নির্বাচিত কলাম
ভাবনার করিডোর
রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে চাপা পড়ে যাচ্ছে তারুণ্যকে আকৃষ্ট করার মতো সর্বজনগ্রাহ্য নেতৃত্ব
ড. তৌহিদুল হক
১৮ মার্চ ২০২৩, শনিবার
একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রকৃতির প্রাচুর্যতার সংকলন বাংলাদেশের সর্বত্র। জীবনপ্রবাহে বহুমুখী বৈচিত্র্য দৃশ্যমান। সংকট সময়ে পরস্পর সহযোগিতার পরশও লক্ষণীয়। তবে এ সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান বৈষম্য কিংবা আদর্শিক বিভাজনের কারণে একত্রিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় রসদের সম্মিলিত আয়োজন থেকে বঞ্চিত। যার প্রভাব পড়ছে তরুণদের আগামী দিনের প্রস্তুতির ওপর। ঐক্যবদ্ধ মিছিলে অংশ না নিয়ে দোষ ধরার মানসিকতা কখনো প্রকট আকার ধারণ করছে। তরুণদের আকৃষ্ট করার মতো সর্বজন গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের প্রকাশ রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে চাপা পড়ে যাচ্ছে। সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্ব বিকাশের জন্য সুযোগ-সুবিধার পরিধি উন্মুক্ত করা এবং অন্যের সাফল্য সহজে মেনে নিয়ে নিজের পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ জরুরি।
একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে বলার মতো এক লিপিবদ্ধ বয়ান সৃষ্টি হয়। যাপিত জীবনের দীর্ঘ পরিসরে আয়োজনের বহুমাত্রিক রেখায় একসঙ্গে চলার পদক্ষেপ সংস্কার সাধনার মালা হয়ে সম্মুখে দাঁড়ায়। সৃষ্টি হয় এক প্রজন্ম। দেখতে ভিন্নতা জন্মগত বৈচিত্র্যের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও চিন্তার মানসে প্রায় অভিন্নতা দৃশ্যমান হয়। পরিচিতি পায় একটি নির্দিষ্ট নামে, শক্ত হয়ে দাঁড়ায় দু’পা। মাটির ভিত জানিয়ে দেয় নিজেদের আয়তনে উচ্চকিত হবে পরিবর্তনের স্লোগান, পরিবর্তিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। নিজস্বতা জেগে ওঠে সর্বাগ্রে। দেনা-পাওনার পরিব্যাপ্তি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কৌশল ও প্রক্রিয়ার ব্যাসার্ধে পরিমাপ করে গ্রহণ করার সাহস তৈরি হয়, মনের মন্দিরে।
নিজের পরিচয়ে গৌরবান্বিত বোধ করে। নিজেদের হাত-পা দেশকে হাঁটায়। তরুণ প্রজন্মের বুক ভরে ওঠে সাহসের কালিতে লেখা শব্দের গর্জনে। সময়ের হিসেবে বাংলাদেশ অর্ধশতক বছর অতিক্রম করে সামনের পানে ধাবমান। স্বপ্ন দেখছে সর্বোচ্চ বিন্দু ছুঁয়ে দিতে হবে- সম্মানে, মর্যাদায়, জ্ঞানে, আর আদর্শিক চেতনার কর্ম-প্রবাহে। সামনের দিনগুলো তরুণদের। জেগে ওঠার মতো স্বাপ্নিক কোলাহলে প্রতিনিয়ত ঘুম ভাঙবে দিশাহারা মানুষের। প্রশ্বস্ত ললাটে লিখিত হবে আগামী দিনের দিনলিপি। যেখানে প্রত্যাশা জীবনের সমান অঙ্গীকার আর ন্যায্যের পাওনা আন্দোলনের মিছিলে প্রথম ব্যক্তির বুক খোলা চিৎকার।
সবাই মিলে এক হওয়ার সংগ্রাম। নিজস্বতার লড়াই আর পশ্চাৎপদ চিন্তার বিরুদ্ধে আজীবন বিরুদ্ধাচরণ। এত বাঙালির নিজস্বতার মৌলিক বিষয় যা প্রেক্ষাপটের পরতে সারা বাংলায় চিত্রায়িত। পরিশীলিত জীবনকাঠামো তৈরির সংগ্রামে তরুণদের সাহসী ভূমিকা গুরুত্বের দাবিদার। পরিবর্তন ও পরিবর্তিত হওয়ার ক্ষেত্রে জেগে ওঠার অঙ্গীকার প্রয়োজন। যা বয়স ও শরীরী ভাষায় তরুণদের মধ্যে গ্রোথিত। আলোচনার মর্মার্থ হলো একটি নিজস্ব জীবনকাঠামো তৈরি ও অনুশীলনে আমাদের তরুণরা কতোটা অগ্রসরমাণ হবে কিংবা হওয়ার ইচ্ছা আছে। চারপাশের কর্ম-প্রবাহের গভীরতা জানান দেয় যে, অন্যের চমকিত জীবনপ্রবাহ অথবা চাকচিক্যময় জীবনব্যবস্থার প্রতি স্বাভাবিক ইচ্ছার জাগরণ সবার মধ্যে দৃষ্টিগোচর। তবে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে এ আকাঙ্ক্ষার ব্যাপ্তি দীর্ঘায়িত হয় না। স্বল্পতে জ্বলে ওঠে, অল্পতে নিভে যায়। স্বপ্নগুলো মরীচিকার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে একসময় গতি অন্যদিকে প্রবাহিত হয়। নিশ্চুপ হয়ে পড়ে, মেনে নিতে হয় সমাজে প্রচলিত জীবনচিত্রের কোনো একটি দিক।

পরিবর্তন যদি তারুণ্যের দ্বারা আমন্ত্রিত না হয় তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। থেমে যায় চলার মাঝপথে। কারণ তরুণরা যেভাবে বাজি রাখে নিজের জীবনের স্বপ্ন পূরণের সংগ্রামে সেভাবে অন্য বয়সের ব্যক্তির মধ্যে ততোটা লক্ষণীয় নয়। বাস্তবতা হলো-তরুণরা জাগ্রত না হলে সমাজ ও সংস্কৃতির নিজস্ব পরিচয় কাঠামো সহজে সৃষ্টি হয় না। কিংবা বলা যায়, কখনোই হয় না।
প্রবহমান বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলার মতো একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় বাংলাদেশের রয়েছে। গ্রামীণ আবহে গাঢ় আমাদের চলার গতি, সহনশীল পরিচয়ের প্রয়োজনীয় উপকরণ চারপাশে ফুলের মতন সজ্জিত। কখনো প্রশ্বস্ত মাঠ, নদীর নিরন্তর বয়ে চলার পথ, ঋতু-বৈচিত্র্যের প্রগাঢ় আবেদন প্রকৃতির সমস্ত দেহায়বে। এখান থেকে তৈরি হতে পারে এক অতি আকর্ষণীয় জীবনবোধ যা স্বতন্ত্রের পরিচয় নিয়ে বৈশ্বিক আবেদনের প্রকৃতিলব্ধ চাহিদা পূরণে সক্ষম। কী নেই আমাদের চারপাশে, এখানে নির্জনে আসে জীবনসুগন্ধির বাহার। গাছের পাতায় ঝুলে থাকে সজীবতার কথন।
বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব জীবনাচরণে অভ্যস্ত হতে হবে। অন্যথায়, বহুমাত্রিক বাণিজ্য তৎপরতায় কখনো এ নিয়ম কখনো অন্য নিয়মে চলতে গিয়ে পরগাছা জাতীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে অগ্রগতির মূল তাৎপর্য নিহীত রয়েছে স্বতন্ত্রবোধ এবং মানুষের মধ্যে পরস্পর আস্থার সম্পর্কের গতি-বিধির ওপর। একটি দেশে সত্যিকার অর্থে উন্নয়নে ক্রমানুধারা সৃষ্টি হয় যখন জনগণ বা নাগরিকদের মধ্যে নিজেদের যা কিছু আছে তার প্রতি মমত্ববোধ ও অনুশীলনার্থে প্রচার-প্রকাশে আগ্রহান্বিত তৃপ্তি তৈরি হয়। অন্য দেশের সঙ্গে বা আধুনিকতার পরিমাপে ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে গেলে নিজেকে সর্বদা দুর্বলই মনে হবে। কিন্তু নিজের বা দেশের প্রবহমান ধারায় সৃষ্ট উপকরণ পুঁজি করে পরিচয়ের স্বতন্ত্র কাঠামোর প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
মানুষ বদল চাইবে, পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখবে। একজন বাংলাদেশি নাগরিক কর্ম কিংবা অন্যকোনো প্রয়োজনে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তার মূল পিত্তিমি দেশের চলমান সমাজকাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ। দেশে মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ বয়সে তরুণ এবং তারণ্যের মন্ত্রে প্রভাবিত। পরিবর্তনের মূল শক্তি হলো-তারুণ্যের শক্তি। তবে তরুণদের নিজ দেশের উন্নয়ন বা অগ্রগতির প্রতি বিবেচনাবোধ জাগ্রত রাখা প্রয়োজন। দেশের প্রতি করণীয় আছে এই বোধ থাকা অপরিহার্য। দেশ তরুণদের কাছে চাইবে, চাওয়ার বাস্তবায়নে প্রতিফলিত হবে প্রভাবচিত্রের সমর্থন। প্রয়োজন সুযোগ-সুবিধার ন্যায্যতা বা বর্তমান অবস্থান অতিক্রম করে সামনে চলার জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপকরণের সহজলভ্যতা বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
স্বতন্ত্র পরিচয়ের জন্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ত্যাগ বা আত্ম-উপলব্ধি ইতিহাসের রচিত পর্বে উল্লিখিত হলেও তা নাগরিক মননে প্রভাবের চেয়ে কখনো বিতর্কের ঢেউ তোলে। ভেদাভেদ তৈরি করে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সংগ্রামের নাবিকের চেয়ে ভোগকারীর চরিত্রে অবতীর্ণ হয় তরুণদের অনেকেই। তারুণ্যের শক্তির দৈহিক প্রকাশ একটি বয়সের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। এই বয়সে অসমতা, ভেদাভেদের প্রভাবে প্রভাবিত না হওয়া কাম্য। স্বার্থপরতার মন্ত্রে মশগুল হলে দেশের অগ্রগতির সারণিতে স্বতন্ত্রের ধারাগুলো মরীচিকার গর্তে ঢুকে পড়ে। তরুণদের সজাগ থাকতে হয়। সতর্ক জনগণ এগিয়ে থাকার প্রেরণায় আগ্রহ পায়। উৎসুক জনতার মোলায়েম আভাসে দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসবে একীভূত হওয়ার অনুপ্রেরণা দৃষ্টির প্রসারে ছবির মতো উজ্জ্বল। শক্তির মঞ্চে ভিড় করে তরুণদের মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা। অল্প বয়সে অন্যের বা দেশের তরে নিজের শক্তি-সামর্থ্যের বিনিয়োগ ভালোলাগার তরতাজা আমুদে ভাব আনে।
অথবা বয়স যা হোক না কেন, মনের প্রতি পরতে তারুণ্যের ঝাঁকুনি বহমান থাকতে হবে। তবে সংখ্যায় এটি খুব বেশি হবে না। মুখের আলোচনায় অনেক কথা বললেও তারুণ্যের সঙ্গে বয়স ও শরীরের তেজ গভীরভাবে জড়িত। স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরির জন্য একজন পঁচিশোর্ধ্ব তরুণ যে গতিতে কর্ম গর্জন করতে পারে তা একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। যুক্তি কিংবা তক্কাতক্কি থাকতে পারে তবে বাস্তবিক আচারে বিষয়টি মানতে হবে।
একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রকৃতির প্রাচুর্যতার সংকলন বাংলাদেশের সর্বত্র। জীবনপ্রবাহে বহুমুখী বৈচিত্র্য দৃশ্যমান। সংকট সময়ে পরস্পর সহযোগিতার পরশও লক্ষণীয়। তবে এ সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান বৈষম্য কিংবা আদর্শিক বিভাজনের কারণে একত্রিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় রসদের সম্মিলিত আয়োজন থেকে বঞ্চিত। যার প্রভাব পড়ছে তরুণদের আগামী দিনের প্রস্তুতির ওপর। ঐক্যবদ্ধ মিছিলে অংশ না নিয়ে দোষ ধরার মানসিকতা কখনো প্রকট আকার ধারণ করছে। তরুণদের আকৃষ্ট করার মতো সর্বজন গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের প্রকাশ রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে চাপা পড়ে যাচ্ছে। সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্ব বিকাশের জন্য সুযোগ-সুবিধার পরিধি উন্মুক্ত করা এবং অন্যের সাফল্য সহজে মেনে নিয়ে নিজের পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ জরুরি।
দেশের জনসংখ্যার মধ্যে তরুণদের তেজ, সাহসী উদ্যোগ, কিংবা স্বাপ্নিক গতিবেগ পরিবর্তনের অন্যতম পূর্ব-বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাজ করে। তরুণরা পথ দেখাবে, প্রবীণরা অভিজ্ঞতার আলোকে নির্দেশক হিসেবে অনন্য স্থানে থাকবেন। এরূপ চিত্রায়ণ কতোটা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঠামোর অগ্রগতিতে? উত্তর ইতিবাচক হলে অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য, নেতিবাচক উত্তরে ভাবনার আসর আয়োজনের দাবি রাখে। কারণ এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে স্থিতিশীলতা কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভাবনার ভাবার্থ প্রাসঙ্গিকতার নিরীক্ষে নির্ধারণ ও ছড়িয়ে দেয়ার এখনই উত্তম সময়।
লেখক: কবি ও শিক্ষক
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]