার বার পিছু হটতে হয়েছে পুলিশকে, রেঞ্জারসকে। জনতার প্রতিরোধ, ইমরান খানের প্রতি ভালোবাসা- তাকে রক্ষা করেছে। এ জন্যই ইমরান খান বলেছেন, তাকে গ্রেপ্তার করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কারণ, নেতাকর্মীরা, সাধারণ মানুষ এখন আর তার কথা শুনবে না। তারা তাদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। 

পাকিস্তানে ইমরান খান এক বিস্ময়কর নাম হয়ে উঠেছেন। সেই ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে এ পর্যন্ত তার প্রতিটি কাজ সাফল্য পেয়েছে। তিনি দেশকে ক্রিকেট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করে দিয়েছেন। তারপরে আর কখনো পাকিস্তান ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ফলে ক্রিকেটে তার স্থান সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সেখান থেকে এসেছেন রাজনীতিতে। প্রতিষ্ঠা করেছেন পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)। তা নিয়ে চলতে চলতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে চমক দেখান। গঠন করেন সরকার। অবশ্য আলোচনা আছে এই নির্বাচনে তাকে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছিল সেনাবাহিনী ও এর সাবেক প্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া। ইমরান খান অবশ্য সে অভিযোগ বানচাল করে দিয়েছেন। তবে বিষয়টি ওপেন সিক্রেটের মতো হয়ে গেছে। যার কোনো প্রমাণ থাকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ক্ষমতার শেষের দিকে এসে সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গেই, সেই সেনাপ্রধানের সঙ্গেই তার তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়ে যায়। কারণ, তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি হোয়াইট হাউসে সাক্ষাতের অনুরোধ করা সত্ত্বেও তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এর বহুবিধ কারণ আছে। অন্যদিকে তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া যুক্তরাষ্ট্র সফর করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে এই বিরোধ আরও স্পষ্ট হয় ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রধান কাকে করা হবে, তা নিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন ইমরান খান। তার পরপরই তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে পূর্ব নির্ধারিত হলেও আকস্মিক রাশিয়া সফরে যান। সেখানে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মাখামাখি শুরু করেন। যে পুতিনকে থামাতে পশ্চিমা বিশ্ব উঠেপড়ে লেগেছে, যার বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে ইমরানের এই মাখামাখি পশ্চিমা বিশ্ব বা এ অঞ্চলের সচেতন মানুষ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। 

এ কারণে দেশের ভেতরে ইমরানের বিরুদ্ধে ‘যড়যন্ত্র’ শুরু হয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। তিনি গত বছর এপ্রিলে ক্ষমতা হারান। তখনো তিনি ভীষণ জনপ্রিয় পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে। এর পরই ক্ষমতায় আসে তারচেয়ে অনেকটাই কম জনপ্রিয় বেসামরিক সরকার। তারা ক্ষমতায় এসেই অনুধাবন করে ফেলেন, ইমরান খান যদি এভাবে রাজনীতিতে টিকে থাকেন তাহলে তাদের হালে পানি পাবে না। তাই এ অঞ্চলে বিরোধী পক্ষকে দমিয়ে রাখার যত কৌশল আছে, তার ব্যবহার শুরু হয়। একের পর এক মামলা দেয়া হয় তার নামে। এর মধ্যে তোষাখানা মামলা অন্যতম। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তিনি এসব পণ্য কম দামে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নিয়েছেন। এ জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বার বার তাকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার সমন পাঠানো সত্ত্বেও তিনি শুনানিতে অংশ নেননি। ফলে তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। প্রথমে লাহোরের জামান পার্কে তার বাসভবনে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় ইসলামাবাদ পুলিশ। সে সময় পিটিআই নেতাকর্মীদের প্রচণ্ড বাধার মুখে পড়ে তারা। এক পর্যায়ে পিছু হটে। আবার শক্তি সঞ্চয় করে একজন এসপি ওই বাসার ভেতরে প্রবেশ করেন। বেরিয়ে এসে বলেন, ইমরান খানকে তার রুমে পাওয়া যায়নি। অথচ তার পরই ওই বাসা থেকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন ইমরান। বিষয়টি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো হয়ে যায়। মানুষ হাসাহাসি করতে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট জেবা চৌধুরীকে ‘হুমকি দেয়ার’ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং তোষাখানা মামলার পরোয়ানা বাস্তবায়ন করতে বার বার পুলিশ জামান পার্কের বাড়িতে হানা দিচ্ছিল। এ সময় পিটিআই নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের তীব্র সংঘর্ষ বাধে। এ অবস্থায় পুলিশ তার বাসভবনের বাসার গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে অভিযান চালাতে। ইমরান খান তখন ইসলামাবাদে। তিনি আদালতে হাজিরা দিতে উপস্থিত হয়েছেন। সব মিলে ঘটনাটি যেন সাপ-বেজি খেলার মতো। কেউ কাউকে না ছাড়ে। কিন্তু আখেরে জিতবে কে? এ এক বড় প্রশ্ন। 

কারণ, যে তোষাখানা মামলায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, সেই একই রকম অভিযোগ আছে বর্তমান ও সাবেক অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে। এমন শীর্ষ ১০ জনের মধ্যে পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজের (পিএমএলএন) আছেন বেশ কয়েকজন। তার চার বছরের ক্ষমতার মেয়াদে সবচেয়ে বেশি দামি উপহার নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, সাবেক প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেইন এবং আহসান ইকবাল। অন্যদিকে আছেন পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফের (পিটিআই) অন্যতম নেতা ও প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ ইউসুফ রাজা গিলানি, সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজ। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল ওয়াসিম ইফতিখার চিমা আছেন এই তালিকায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক যে, তাহলে কেন শুধু ইমরান খানের বিরুদ্ধে এই হয়রানি? যদি আইন সবার জন্য সমানই হয়, তাহলে এসব নেতা বা তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে কেন নয়? এখানেই বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। ইমরান খান ক্ষমতায় নেই। ফলে তিনি রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করতে পারেন না। অন্যদিকে তার আছে ব্যাপক জনসমর্থন- এ কথা যে কেউ নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন। ফলে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা চাইছেন, যে করেই হোক ইমরানকে যদি চৌদ্দ শিকের ভেতর ভরা যায়, সামনের নির্বাচনে যদি অযোগ্য করে দেয়া যায়, তাহলে পথের কাঁটা দূর হবে। তাদের পথ হবে মসৃণ। তবে ম্যাজিস্ট্রেট জেবা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইমরান যে ভাষায় হুমকি দিয়েছেন, তাও একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে কেউ আশা করেন না। তিনি তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন প্রকাশ্যে। যা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গেছে। এখন ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হলে তার জনপ্রিয়তায় কী ভাটা পড়বে? ইতিহাস এবং প্রতিবেশীদের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, এতে তার জনপ্রিয়তা বাড়বে। কোনো নেতাকে যখন জেলে ভরা হয়, ঠুনকো কোনো অভিযোগ দিয়ে, তখন জনগণ এর অর্থ বুঝে ফেলে। তাতে সরকারযন্ত্র যত যা বলেই তাদের দায়িত্বের পক্ষে সাফাই  গেয়ে বেড়াক না কেন এখন একবিংশ শতাব্দী। মানুষ অত্যন্ত সচেতন। কেউ হা করলে তার অর্থ বুঝে ফেলে। এসব মানুষের করার কিছু থাকে না। তারা দুর্বল। তবে তারাই সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যখন নির্বাচন আসে। তারা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়।
 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status