ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি গণশুনানি এবং ক’টি প্রশ্ন

শুভ কিবরিয়া
১৬ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার
mzamin

ক্যাবের যুক্তি হচ্ছে চলমান সিস্টেমের অপচয়-অবচয় কমালে, ভর্তুকির যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত হলে, জাতীয় নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের ওপর ভোক্তার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করে সর্বজনীন মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হলে এবং অসাধু আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্য খর্ব করে জনকর্তৃত্বমূলক সুনীতি গৃহীত হলে, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা অবশ্যই রোধ করা সম্ভব। ক্যাব বছরের পর বছর ভোক্তাদের পক্ষে বলে আসছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে খরচের বহুখাত অন্যায়, অযৌক্তিক এবং লুণ্ঠনমূলক


গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আবার বেড়েছে। বিদ্যুতের পাইকারি দাম সরকার আগেই বাড়িয়েছে। নির্বাহী আদেশে এ দাম বাড়ানো হলো। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতো। সেই প্রক্রিয়া হচ্ছে দাম পরিবর্তন করতে হলে যেসব প্রতিষ্ঠান দাম পরিবর্তন করতে চায় তারা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নামে একটা প্রতিষ্ঠানের কাছে দরখাস্ত করে। বিশেষ করে নিজে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যে প্রতিষ্ঠান এবং সবার উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনে যে প্রতিষ্ঠান সেই পিডিবি (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) দাম পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তিতর্ক নিয়ে বিইআরসি’র কাছে আবেদন করে। বিইআরসি তার নিজের একটা কমিটি দিয়ে সেটা মূল্যায়ন করে। সেই কমিটিকে বলে বিইআরসি’র কারিগরি কমিটি।  এরপর বিইআরসি গণশুনানি নামে একটা উন্মুক্ত মিটিং আয়োজন করে।

বিজ্ঞাপন
সেই মিটিংয়ে পিডিবি বিদ্যুতের পাইকারি দাম পরিবর্তনের পক্ষে তার যুক্তি উপস্থাপন করে। বলতে থাকে এই কারণে এবার বিদ্যুতের পাইকারি দাম পরিবর্তন দরকার। তারপর বিইআরসি’র কারিগরি কমিটি তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। এরপর যারা ভোক্তা বা বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী তারা একে একে এসে পিডিবি’র দেয়া প্রস্তাবকে প্রশ্ন করতে থাকে। পিডিবি’র কর্মকর্তারা তার উত্তর দিতে থাকেন। এই প্রশ্নোত্তর-পর্ব পরিচালনা করে বিইআরসি’র চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পুরো কমিশন।

 কমিশনে থাকে অতিরিক্ত আরও বেশ কয়েকজন সদস্য। ভোক্তাদের পক্ষে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এই গণশুনানিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম গত কয়েক বছর ধরে ভোক্তাদের পক্ষে এই প্রশ্নোত্তর পর্বের মূল ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। বিদ্যুৎ যারা ব্যবহার করেন এমন বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও এ অনুষ্ঠানে তাদের প্রশ্ন করেন, মতামত দেন ও বিবৃতি জানান।  একসময় দেশের বাম রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও গণশুনানিতে অংশ নিতেন। এখন তারা সেটা বয়কট করেছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে বিইআরসি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ না করে সরকারের অঙ্গুলি হেলনে চলে। বিইআরসি’র স্বাধীন সত্তা দেখতে না পেয়ে তারা হতোদ্যম হয়েছেন। তারা মনে করেন রাষ্ট্র সংস্কার না করে এরকম ছোটখাটো উদ্যোগে থাকাটা তাদের সময়েরই অপচয়। ফলে এখন তারা অনুপস্থিত থাকেন। এই শুনানি যেহেতু উন্মুক্ত সেহেতু মিডিয়া এটা ভালোভাবে কভার করে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক এবং অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী তা জানতে পারে। এই শুনানির পর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩, অনুসারে ৯০ দিনের মধ্যে বিইআরসি বিদ্যুতের পাইকারি দামের পরিবর্তনের পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত জানায়। পাইকারি দাম পরিবর্তনের পর যেসব প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ করে যেমন পিডিবি নিজে, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, নেসকো, ডেসকো, ডিপিডিসি, ওজোপাডিকো তারা স্ব  স্ব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বিদ্যুতের দাম পরিবর্তনের জন্য বিইআরসিতে আবার আবেদন করে। 

 

 

বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী প্রতিষ্ঠান পিজিসিবিও তার বিদ্যুৎ সঞ্চালন খরচ পরিবর্তনের জন্য বিইআরসিতে আবেদন করে। বিইআরসি একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিদ্যুতের খুচরা দাম পরিবর্তন করে। সেটাই ভোক্তার ওপরে পড়ে। সেই দাম দিয়েই সকল ভোক্তা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। তবে একটা জিনিস লক্ষণীয়  বিদ্যুৎ, গ্যাস তথা জ্বালানির দাম যখন বাড়ে, তখন সরকারি তরফে বলা হয়, দাম বাড়ানো হচ্ছে না, আর্থিক ঘাটতি সমন্বয় করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানির দাম বাড়ে এবং আর্থিক ঘাটতি বেশি হয় তখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে- এমন ব্যাখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ বা জ্বালানির দাম যখন বছরের পর কম থাকে, তখন দেশে বিদ্যুৎ বা জ্বালানির দাম কমে না। আবার বাংলাদেশ এনার্জি  রেগুলেটরি  কমিশন (বিইআরসি) যখন গণশুনানি করে, তখন তারা বলে, মূল্যহার পরিবর্তনের প্রস্তাবের উপর গণশুনানি করছে। এই মূল্যহার পরিবর্তনের বাস্তবিক অর্থ একটাই, কেবলমাত্র ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য বাড়ানো। ফলে সকল পর্যায়ে জনগণের মনে ধারণা হয়েছে, আসলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম কখনই কমে না, কেবল বাড়েই। এই ধারণা আজ অবধি ভুল প্রমাণিত হয়নি। 

মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের উপর অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বহুবার বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে। খরচের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে ক্যাব বারংবার দেখিয়েছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বজায় রেখে কারিগরি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার মান উন্নত করে, দুর্নীতি বা লুণ্ঠন ব্যয়বৃদ্ধি ঠেকাতে পারলে, জনবান্ধব পরিকল্পনা নিয়ে জনস্বার্থে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়ন কৌশল গৃহীত হলে বিদ্যুতের দাম বাড়ে না। ক্যাবের যুক্তি হচ্ছে চলমান সিস্টেমের অপচয়-অবচয় কমালে, ভর্তুকির যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত হলে, জাতীয় নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের ওপর ভোক্তার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করে সর্বজনীন মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হলে এবং অসাধু আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্য খর্ব করে জনকর্তৃত্বমূলক সুনীতি গৃহীত হলে, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা অবশ্যই রোধ করা সম্ভব। 

 ক্যাব বছরের পর বছর ভোক্তাদের পক্ষে বলে আসছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে খরচের বহুখাত অন্যায়, অযৌক্তিক এবং লুণ্ঠনমূলক। এখানে যে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় হয়, যে লুণ্ঠনমূলক মুনাফার ব্যবস্থা চলমান আছে তা অপসারিত হলে ঘাটতি সমন্বয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যহার বারবার এত বেশি বেশি বাড়ানো লাগে না। কখনো কখনো কমানোও সম্ভব। বাস্তবে সেটা কখনোই হয় না।  একসময় বিইআরসি আইনে ছিল বছরে একবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো যাবে। সরকার সেটা না মেনে এক বছরে দু’বার দাম বাড়ায়। ভোক্তারা আদালতে তা চ্যালেঞ্জ করলে সরকার সেই বর্ধিত দাম প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তার পরপরই সরকার আইনে সংশোধন আনে। তাতে তারা বলে প্রয়োজনে বছরে একাধিকবার দাম বাড়াতে পারবে।  সমপ্রতি ঘটেছে আরও একটি মজার ঘটনা। সংসদ উপেক্ষা করেই গত ১লা ডিসেম্বর ২০২২ বাংলাদেশ এনার্জি কমিশন রেগুলেটরি আইন ২০০৩ রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে আবার সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বিইআরসিকে উপেক্ষা করে সরকার নিজেই এখন সকল প্রকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম পরিবর্তন করতে পারবে। অর্থাৎ বিদ্যুতের বা জ্বালানির দাম বাড়াতে চাইলে একটা কাগজে ঘোষণা দিয়েই সরকার তা করতে পারবে। কোনো গণশুনানির আর দরকার হবে না। নতুন জারিকৃত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এই আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন সরকার গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ, পুনঃনির্ধারণ বা সমন্বয় করতে পারবে। খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনায় সরকার এটাই করেছে। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status