শরীর ও মন
প্রসবজনিত ফিস্টুলা- প্রায় ১৯০০০ দরিদ্র নারী দুঃখ, যন্ত্রণা ও হতাশা নিয়ে চিকিৎসার অপেক্ষায়
ডা. ইফতিখার মাহমুদ
(৩ বছর আগে) ২২ মে ২০২২, রবিবার, ৪:১৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৫:১৫ অপরাহ্ন

২০০৯ সালে এশলী উইলিয়ামস নামের একজন মার্কিন ধাত্রী কক্সবাজারের হোপ হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে আসেন। আমি ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামিতে ছিলাম, তখন আমার সাথে এশলী যোগাযোগ করেন, আমি ওনাকে কক্সবাজার হোপ হাসপাতালে আসার ব্যাপারে যাবতীয় সহযোগিতা করি। উনি কক্সবাজারের হোপ হাসপাতালে দুই সপ্তাহ সেচ্ছাসেবী হিসেবে সেবা প্রদান করেন। আমেরিকানরা খুবই ভ্রমণ পিপাসু, এশলীও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি দুই সপ্তাহে কক্সবাজারের আনাচে কানাছে ঘুরেছেন, গ্রামের মহিলাদের সাথে দেখা করেছেন, তাদের সম্পর্কে জেনেছেন, এমনকি তাদের সাথে খাওয়া-দাওয়াও করেছেন। পরে ঢাকায় এক সপ্তাহ ছিলেন, ওনার ভগ্নিপতি মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন,সেই সুবাদে তাদের আতিথ্য গ্রহণ করেন। উনি আমেরিকা ফিরে এসে আমাকে বলেন, তিনি কক্সবাজারের অনেক গ্রামে ঘুরেছেন, বেশকিছু প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর সন্ধান পেয়েছেন। তাদের সাথে কথা বলে ত্রশলী অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়েছেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই মহিলাদের সাহায্য করার জন্য যদি কিছু করতে পারি। সত্যি বলতে কি আমি অত্যন্ত বিব্রত বোধ করলাম, কারণ প্রসবজনিত ফিস্টুলা সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু জানতাম না।
আমার সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিই। কক্সবাজারের মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম এবং সেখানেই প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে চট্টগ্রাম চলে আসি। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে কয়েক বছরের মধ্যেই উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকা পাড়ি জমাই। আমিভাগ্যবান কেননা খুব দ্রুত শিশু স্বাস্থ্য এবং গ্রন্থীবিদ্যায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করে নিজেকে আমেরিকায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি। আমি ছোটকাল থেকেই দেশের সাধারণ মানুষের সাথে কাজ করার কথা ভাবতাম। সেটা আমেরিকা গিয়েও ছিল। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দেবার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে আমেরিক বসেই ১৯৯৯ সালে “হোপ ফাউন্ডেশন ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন অব বাংলাদেশ” নামক একটি অলাভজনক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করি। কয়েক বছরের মধ্যে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দেবার ইচ্ছায় কক্সবাজারে হোপ হাসপাতাল এবং উপকুলীয় অঞ্চলে কয়েকটি ছোট ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করি। আমাদের সংস্থার প্রধান উদ্দ্যেশ্য হলো অবহেলিত মায়েদের এবং তাদের শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।
সুতরাং এশলীর কাছে যখন প্রসবজনিত ফিস্টুলার কথা জানলাম আমি সাথে সাথে এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য দৃঢ় সংকল্প করলাম। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থায় সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করলাম। বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন সংস্থা ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত ফিস্টুলা ফাউন্ডেশন আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। ফিস্টুলা ফাউন্ডেশন এর আন্তরিক সহযোগীতায় ২০১০ সালে হোপ ফাউন্ডেশনে ফিস্টুলা কার্যক্রমের সূচনা হয়। আজকে হোপ ফাউন্ডেশনের প্রসবজনিত ফিস্টুলা কার্যক্রম দেশের বিশাল অংশে মায়েদের প্রসবজনিত ফিস্টুলা চিকিৎসা সম্পুর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করে যাচ্ছে।
২৩শে মে “আন্তর্জাতিক ফিস্টুলা দিবস”। প্রসবজনিত ফিস্টুলা একটি ক্ষত যেটা প্রজনন অঙ্গ এবং মূত্রাশয় এবং/অথবা মলদ্বারের মধ্যে একটা গর্তেও সৃষ্টি করে, এর ফলে অনবিত প্রস্রাব/পায়খানা নির্গত হয়। এটা সাধারণত হয় দুর্গম অঞ্চলের দরিদ্র গর্ভবতী মায়েদের। যদি কোন কারণে গর্ভবতী মায়েদের বাচ্চা প্রসবে অতিরিক্ত বিলম্ব হয় তখন সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রয়োজন হয়। অর্থাভাবে ও দূরত্বের কারণে অথবা অন্য যে কোন কারণে দ্রুত সিজারিয়ান ডেলিভারী না করতে পারলে বাচ্চা গর্ভবস্থায় মারা যায় বা মারা যেতে পারে। মৃত বাচ্চা অনেকক্ষণ জরায়ুর ভিতরে থাকার ফলে প্রজনন অঙ্গের বিভিন্ন স্থানে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় প্রসব পথের বিভিন্ন অংশ পচেঁ যায় ফলে ফিস্টুলার সৃষ্টি হয়।
ফিস্টুলা একটি অত্যন্ত শারীরিকভাবে বেদনাদায়ক, মানসিকভাবে ক্ষতিকর ব্যাধি। অনবরত মূত্র এবং মল ঝরার কারণে ফিস্টুলা আক্রান্ত মায়েরা শারীরিকভাবে স্বামীর সাথে সম্পর্ক রাখতে অক্ষম। এবং তাদের শরীরে সারাক্ষণ প্রচ- দুর্গন্ধ থাকে। প্রায় সব ক্ষেত্রে তাদের স্বামী তাদের পরিত্যাগ করে, এমনকি উনারা বাবা/মা বা অন্যান্য নিকট আত্বীয়দের কাছেও আশ্রয় পান না। সমাজের প্রত্যেক স্তরেই তারা নিগৃহীত হন। উনারা প্রায় সবাই কর্মহীন, অনেক সময় ভিখারির জীবন বেছে নেন।
আগেই বলেছি, প্রসবজনিত ফিস্টুলা দরিদ্র মহিলাদের রোগ। এর প্রকোপ ঊনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিম দেশগুলিতে অনেক ছিলো, তবে উন্নতমানের প্রসূতি সেবার কারণে এটি উন্নত বিশ্বে প্রায় আজকাল দেখা যায় না। বাংলাদেশ এবং উন্নয়নশীল দেশে যেখানে মাতৃস্বাস্থ্য পিছিয়ে রয়েছে সেখানে প্রসবজনিত ফিস্টুলা একটি উল্লেখযোগ্য অসুস্থতা হিসেবে টিকে আছে। সাধারণতঃ প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ মহিল তিনদিন বা বেশি সময় ধরে প্রব যন্ত্রণা সহ্য করেন। এই মহিলারা প্রায়শঃ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যারা গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাস করেন এবং যাদের ভালো স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ নাই। আর্থিক অসুবিধা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীংয় রক্ষণশীলতাক ইত্যাদি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করার অন্তরায় হয়ে থাকে। প্রায়শঃ তাদের গর্ভধারণ এবং প্রসবের জন্য গ্রামীণ দাই-মা অথবা পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নেয়া হয়। এদের অনেকেই কোন প্রসবকালীন সেবা পান না। অতএব, তাদের গর্ভস্থ শিশুর আকার, অবস্থান এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সম্পর্কে কোন পূর্ববর্তী ধারণা না থাকায় ডেলিভারি যে বাধাগ্রস্ত হতে পারে বা সিজারিয়ান এর প্রয়োজন হতে পারে এ ব্যাপারে কোন পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় না।
ফিস্টুলা আক্রান্ত মেয়েদের ক্রমাগত মল/মূত্র নির্গত হওয়া ছাড়াও আরও অনেক ধরনের অসুবিধা হয় যেমন-কিডনি রোগ, পায়েও স্নায়ুর ক্ষতির কারণে হাটার অসুবিধা ইত্যাদি।
গ্রামীণ জনপদের যেখানে স্বাস্থ্য সচেতনতা কম সেখানে প্রসবজনিত ফিস্টুলা সর্ম্পকে ভালো ধারণা না থাকায় এটাকে এক ধরনের নিয়তির অভিশাপ মনে করা হয় এবং ভুক্তভোগীদেরকে সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে বরঞ্চ দায়ী করা হয় এই ভয়াবহ অসুস্থতার জন্য। পরিবার, বন্ধু, সমাজ সবাই ফিস্টুলা রোগীদের দূরে ঠেলে দেয়, এড়িয়ে যায়, অপমান করে। তাদেরকে সবাই সামাজিক ও পারিবারিক বোঝা মনে করেন। একজন ফিস্টুলা রোগীর যে ধরনের মানসিক বিষন্নতা, উদ্ব্যেগ এবং অশান্তি অনুভব করেন সেটা খুবই ভয়াবহ।
বাংলাদেশে প্রকৃত পরিমাণ ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা জানা নেই, তবে ২০১৬ সালের এক সমীক্ষায় অনুমান করা হয় যে, দেশে প্রায় ১৯০০০ ফিস্টুলা আক্রান্ত মহিলা আছেন এবং প্রতি বছর প্রায় ১০০০ মহিলা নতুনভাবে গর্ভজনিত ফিস্টুলা আক্রান্ত হন। এই ধরনের ফিস্টুলা আক্রান্ত মহিলাদের অনেকেই কয়েক দশকধরে এই সমস্যায় ভুগছেন। বিশ^ব্যাপি প্রায় ২০ লক্ষ মহিলা প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত।
প্রসবজনিত ফিস্টুলা চিকিৎসা সাধারণত অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে করা হয়। যদি ফিস্টুলা হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়া যায় তখন বিনা সার্জারিতে এন্টিবায়োটিক দিয়ে এবং মূত্রথলিতে কয়েক সপ্তাহ catheter দেয়ার মাধ্যমে ভাল করা সম্ভব। কিন্তু যাদের ফিস্টুলা দীর্ঘ সময় ধরে আছে তাদের চিকিৎসা অপারেশন ছাড়া একেবারেই অসম্ভব। ফিস্টুলা অপারেশন জটিল এবং দক্ষ সার্জনরাই একমাত্র এই অপারেশন করতে পারেন। বাংলাদেশে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন চিকিৎসক আছেন, যারা ফিস্টুলা অপারেশন এ ট্রেনিং প্রাপ্ত এবং দক্ষ। সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৭টি হাসপাতালে ফিস্টুলা সার্জারী করা হয়, এর মধ্যে কক্সবাজারের হোপ হাসপাতাল উল্ল্যেখযোগ্য। হোপ হাসপাতালে দক্ষ ফিস্টুলা সার্জনের নেতৃত্বে অভিজ্ঞ ফিস্টুলা সেবা টিম হয়েছে যাদের মধ্যে আছেন অভিজ্ঞ নার্স , ফিজিকেল থেরাপিস্ট, মাঠকর্মী , কাউন্সেলিং টিম। অপারেশনের পর ফিস্টুলা রোগী সুস্থ হলে উনাদের অব্যাহত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং পুনর্বাসন সাহায্য প্রয়োজন যাতে করে তারা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে যেতে পারেন ।
ফিস্টুলা সার্জারী ব্যয়বহুল, গরীব রোগীদের দ্বারা এই ব্যয়বহনকরা অসম্ভব। হোপ ফাউন্ডেশনসহ দেশের অন্যান্য হাসপাতালের প্রায় সবখানেই ফিস্টুলা অপারেশন বিনামূল্যে করা হয়, যা দাতা সংস্থার সাহায্যের মাধ্যমে সম্ভব হয়। বাংলাদেশে অন্যান্য যেসব প্রতিষ্ঠান ফিষ্টুলা অপারেশন করেন তারা হলে ল্যাম্ব হসপিটাল , ম্যামস্ ইনিস্টিউট, কুমুদিনি হসপিটাল, আদদ্বীন হসপিটাল, বিএসএমএমইউ সহ কয়েকটি সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ সরকার ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ এর টেকনিক্যাল সহায়তায় ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ফিস্টুলা মুক্ত করার একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রতিষ্ঠান হোপ ফাউন্ডেশন সমগ্র চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার ফিস্টুলা মুক্ত করার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে ২০১৮ সাল থেকে এবং বর্তমানে একটি ১০০ বেডের নতুন মেটারনিটি ও ফিস্টুলা হাসপাতাল নির্মাণের কাজ করছে যেখানে ফিস্টুলা সার্জারির পাশাপাশি দেশি-বিদেশী চিকিৎসকদেরকে ফিস্টুলা অপারেশনের বিশেষায়িত ট্রেনিং প্রদান করা হবে।
উল্লেখযোগ্য যে, ফিস্টুলা অপারেশন করে ভুক্তভোগী মায়েদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদেরকে অবশ্যই প্রতিরোধের দিকেও নজর দিতে হবে। এই লক্ষ্যে মানসম্মত মাতৃত্ব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে সার্বজনীনভাবে। সকল মায়েরা, তারা যেখানেই থাকেন না কেন, একজন দক্ষ মিডওয়াইফ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে যাতে করে সব মেয়েরা গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসব এবয় প্রসবোত্তর সেবা পান। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমান মিডওয়াইফ প্রশিক্ষিত করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওনাদের কাজের ব্যবস্থা করলেই একমাত্র সার্বজনীন মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।
আমরা অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে পারি, বাংলাদেশ সরকার মাতৃ স্বাস্থ্যে অসাধারণ অগ্রগতি সাধন করেছে এবং এই কৃতিত্বের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এখন সরকারি, বেসরকারি সংস্থাসহ সবার সহযোগিতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় দেশের সমস্ত ফিস্টুলা রোগীকে চিকিৎসার আওতায় এনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ফিস্টুলা মুক্ত করা সময়ের দাবি।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট, হোপ ফাউন্ডেশন ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন অব বাংলাদেশ।
e-mail:[email protected]