ঢাকা, ২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

দূষণের শহরে স্বপ্ন দেখাচ্ছে সবুজ কারখানা

এমএম মাসুদ
৩১ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের মধ্যে অংশীদারিত্বের ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষে ঢাকায় তিন দিনের সফরে এসেছিলেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ। তিনি যখন বাংলাদেশ   সফর করছিলেন তখন বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে ছিল রাজধানী ঢাকা। বায়ুর মান হিসেবে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই স্কোর ছিল ২৫৬ উপরে, যা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বব্যাংকের এমডি’র সফরের অংশ হিসেবে সূচি ছিল গ্রিন কারখানা পরিদর্শন। সেই কারখানায় যাওয়ার রাস্তার অবস্থাও ভালো ছিল না। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের ফোর লেনের কাজ চলছে। মনে হয় দিনেই রাতের ছায়া। এমন পরিবেশে কারখানা পরিদর্শনে যেতে অনেকটা বিরক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান। কিন্তু গ্রিন পোশাক কারখানায় প্রবেশের পর নিমিশেই মিলিয়ে গেল সেই বিরক্তভাব। সেই সঙ্গে বিস্মিত।

বিজ্ঞাপন
বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, এরকম দূষণময় শহরে অত্যাধুনিক সবুজ কারখানা থাকতে পারে! কারখানাটি হলো দেশের পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম টিম গ্রুপের সহযোগী গ্রিন ফ্যাক্টরি ৪-এ ইয়ার্ন ডায়িং ফ্যাক্টরি। কারখানাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) থেকে লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (লিড) প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। কারখানাটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের জ্যাকেট তৈরিতে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। সাভারের বাইপাইলে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা শাখা মিলিয়ে কাজ করছেন ৬ হাজার ৮৩৩ জন। এর মধ্যে নারী কর্মী ৬৯ শতাংশ।  বিজিএমইএ সূত্র জানায়, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১৮৬টি এলইইডি সনদপ্রাপ্ত পোশাক কারখানা রয়েছে। একক দেশ হিসেবে যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। আরও ৫০০’র বেশি কারখানা সনদ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বিশ্বের সেরা ১০টি পরিবেশ সম্মত কারখানার মধ্যে ৭টিই বাংলাদেশে অবস্থিত। দেশে ইউএসজিবি’র সনদ পাওয়া সবুজ কারখানার মধ্যে রয়েছে প্লাটিনাম ৬২টি, গোল্ড ১১০টি, সিলভার ১০টি ও সার্টিফাইড ৪টি। এতে মোট গ্রিন ফ্যাক্টরি বা সবুজ কারখানার সংখ্যা দাঁড়ালো ১৮৬টিতে। পরিদর্শনে বিশ্বব্যাংকের এমডি কারখানার মন্তব্য বইয়ে লিখেছেন, ম্যানি থ্যাঙ্ক ফর অ্যা ভেরি ইন্টারেস্টিং ট্যুর অব দ্য ফ্যাক্টরি। গ্রেট টু সি হাউ ইউ হেল্প মুভ বাংলাদেশ ফরওয়ার্ড। গুড লাক উইথ ইয়োর এক্সপোর্ট ড্রাইভ। অর্থাৎ ‘অনেক ধন্যবাদ, এই কারখানাটি পরিদর্শন খুবই উপভোগ্য হয়েছে। আপনি কীভাবে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিতে চান তা দেখে খুব ভালো লাগছে। একই সঙ্গে রপ্তানি সম্প্রসারণের জন্য আপনার সাফল্য কামনা করছি।’ এর আগে কারখানার ছাদে সৌর বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, কোম্পানির নিজস্ব ডিজাইন ল্যাব, পরিবেশবান্ধব সেলাই ও কাটিং ফ্লোর, ডে কেয়ার সেন্টার ও বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট ঘুরে দেখেন। কারখানা ঘুরে দেখে বিশ্বব্যাংকের এমডি পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপনা প্রশংসনীয় উল্লেখ করে বলেন, এ ধরনের একটি কারখানায় আমন্ত্রিত হয়ে আমি খুবই অভিভূত। এত সুন্দর ব্যবস্থাপনা আগে দেখিনি। বিশেষ করে পরিবেশ, শ্রমিকদের যত্ন ও কাজের পরিবেশ প্রশংসনীয়। এটা সত্যিই উৎসাহব্যঞ্জক।

প্রতিনিধিদলের সদস্যদের কাছে কারখানার কর্মপরিবেশ, শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, কারখানা অবকাঠামো ও জ্বালানি সাশ্রয়ী বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে অবগত করেন ৪-এ ইয়ার্ন ডায়িংয়ের নির্বাহী ডিরেক্টর জাহেদুল ইসলাম। দেশের পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম টিম গ্রুপ। বছরে ৬০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে কোম্পানিটি। বস্ত্র, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি ও আবাসন খাতে ব্যবসা পরিচালনা করছে টিম গ্রুপ। আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে বার্ষিক ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার পোশাক রপ্তানিকারকের খাতায় নাম লেখাতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। কারখানা মাঠে আলাপকালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, আমরা টেকসই পণ্যে বিশ্বাস করি। আমরা সমষ্টিগতভাবে কাজ করে থাকি। কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, একটা কারখানাকে সবুজায়ন করা তার দায়িত্ব, তাহলে তার রাতে ঘুম আসার কথা না। সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে সক্ষমতা অনুযায়ী বিশ্বমান বজায় রেখে এই শিল্পের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। কমপ্লায়েন্সকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, কারখানাগুলোতে যদি কমপ্লায়েন্স পুরোপুরি থাকে, তাহলে পরিবেশগত উন্নয়ন করা সম্ভব হয়। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে শুধু উৎপাদকের খরচ বাড়েনি, বরং এতে সংশ্লিষ্ট সব কিছুর খরচ বাড়ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে সাধারণের ওপর। রুগ্‌ণ কোম্পানিকে সতেজ প্রতিষ্ঠানের রূপ দেয়ায় খ্যাত আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, আমরা ২০০৯ সালে এ প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা কিনে  নেই। যখন আমরা মালিকানায় আসি তখন এটির অবস্থা ছিল রুগ্‌ণ প্রায়। এরপর নতুন করে সবকিছু আমাদের মতো করে গড়ে তুলি। শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের এখানে চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এমন কর্মী রয়েছে ২২ জন। শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের কাজ দেয়া হয়েছে। এভাবেই আমরা কর্মক্ষেত্রকে সবার জন্য উপযোগী করে তুলছি আর পণ্য উৎপাদনে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, ২০২৭ সালের মধ্যে আমরা ১ বিলিয়নের বেশি পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে নাম লেখাতে পারবো। প্রতিষ্ঠানটিতে যেসব সুবিধা রয়েছে: এখানে কর্মরত ৬ হাজার ৮৩৩ জন কর্মীর মধ্যে ৪ হাজার ৭০৭ জনই রয়েছেন নারী। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মীদের জন্য নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। ৪-এ ইয়ার্নে রয়েছে ডে কেয়ার। নারী কর্মীরা ছোট বাচ্চা এখানে রেখে নিশ্চিন্তে কাজে যেতে পারেন। ছোট্ট এ কোমলমতি শিশুদের দেখভালের জন্য নিয়োগ আছে দু’জন। এখানে শিশুদের লেখাপড়া শেখানো হয়। কোম্পানিটিতে কর্মরত সব কর্মীর জন্য রয়েছে সার্বক্ষণিক হেলথ সেন্টার। ১৫টি বেডের এ হেলথ সেন্টারে রয়েছেন ২ জন ডাক্তার ও তাদের সঙ্গে নার্স। কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে যারা গর্ভবতী হন তাদের জন্য আলাদা যত্ন নেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাদের শরীরের যত্নে প্রতিদিন কর্মঘণ্টা থেকে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হয়। ৪এ ইয়ার্নে রয়েছে ফেয়ার প্রাইস শপ।  এ ব্যাপারে ৪-এ ইয়ার্ন ডায়িংয়ের ব্যবস্থাপক (গ্রুপ মানবসম্পদ) খন্দকার মমতাজুল ইসলাম বলেন, বাজার মূল্যের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম দামে আমাদের শ্রমিকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের চাহিদা পূরণ করে আসছি। যখন সারা দেশে তেলে সংকট হয়েছিল, সে সময়ও আমরা নিয়মিত তেল সরবরাহ করতে পেরেছি। প্রতিষ্ঠান ভর্তুকি দিচ্ছে কিনা, এর জবাবে মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক কাওসার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তেমন ভর্তুকি দেয়া লাগে না।  প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত জহুরা খাতুন নামে এক শ্রমিক বলেন, এখানে অনেক ভালো সুযোগ-সুবিধা পাই। মাস শুরু হলে প্রথম দিনই আমরা বেতন পেয়ে যাই। এ ছাড়া নারীদের জন্য এখানে অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। বাচ্চাকে ডে কেয়ারে রেখে এসে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status