নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
রাতের ঢাকায় পরিবহন নৈরাজ্য দেখার কি কেউ নেই?
কাজল ঘোষ
৩ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার
এই শহরের সব খবরই যারা রাখেন তাদের কাছে রাতের ঢাকার এই অব্যবস্থাপনার খবর নেই এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঢাকায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার রাজারবাগের পাশেই রাস্তার দু’পাশ জুড়ে বাসস্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। আরামবাগে পুলিশের একটি ফাঁড়ি রয়েছে মধ্যরাতে যানজটের সময় এই বক্সটি প্রায়ই বন্ধ থাকে। ইত্তেফাক মোড়, দয়াগঞ্জ মোড় এলাকায় সিটি করপোরেশনের লোগো লাগানো একদল কর্মীকে ‘লাঠিয়াল বাহিনী’র মতো বেপরোয়াভাবে ট্রাক, বাস থেকে চাঁদা আদায় করতে দেখা যায়।
কীভাবে শুরু করি, এটাই ভাবছি। সংবাদমাধ্যমে বার্তাকক্ষে কাজের পর চ্যানেল আই’র মধ্যরাতের নিয়মিত একটি টকশোতে সম্পৃক্ততা রয়েছে। টকশোটি খবরের কাগজের প্রথম প্রকাশ নিয়ে। রাত ঠিক বারোটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে চলে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। অনুষ্ঠানটি চলছে সতেরো বছর হয়ে এলো। কথা হচ্ছে এর বিস্তারিত এখানে উল্লেখ করছি কেন? যৌক্তিকতা কি? সেই প্রসঙ্গেই আসি। অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে অতিথি আনা-নেয়া, উপস্থাপককে সময়মতো বাড়ি পৌঁছানো, নিজের বাড়ি ফেরা এতদসংক্রান্ত কাজ তদারকি করতে হয় দৈনিক।
অনুষ্ঠানের দিন রাত নয়টায় কথা হলো সব ঠিক আছে। রাত এগারোটায় তিনি স্টুডিওর উদ্দেশ্যে পথে আছেন তেমনটি জানালেন। গুলশান থেকে মহাখালী হয়ে তেজগাঁও স্টুডিওতে পৌঁছাবেন। তখনো বিষয়টি নিয়ে নির্ভার ছিলাম। কিন্তু যখন সাড়ে এগারোটা বাজে তিনি তখনো পথেই আছেন। একই সময় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মোহাম্মদপুর থেকে রওনা হয়েছেন, তিনিও পথেই আছেন। গুগল ও সহকর্মী চালকদের মারফত জানতে পারি গুলশান থেকে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড পুরো রাস্তাটিই স্থবির হয়ে আছে। অন্যদিকে ফার্মগেট থেকে বিজয় সরণি হয়ে তেজগাঁও লিংক রোড পুরোটাই গাড়ি বসে আছে। একেবারে শেষ বেলায় অর্থাৎ অনুষ্ঠান শুরুর মিনিট পাঁচেক থাকতে উপস্থাপক স্টুডিওতে ঢুকতে পারলেও আলোচক যিনি তিনি মহাখালী বাসস্ট্যান্ড পার হতে পারেননি। সরাসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠানের রীতি অনুযায়ী সময় গণনা শুরু হয়ে গেছে। ট্রান্সমিশন তাগাদা দিচ্ছে অতিথি কোথায়? প্রযোজক হিসেবে ফোনে তাগাদা দিলাম- গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করুন। অতিথি হেঁটে রওনা হয়ে অনুষ্ঠানে যখন পৌঁছান তখন পাঁচ মিনিট কথা বলতে পেরেছেন। আর এর দায় পুরোটাই মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে থাকা এলোপাতাড়ি বাসগুলোর। দেখার কেউ নেই? আরেকদিনের ঘটনা। অতিথি মোহাম্মদপুর জাপান গার্ডেন সিটির বিপরীত থেকে রওনা হয়েছেন সাড়ে দশটার দিকে। অর্থাৎ অনুষ্ঠানের দেড় ঘণ্টা আগে। দফায় দফায় কথা হচ্ছিল অতিথি ও বহনকারী গাড়ি চালকের সঙ্গে।

তাজমহল রোড দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গণভবনের সামনে দিয়ে সংসদের মোড় পার হতে লেগে গেছে এক ঘণ্টা। ফার্মগেট পার হয়ে তেজগাঁও লিংক রোডের ব্রিজ দিয়ে যখন অতিথি স্টুডিওতে পৌঁছান তখন অনুষ্ঠান সেদিনের মতো কাগজের শিরোনাম পড়েই উপস্থাপক ইতি টেনেছেন। ঘটনা কি, কেন এত রাতেও যানজট? ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রাফা প্লাজার সামনে থেকে গাবতলী পর্যন্ত পুরোটাই বাস ট্রাকের দখলে। এ ছাড়া গণভবনের চার ধারে রাস্তায় রাতে যান চলাচল সীমিত করে দেয়া হয়। কিন্তু কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই রাস্তার এই বিশৃঙ্খলা দেখার। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার বাস টিকাটুলি। রাতের অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরতে একটা দেড়টা। বছরের পর বছর এভাবেই পথ চলেছি, কোথাও যানজটে আটকাতে হয়নি। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় বাড়ি ফেরার সময়। তেজগাঁও থেকে যেখানে দশ থেকে পনের মিনিটের পথ তা পেরোতে লেগে যায় প্রায় দেড় ঘণ্টা। দুটি রুটে যাওয়ার পথ। যে পথেই যান না কেন আপনাকে পথ আটকে দেবে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য রাস্তায় এলোপাতাড়ি বা খেয়াল খুশিমতো রাখা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল গাড়িগুলো।
অদ্ভুতভাবে এই পথগুলোতে কোনোদিন ট্রাফিক পুলিশ দেখিনি। গাড়িওয়ালারা ইচ্ছামতো গাড়ি রাস্তায় রেখে যাত্রী উঠাচ্ছে, গাড়ি নিয়ে খেয়াল খুশিমতো পথ আটকে রাখছে, দেখার কেউ নেই? রুট দুটির একটি হচ্ছে মালিবাগ থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন হয়ে কমলাপুর। যদি এই রাস্তাটি আরও এগিয়ে বলি তাহলে কমলাপুর থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত। অন্যদিকে নয়াপল্টন দিয়ে সোজা ফকিরাপুল হয়ে আরামবাগ দিয়ে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত। গাড়ির মালিক, পরিবহন সেক্টরে কর্মরত অসংখ্য মানুষ সকলেই প্রতিদিন নির্বিকারভাবে এই নৈরাজ্য সৃষ্টি করে থাকে। সাধারণ মানুষ প্রত্যহ এই হয়রানির শিকার। এমনও হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কবল থেকে মুক্তি পেতে কেউ যদি উল্টো পথ দিয়ে বের হতে চেয়েছে তাদের বরং পুলিশ আটকে দিয়েছে। কিন্তু তাদের সামনেই যে রাস্তাটিতে অপরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে রাত দশটার দিকে শুরু হয় শহরের চারপাশ থেকে ঢাকায় ট্রাকের প্রবেশ। দানবের মতো বিশাল আকৃতির ট্রাক আর মালবাহী লরি ছুটতে থাকে পুরো শহরজুড়ে। নগরপিতা বা ট্রাফিক সংশ্লিষ্টরা এই বিষয়টি জানেন না- এমনটি ভাবা খুব একটা যৌক্তিক বা সমুচিত হবে না। এই শহরের সব খবরই যারা রাখেন তাদের কাছে রাতের ঢাকার এই অব্যবস্থাপনার খবর নেই- এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঢাকায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার রাজারবাগের পাশেই রাস্তার দু’পাশ জুড়ে বাসস্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। আরামবাগে পুলিশের একটি ফাঁড়ি রয়েছে; মধ্যরাতে যানজটের সময় এই বক্সটি প্রায়ই বন্ধ থাকে।
ইত্তেফাক মোড়, দয়াগঞ্জ মোড় এলাকায় সিটি করপোরেশনের লোগো লাগানো একদল কর্মীকে ‘লাঠিয়াল বাহিনী’র মতো বেপরোয়াভাবে ট্রাক, বাস থেকে চাঁদা আদায় করতে দেখা যায়। যদি এই চাঁদা নগরে প্রবেশের বৈধ কর আদায় হয় তাহলে তারা দলবেঁধে সন্ত্রাসী কায়দায় কেন নিয়ে থাকে? এসব নৈরাজ্য দেখার কেউ কি নেই? যদি থাকে তাহলে তাদের নজরে নেয়া এবং কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। এই শহরটি আমার, আপনার সকলের। আজ যারা অধিক রাতে কাজ করে বাড়ি ফিরে তারা এর শিকার হচ্ছি, যারা তখন বাড়িতে সোফায় বসে গল্প আড্ডায় মত্ত তারাও যে জরুরি দরকারে বাইরে বের হলে বিপদে পড়বেন না তার কি গ্যারান্টি আছে? তার চেয়েও বড় কথা একটা নগরীতে যেকোনো নৈরাজ্য বা অচলাবস্থা সুস্থ বসবাসের জন্য কাম্য হতে পারে না।
যে সকল রাস্তায় যানজট
মালিবাগ থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এলাকা, কমলাপুর থেকে সায়েদাবাদ বিশ্বরোড এলাকা, নয়াপল্টন থেকে ফকিরাপুল হয়ে আরামবাগ দিয়ে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত, পান্থপথ থেকে রাসেল স্কয়ার হয়ে ২৭ নম্বর থেকে শ্যামলী, শ্যামলী থেকে কল্যাণপুর হয়ে গাবতলী, আমিনবাজার পর্যন্ত, বনানী কবরস্থান থেকে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড হয়ে নাবিস্কো-তিব্বত পর্যন্ত। গুলিস্তান থেকে তাঁতীবাজার মোড় দিয়ে ইংলিশ রোড পর্যন্ত। এই রুটগুলোর দু’পাশ কখনো কখনো তীব্র যানজটে আটকে থাকে রাতের ঢাকায়।