ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

বহুমাত্রিক মোবাশ্বের হোসেন

শুভ কিবরিয়া
৮ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার
mzamin

তার এই বহুমাত্রিক জীবনের গূঢ়ার্থ কি জানতে চাইলে তিনি একটা অদ্ভুত সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ধরুন আগ্নেয়গিরিতে আগুন দগদগ করছে। কেউ ফুটা করেনি বলে আগুন বাইরে আসতে পারেনি। কিন্তু কেউ না কেউ ফুটা করবে। ক্ষুদিরামকে কেউ কি বলেছিল যে, তুমি বোমা ফাটালে দেশ দুই দিনের মধ্যে স্বাধীন হবে। কিন্তু আমি মনে করি ক্ষুদিরামের অবদানের জন্য দেশ এক ঘণ্টার জন্য হলেও আগে স্বাধীন হয়েছে। আমার কোনো কাজে দেশ এক ঘণ্টার জন্যও যদি আগে উন্নত হয় সেটাই আমার অর্জন। রাতারাতি পরিবর্তন হতে চাওয়াটাই বোকামি। একটা গাছ লাগিয়ে ফল পেতে হলে সময় দিতে হবে


স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন (১৯৪৩-২০২৩) তখন চিরনিদ্রায়। তার অতিপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের মনোরম সবুজ প্রান্তরে চলছে তাকে অন্তিম শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন।

বিজ্ঞাপন
নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। ফুলে ফুলে ভরে উঠছে তার কফিন। একটু দূরে বসে আছি আমরা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মৃদুস্বরে বেদনার্ত গলায় বললেন, ‘তার হৃদয়টা খুব পিওর ছিল। খুব শুদ্ধ অন্তরের মানুষ ছিলেন তিনি।’ এই কথা শুনে আমার মনে হলো একবার ২০১২ সালে নিউজ ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক’-এর জন্য এক সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মৃত্যু নিয়ে আপনার ভাবনা কি? হাসতে হাসতে বললেন, ‘একটা মজার কথা বলি। জার্মানির বার্লিনে গেছি স্থপতিদের এসোসিয়েশনের এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে। সেখানে হঠাৎ আমার হার্ট অ্যাটাক হলো। আমার হার্টে ৯টি রিং পরানো হয় (স্টেনটিং)। এটি একটি রেকর্ড। এতগুলো রিং পরা হার্ট আপনি খুঁজে পাবেন না। অথচ তার এক মাস আগে সিঙ্গাপুরে গিয়ে চেকআপ করে এসেছি। হার্ট অ্যাটাকের কোনো লক্ষণই ছিল না। এসব নিয়ে যখন আমার পরিবার চিন্তা করে তখন তাদের আমি বলি, যদি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মারা যেতাম। আমার অনেক বন্ধুই তো মারা গেছে। আমাকে আল্লাহ হয়তো কিছু করার জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন। গিন্নিকে বলেছি তোমরা ধরে নাও আমি এখন মৃত। কেননা আমার তো মারা যাওয়ার কথা ছিল মুক্তিযুদ্ধেই।’ 

এই উপলব্ধি ছিল তার মজ্জাগত। ফলে সামাজিক কাজে তার ভয়ডর ছিল কম। বহু কাজে নানাভাবেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছি কিন্তু কখনো তাকে শঠতার আশ্রয় নিতে দেখিনি। আর্থিকভাবে উনি খুবই ধনী ছিলেন না, কিন্তু পরার্থে সহায়তা করার ক্ষেত্রে সবসময় অগ্রণী ছিলেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের উপদেষ্টা আমাদের সবার প্রিয় অঞ্জন দা তখন হাসপাতালে। ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি যাওয়ার সময় বাসে পেট্রোল বোমার আঘাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। বার্ন ইউনিটে তার জীবন সংশয়ে। আমরা সবাই হতবিহ্বল। সায়ীদ স্যার সেই সময়ে দেশের বাইরে। হাসপাতালে যেয়ে মোবাশ্বের ভাই ঘোষণা দিলেন, অঞ্জনকে যদি বিদেশে নিয়ে যেতে হয় আমরা নেবো। যত টাকা লাগে আমরা ব্যবস্থা নেবো। কিন্তু তার চিকিৎসার সর্বোচ্চটাই করতে হবে। বিপদে মানুষের পাশে এভাবেই সাহস জোগাতেন তিনি। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক কর্তৃপক্ষের অন্যায় রোষানলে চাকরি হারালেন। আদালতে জোরদার মোকাবিলা দরকার। অনেকেই তার পাশে দাঁড়ালেন। ভালো আইনজীবীর জন্য ভালো পয়সা দরকার। আমরা নানাজনের সহায়তা প্রত্যাশা করছি। একদিন তিনি চ্যানেল আই অফিসে এসে সাংবাদিক-সম্পাদক গোলাম মোর্তোজার হাতে একটা বড় অঙ্কের ক্যাশ টাকা দিয়ে গেলেন। বললেন টাকা কে দিয়েছে এটা কাউকে জানানোর দরকার নেই। 

 

 

 জীবনের শেষ দশকে উনি কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সঙ্গে ভোক্তাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। ভোক্তাদের নানাবিধ অভিযোগ নিষ্পত্তির কাজে একটা আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফরম তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি জাতীয় কমিটি, ক্যাব’র আহ্বায়ক হিসেবে অনেকগুলো আইনি লড়াইয়ে আবেদনকারী ছিলেন। ভোক্তাদের স্বার্থে আদালতে যেকোনো মামলা করতে চাইলে স্বেচ্ছায় তিনি আবেদনকারী হতেন। ভোক্তাস্বার্থে মামলা মানেই মোবাশ্বের ভাই। উচ্চ আদালতে প্রায় ২০টার মতো জনস্বার্থ মামলার তিনি আবেদনকারী। একবার রসিকতা করে বললাম আদালত-উকিল দেখলে লোকে দূরে সরে যায়। আপনি এত মামলাবাজ হলেন কীভাবে? মুখে সেই হাসি, তারপর জোর গলায় বললেন, ‘মামলা-আদালত নিয়ে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা হলো গোপীবাগে আমাদের বাসায় এক অবাঙালি ভাড়া থাকতো। মূলত তাকে উচ্ছেদ করতে গিয়েই প্রথম মামলা করতে হয়েছে। এই মামলা নিয়ে আমি একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি। আমার মামলা পরিচালনা করতেন যে দুইজন আইনজীবী তার একজন হচ্ছেন এডভোকেট ইদ্রিস সাহেব। আরেকজন হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান।

 এই মামলার মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতির পরিবারের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক হয়েছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, আজ পর্যন্ত আমি কোনো মামলায় পরাজিত হইনি।’ এটা ২০১২ সালের কথা। এরপর মোবাশ্বের ভাই জনস্বার্থে বহু রকম মামলায় জড়িয়েছেন এবং কোনোটাতেই পরাজিত হন নাই। পেশাদার স্থপতি ছিলেন। অনেকগুলো বড় সৃজনশীল স্থাপত্যকর্ম নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্থপতিদের সংগঠন নিয়ে প্রাণপাত করতেন। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট ছিল তার প্রাণ। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন ছাত্রজীবনে। মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা অপারেশনে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা এলেই স্মৃতিকাতর হতেন। দেশ নিয়ে একটা অসম্ভব উচ্চতর ভাবনা ভাবতেন। কখনো তাকে হতাশ হতে দেখিনি। একটা প্রবলতর পরার্থপর মন ছিল। দেশের জন্য মানুষের জন্য তার মন কাঁদতো। পরার্থে কিছু একটা করার ব্যাপারে সব সময় সক্রিয় ছিলেন।  ভালো ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ছিলেন। এগুলোর বাইরে তার ছিল একটা ক্রীড়াপাগল মন। খেলাধুলার বিষয়ে অসম্ভব আগ্রহী ছিলেন। আমাকে একবার বলেছিলেন, যত রকম কাজের সঙ্গেই যুক্ত থাকি না কেন, ক্রীড়া ও ক্রীড়ার উন্নয়নে যুক্ত থাকতেই বেশি আনন্দ পাই। নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত উক্তি, ‘The sports has the power to change the world. It has the power to unite people in a way that little else does’ তার খুব প্রিয় ছিল। মোবাশ্বের ভাই কথা বলতে খুব ভালোবাসতেন। আমরা যখন তাকে কোথাও কোনো বড় অফিসে বড় কর্তার কাছে কাজে নিয়ে যেতাম, সতর্ক থাকতে হতো যাতে কথার তোড়ে মূল বিষয়টিই ভুলে না যান। একটা শিশুর মতো সরল মন ছিল। বহু বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে বাহাস করা যেতো। ভিন্নমত তোলা যেতো অবলীলায়। মানুষকে খুব সম্মান করতেন। ছোট-বড় ভেদ করতেন না। যাদের অপছন্দ করতেন সেটাও লুকাতেন না। জোর গলাতেই বলতেন। কখনো কোনো বিষয়ে ভুল কিছু বলে ফেললে, বুঝতে পারলে, ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে বিন্দুমাত্র কসুর করতেন না।

  মোবাশ্বের ভাই’র প্রয়াণ তাই আমাদের জন্য একটা বিরাট ক্ষতি। শেষদিকে তিনি টেলিভিশনে বহু বিষয়ে কথা বলতেন। এই টকশো জীবন তাকে দেশব্যাপী পরিচিতি এনে দেয়। এই সূত্রে কিছু শত্রুও তিনি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেসবের কেয়ার করতেন না। টিভির টকশো খুব এনজয় করতেন। মনে করতেন কথা বলাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মাঝে মাঝে তার শেওড়াপাড়ার স্থাপত্যফার্মে আমাদের খুব অন্তরঙ্গ কথা হতো। আমি বলতাম বহুদিকে না ছড়িয়ে স্থাপত্যকাজে আরও বেশি মনোযোগী হলে ভালো হতো। উনি সেটা মানতেন না। বিশ্বাস করতেন সবদিকেই একটু একটু করে হলেও আলো ফেলা দরকার। এই বোধটাই তাকে সজীব সচল রেখেছিল। একটা বড় জীবন পেয়েছিলেন। জীবন নিয়ে বেপরোয়াও ছিলেন। খুব গর্ব করতেন সেটা নিয়ে। খাবার-দাবারের নিয়ম খুব একটা মানতেন না। একবার বলেই ফেললাম, হার্টে এতগুলো রিং, মাঝে মাঝেই হাসপাতালে যান, অথচ নিয়ম মানেন না। বললেন, এত দামের ওষুধ খাই কেন তাহলে?  মোবাশ্বের ভাই কথা দিলে কথা রাখতেন। না রাখতে পারলে ‘সরি’ বলতেন। এটা ছিল তার ভীষণ বড় গুণ। দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। দেশকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। তার বৃহত্তর পরিবারের অনেকেই বৃটিশ পাসপোর্টধারী। কিন্তু তিনি সে সুবিধা নিতে রাজি হন নাই, পরিবারের চাপেও। নিজের মেয়ের বিয়ে দেয়ার সময়, জামাইকে দেশেই থাকতে হবে, প্রবাসে সেটেলড করা যাবে না, এই শর্ত দিয়েছিলেন।  লেখার শুরুতেই বলেছি, তার একটা আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তার এই বহুমাত্রিক জীবনের গূঢ়ার্থ কি জানতে চাইলে তিনি একটা অদ্ভুত সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ধরুন আগ্নেয়গিরিতে আগুন দগদগ করছে। 

কেউ ফুটা করেনি বলে আগুন বাইরে আসতে পারেনি। কিন্তু কেউ না কেউ ফুটা করবে। ক্ষুদিরামকে কেউ কি বলেছিল যে, তুমি বোমা ফাটালে দেশ দুই দিনের মধ্যে স্বাধীন হবে। কিন্তু আমি মনে করি ক্ষুদিরামের অবদানের জন্য দেশ এক ঘণ্টার জন্য হলেও আগে স্বাধীন হয়েছে। আমার কোনো কাজে দেশ এক ঘণ্টার জন্যও যদি আগে উন্নত হয় সেটাই আমার অর্জন। রাতারাতি পরিবর্তন হতে চাওয়াটাই বোকামি। একটা গাছ লাগিয়ে ফল পেতে হলে সময় দিতে হবে।’ মানুষ ত্রুটিমুক্ত নয়। দেবতাও নয়। সে কারণেই সে মানুষ। মোবাশ্বের ভাই নিশ্চয়ই ত্রুটিমুক্ত নন। কিন্তু ত্রুটিগুলো ছাপিয়ে গুণগুলোই প্রতিভাত হয়েছিল তার জীবনে। সেগুলোকেই বড় করে তোলার জন্য মেহনত করেছেন আজীবন। 

 লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status