দেশ বিদেশ
দেখার কেউ নেই
৬ বছর ধরে পানির নিচে খান সাহেব ওসমান আলী আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম
বিল্লাল হোসেন রবিন, নারায়ণগঞ্জ থেকে
৯ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার
দীর্ঘ ৬ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামটি পানির নিচে তলিয়ে আছে। আউটার স্টেডিয়ামের অবস্থাও একই। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় এটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ব্যবহার না হওয়ায় অযত্ন আর অবহেলায় স্টেডিয়ামের মূল গ্রাউন্ড, গ্যালারিসহ সবকিছু ধ্বংসপ্রায়। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় স্টেডিয়ামের ভেতরে মাদকসেবীদের আড্ডা জমে উঠেছে। চুরি হয়ে গেছে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের অনেক যন্ত্রাংশ। খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামটি আইসিসি অনুমোদিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। এই মাঠটি নারায়ণগঞ্জকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। ২৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামটি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্মিত হয়। ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্টেডিয়ামটির উদ্বোধন করেন। ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু করে। ওই বিশ্বকাপের উদ্দেশ্যেই সংস্কার করা হয়েছিল মাঠটি। ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে এই মাঠে ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তানের মধ্যে একটি প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ হয়েছিল। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ প্রতিযোগিতার অন্যতম প্রধান ক্রিকেট মাঠ। ২০০৬ সালের ৯ই এপ্রিল বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ম্যাচের মাধ্যমে শুরু হয় স্টেডিয়ামটির টেস্টের ইতিহাস। ২০১৫ সালের বাংলাদেশ বনাম ভারতের টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। সবশেষ ২০১৬ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি এই স্টোডিয়ামে গড়িয়েছে আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মধ্যকার শেষ কোয়ার্টার ফাইনাল। সরজমিন স্টেডিয়ামের চারপাশ ঘুরে দেখা যায়, মাঠের চারদিকে জলাবদ্ধতা আর জলজ উদ্ভিদে ছেয়ে গেছে। দেখে মনে হবে যেন এক টুকরো দ্বীপ। কলকারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত পানি থৈ থৈ করছে। ঝোপ-জঙ্গলে ছেঁয়ে গেছে চারপাশ। স্টেডিয়ামের লিংক রোড সংলগ্ন গেট দিয়ে প্রবেশের শুরুতেই দেখা যায় ময়লার স্তূপ। পানি নিষ্কাশনের ক্যানেলটিও ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। রাস্তার পাশে থাকা ড্রেন থেকে মানুষের মল এই রাস্তার ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। বছরের পর বছর এভাবেই আটকে আছে পানি। জমে থাকা পানি এখন নানা পোকামাকড় আর মশার আতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। দুর্গন্ধের পাশাপাশি ছড়াচ্ছে রোগ জীবাণু। স্টেডিয়ামের ৫টি প্রবেশ পথের ৪টি পানিতে। গত ৬ বছর ধরে স্টেডিয়ামটি পানির নিচে রয়েছে। ২০১৬ সালের পর এখানে আর ক্রিকেট গড়ায়নি। কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও নির্মিত এই স্টেডিয়ামটির অবকাঠামো পরিণত হয়েছে ধংসস্তূপে। স্টেডিয়ামের কমেন্ট্রি বক্স ও অন্যান্য স্থাপনা ভাঙাচোরা। গ্যালারিতে দর্শকদের রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর ছাউনি ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। স্টেডিয়ামটির দক্ষিণ পাশেই অবস্থিত ইনডোর। ইনডোরেরও বেশিরভাগ কাঠামো ভেঙে গেছে। প্রেসবক্স ও কমেন্ট্রিবক্সে লাগানো এসিগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ আসবাবপত্রে ধরেছে মরিচা। নষ্ট হয়েছে পানির ব্যবস্থাপনা। সর্বশেষ এই মাঠে খেলার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের। তবে জলাবদ্ধতার কারণে পণ্ড হয়েছিল এই ম্যাচটি। বছরের বেশির ভাগ সময় এই স্টেডিয়ামটি পানি ও কচুরিপানার নিচে নিমজ্জিত থাকে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। অযত্নে অবহেলায় বছরের পর বছর ধরে জলাবদ্ধতাসহ অবকাঠামোগুলো ভঙ্গুর হয়ে গেলেও তা সংস্কারে কার্যকরী উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। ক্রিড়াবিদ মোসলেউদ্দিন বলেন, কর্মকর্তাদের অবহেলা ও অযত্নের কারণে স্টেডিয়ামটি খেলার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নারায়ণগঞ্জের ক্রিকেটার নাফিজ বলেন, স্টেডিয়ামটি জুড়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি দেখে হতাশা ছাড়া আর কোনো উপলব্ধি আসে না। ইনডোরে জাতীয় লীগ হতো আর আউট ডোরে নারায়ণঞ্জের ডিভিশন লীগ হতো। কিন্তু পুরো মাঠে পানি জমে থাকায় এখন কোনো খেলা হয় না। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ জেড এম ইসমাঈল বাবুল বলেন, দুর্নীতি আর অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণের কারণেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে কয়েক বছর আগে ক্রীড়ামন্ত্রী মাঠটি পরিদর্শন করেছেন। স্টেডিয়ামটি তৈরিতে নকশারও ত্রুটি ছিল বলে তিনি দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, বুয়েট থেকে ৭-৮ জনের এক দল প্রকৌশলী মাঠ পরিদর্শন শেষে মাঠের উন্নয়নে একটি প্রজেক্ট তৈরি করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিলেন বলে শুনেছি। সেখান থেকে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করি অতি শিগগিরই মাঠটি সংস্কারে জন্য একটা বাজেট পাস করা হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান বলেন, স্টেডিয়ামের বর্তমান অবস্থা দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমিও ব্যর্থ। গত ৪-৫ বছর ধরে একটি কথাই শুনছি যে বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল নাকি এটিকে নিয়ে কাজ করছে। যদি বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের ৫ বছর লাগে পানি নিষ্কাশন করতে তাহলে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। শামীম ওসমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্টেডিয়ামটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য লোক আছে। তারা কী করলেন। স্টেডিয়ামের অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। দামি যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে গেছে। আবার রাতের আঁধারে ভেতরে মাদকের আড্ডা বসে। স্টেডিয়ামটির বর্তমান অবস্থার জন্য কষ্টের পাশাপাশি লজ্জা পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।