প্রথম পাতা
নয়া বাস্তবতায় অর্থনীতি, সামনে আরও চ্যালেঞ্জ
এম এম মাসুদ
২৭ ডিসেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার
নিত্যপণ্য আর জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে চলতি বছরের শুরু থেকেই অর্থনীতি নিয়ে ছিল নানা দুশ্চিন্তা। সঙ্গে যুক্ত হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব। ডলারের চরম সংকট, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, রিজার্ভে টান পড়া নিয়ে বছরজুড়েই ছিল আলোচনা। রিজার্ভের হিসাব নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রশ্ন তোলাও ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। তবে বছরের শেষ দিকে কয়েকটি ব্যাংকে ঋণ অনিয়মের অভিযোগ আর ব্যাংক খাতে টাকা নেই- এমন গুজব সবার মুখে মুখে আলোচনার বিষয়বস্তু পরিণত হয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখন যুক্ত হয়েছে অনিশ্চয়তা। আগামীতে আরও চ্যালেঞ্জ আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বছরজুড়ে চালের দাম ছিল বেশ চড়া। ফলে মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। আবার বছরের শেষের দিকে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর প্রভাবে বৃদ্ধি পায় পরিবহন ভাড়া। এতে আরেক দফা দাম বাড়ে নিত্যপণ্যসহ প্রায় সবকিছুরই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২২ সাল ছিল অনিশ্চয়তার বছর। এটা ছিল বিশ্বব্যাপীই। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের মধ্যদিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। দেশে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা কখনোই খুব ভালো ছিল না। এ খাতে নজরদারি ছিল দুর্বল, খেলাপি ঋণের হার ছিল উচ্চ, সরকারি ব্যাংকের ছিল মূলধন ঘাটতি। আর সাম্প্রতিক প্রবণতা হচ্ছে নামে-বেনামে নেয়া ঋণ। বছরের শুরুতে ডলার নিয়ে চরম সংকট ছিল। তবে বর্তমানে নানামুখী উদ্যোগে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে তৎপর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এদিকে ব্যাংকে টাকা নেই- এমন গুজব কিছুটা সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। সাধারণ মানুষের আস্থাও সামান্য বেড়েছে। তারপরও ব্যাংক খাত যত আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ছিল বছরজুড়ে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মতে, সার্বিকভাবে অর্থনীতির যে চাঙ্গাভাব আশা করছি, তা আগামীতে অব্যাহত থাকবে, এমন আশা করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশ বিশ্বের বাইরে নয়। বাংলাদেশকে সামনের দিনে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যেও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এতে মানুষের নাভিশ্বাস বেড়ে যাবে।
সূত্র মতে, বছরের শুরুর দিকে দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট দেখা দেয়। চাপে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এতে রিজার্ভের পরিমাণও দিন দিন কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪০০ কোটি (৩৪ বিলিয়ন) ডলারের আশপাশে ওঠানামা করছে। এ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ কয়েকটি তহবিলে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলার। এ বিনিয়োগ করা অর্থ বাদ দিলে রিজার্ভ থাকে ২৬০০ কোটি (২৬ বিলিয়ন) ডলার, যা দিয়ে বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত আমদানির মধ্যে সাড়ে চার মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব। অর্থাৎ খরচ করার মতো রিজার্ভ এখন ২৬ বিলিয়ন ডলার। এর আগে সরকারের আমদানি দায় পরিশোধে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রির পরিমাণ ৬০৫ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কিনেছিল প্রায় ৭৯৩ কোটি ডলার। ডলার সংকট এড়াতে আমদানি ব্যয়ের চাপ কমাতে বিলাসীপণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের খোলাবাজারেও ডলার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ ওঠে। এমন অভিযোগে পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ৪২টি মানি এক্সচেঞ্জকে শোকজ করা হয়েছে। আরও ৯টি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের সংকটকে পুঁজি করে অনৈতিক সুবিধা নেয় ১২ ব্যাংক। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার মজুত করে বড় অঙ্কের মুনাফা করে তারা। এসব অভিযোগের কারণে ব্যাংকগুলোর এমডিদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রিজার্ভ অব্যাহত কমার প্রক্রিয়াকে সরকার স্বাভাবিক বললেও এ নিয়ে নানান সমালোচনা শুরু হয়। সরকারবিরোধীরা রিজার্ভে টান পড়ায় বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হতে পারে বলেও বিভিন্ন সময় আশঙ্কা জানায়।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসলে কতো, রিজার্ভ গেল কোথায়? এসব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে। এমন প্রেক্ষাপটে আইএমএফ বাংলাদেশের রিজার্ভ সংরক্ষণের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে রিজার্ভের হিসাব রাখাসহ বেশকিছু সংস্কারের পরামর্শ দেয় আইএমএফ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাতে সায় দেয়।
এদিকে ব্যাংক খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯.৩৬ শতাংশ। ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও (এনবিএফআইএস) ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি ১০ লাখ টাকা।
এদিকে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধে বেশ কয়েক দফা ‘বিশেষ ছাড়’ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার করোনার পাশাপাশি বন্যা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবারো ছাড় দেয়া হয়। ছাড়ের মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। ফলে ঋণের কিস্তি পুরোপুরি পরিশোধ না করেও খেলাপি হওয়া থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন গ্রাহকরা। তবুও কমছে না ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। উল্টো আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৯৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। ফলে উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ৮ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার বেশি।
ওদিকে ঋণ জালিয়াতির কারণে তারল্য সংকট দেখা দেয় ইসলামী ব্যাংকগুলোতে। গ্রাহকরা আস্থা সংকটের কারণে টাকা তুলে নিতে থাকেন। চলমান তারল্য সংকট কাটাতে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে তারল্য সহায়তা হিসেবে নগদ টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে গত ১২ই ডিসেম্বর দু’জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ৭৫৫ কোটি (৭.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৩ টাকা ৮৫ পয়সা ধরে) এর পরিমাণ ৭৮ হাজার ৩১০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সুশাসন বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকে কঠোর হতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর না হলে ব্যাংক খাতে কোনো দিনই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বা আদায়ে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এ খাতের খেলাপি ঋণ দিন দিন আরও বাড়বে। ছাড় দেয়ার সিস্টেমও বন্ধ করতে হবে।