ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

লিওনেল ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ মেসি অমরত্ব নয়, শ্রেষ্ঠত্বেও অনন্য

তালহা বিন নজরুল
২০ ডিসেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার
mzamin

ইয়েস! মেসি উইন্‌স, আর্জেন্টিনা উইন্‌স। দু’হাত উপরে তুলে গলাফাটা চিৎকারে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলো বাপ আর ছেলে দু’জনই। বাদ যায়নি ছেলের মা-ও। টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকারের গলা যেন এক কাঠি উপরে। হোয়াট এ ফিনিশ! হোয়াট এ ফাইনাল! এমেইজিং আর্জেন্টিনা। দমবন্ধকরা শুটআউটের শেষ শটটিতে ফরাসি গোলরক্ষক পরাস্ত হওয়ার পরই দম ফাটানো চিৎকার। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো মধ্য রাতে। দেশজুড়ে রাতের আঁধার চিরে রাস্তায় নেমে এলো লাখো তরুণ। বিশ্বজুড়েই আর্জেন্টিনা সমর্থকদের উল্লাস চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্ল্লোগানে আনন্দ-উল্লাসে যতটা না আর্জেন্টিনার নাম তার চেয়ে বেশি উচ্চারিত হলো একজনের নাম।

বিজ্ঞাপন
মে..সি, মে..সি, মে..সি, মে..সি। আর্জেন্টিনার চেয়েও বড় হয়ে ফুঠলো লিওনেল মেসির নাম। দলের অধিনায়ক, বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় দু’দশকের বেশি সময় ধরে। ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে, অথচ চারবার খেলে ফেলেছেন বিশ্বকাপ। ফাইনালে উঠেও কাপে হাত রাখতে পারেননি। সমালোচকদের কত শত খোঁচা। এরই মধ্যে তাদের আইডল দিয়েগো ম্যারাডোনাও চলে গেছেন পরপারে। সেই ১৯৮৬ সালে যার হাত ধরে বিশ্বকাপ সর্বশেষ শিরোপা জিতেছে আর্জেন্টিনা। এর পর দু’বার ফাইনালে খেলেও (১৯৯০, ২০১৪) জয় আসেনি। সমর্থকদের অনেকেই হতাশ। আর কবে হবে? তবে হালও ছাড়েননি অনেকে। কাপ জিতুক আর না জিতুক স্বপ্নের নায়ক মেসির পাশে তারা থাকবেনই। নায়কতো নায়কই। দল ২২ জনের, মাঠে নামেন ১১ জন। তবুও সব আশা একজনকে ঘিরেই। হারলে সব দায় যেন তারই। কী আর করা! হতাশার চোটে অবসরের ঘোষণা দিয়েও সমর্থকদের ভালোবাসার কাছে হার মানতে হয় তাকে। আবার ফেরেন মাঠে। হাল ধরেন দলের। কোপার সাফল্যে কিছুটা যেন স্বস্তির ছোঁয়া। এরপরে টানা অপরাজিত থাকতে থাকতে আবার আশা দানা বাঁধতে থাকে। কিন্তু বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই হার। কি, লজ্জা! অনেকটা কুঁকড়ে যায় আর্জেন্টনার সমর্থকরা। 

তবে মাঠের বাইরে যে যাই ভাবুন খেলোয়াড়দেরতো আর থেমে থাকা যায় না। হতাশ হলে চলবে না, মাঠ ছেড়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই যে নেই। এটা তাদের রুটি-রুজিরও প্রশ্ন। তাই বাড়তি উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মাঠে নামতে হয় পরের খেলায়। সামর্থ্যের পুরোটা নিংড়ে দিয়ে শেষ অব্দি লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। সেই লড়াকু মন নিয়েই একের পর বাধা টপকে উপরে উঠতে থাকে দল। শেষ পর্যন্ত সাফল্য নিয়ে দেশে ফিরছেন আর্জেন্টাইন ফুটবল যোদ্ধারা। কোয়ার্টার ফাইানালে নেদারল্যান্ডস ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। ম্লান হয়ে যাচ্ছিল মেসির সব প্রচেষ্টা। সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া কোনো বাধা তৈরি করতে পারেনি। ফাইনালে শুরুটাও ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু ডাচ্‌দের মতো ফরাসিরাও খেলায় ফিরে আসে একইভাবে। একবার নয় দু’বার। আশঙ্কাটা জেঁকে বসে তখনই। কিন্তু না, বিধাতার ভাবনাটা ছিল ভিন্ন। ভাগ্য যদি সহায় থাকে তবে আর ঠেকায় কে? কোটি  কোটি মানুষের আকুল প্রার্থনা যেন ফেলতে পারলেন না বিধাতা। সেই গোলরক্ষক মার্টিনেজের দারুণ দক্ষতায় পরাস্ত হলো ফরাসিদের সকল আক্রমণ। ইতিহাসে তৃতীবারের মতো বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলো আর্জেন্টিনা। এ জয়টা বিশ্বজোড়া ফুটবলপ্রেমিদের কাছে বেশি চাওয়া ছিল একমাত্র যার জন্য তিনি হলেন মেসি। আর মেসিও তার সামর্থ্যের শতভাগ দিয়ে প্রমাণ করেছেন সর্বকালের সেরা তাকে মানতেই হবে। তিনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন অমরত্বের জন্য আর কি চাই? অমরত্ব আর শ্রেষ্ঠত্ব এক নয়। তো, মেসির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কি আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে? চরম শত্রুও মেসির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। না, বিশ্বকাপ না জিতলে যে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নের মুখে পড়তো তা বলা ঠিক হবে না। তাকে অনেক আগেই ভিন গ্রহের কোনো খেলোয়াড় হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এবার তিনি যা করেছেন তা তার শ্রেষ্ঠত্বকে অকাট্য করেছে।

মেসির মেসি হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে উঠে আসতো দু’জনের নাম। সব তর্ক আর বিতর্র্ক সীমাবদ্ধ থাকতো ব্রাজিলের পেলে আর  আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনার মধ্যে। বেশ কিছুদিন আগেই তাদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন মেসি। স্থানটা এবার কেবল পাকা হলো। এখান থেকে যে কেউ তাকে সহজে সরাতে পারবেন না। ইউরোপিয়ান সংবাদ মাধ্যমও বলতে বাধ্য হয়েছে যে, মেসি সর্বকালের সেরা কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও সেরাদের একজন যে তিনি তাতে আর কথা চলে না। কেন এই স্বীকারোক্তি? শিরোপা জয়ের পথে মেসি কী কী অর্জন করেছেন তা যদি আপনার হিসাব কষা নাও থাকে তবে সাদা চোখে যারা খেলা দেখেছেন তারা দেখেছেন এবং বুঝেছেন তিনি কী করেছেন। একেবারে একক প্রচেষ্টায় ফুটবল খেলা হয় না বটে। তবে মেসি যেভাবে নিজে খেলেছেন এবং দলকে খেলিয়েছেন তাতে বলার অপেক্ষা রাখে না কী অসাধারণ দক্ষতায় প্রতিপক্ষের সব জাল ছিন্ন করেছেন। তিন যুগ আগে ম্যারাডোনা যেভাবে একক নৈপুণ্যে খেলার পর খেলায় দলকে টেনে নিয়ে গেছেন ঠিক সেভাবেই যেন খেললেন মেসি। নিচ থেকে উপর পর্যন্ত দৌড়েছেন কী অফুরান প্রাণশক্তি নিয়ে। নিজে গোল করেছেন এবং অন্যদের দিয়ে করিয়েছেনও। ৩৫ বছর পেরিয়ে যাওয়া একজন খেলোয়াড় যে ঝলক দেখালেন তাতে অবাক হয়ে গেছেন তার চেয়ে ১০ বছরের ছোটরাও। 

শুধু ছোট দু’টি অর্জনই তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। প্রথমত: তিনি হলেন- ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি বিশ্বকাপের দু’টি আসরে গোল্ডেন বল জিতলেন অর্থাৎ সেরা হলেন। ২০১৪তে আর্জেন্টিনা ফাইনালে হারলেও আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পান লিওনেল মেসি।
দ্বিতীয়ত: মেসিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি কোনো আসরের পাঁচটি খেলায় সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে তিনি এই পুরস্কার পান। আরেকটি অর্জনও তিনি এবার করেছেন আর তা হলো কোনো আসরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়েই গোল করা। মেসি এবার গ্রুপ পর্ব, দ্বিতীয় রাউন্ড, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনালেও গোল করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এথন তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ৩৫ বছর পার হওয়ার পরেও ফাইনালে দু’টি গোল করার কৃতিত্ব দেখালেন। অনেকে সমালোচনা করেন যে, মেসি এবার পেনাল্টি থেকেই বেশি গোল করেছেন। কিন্তু ফাইনাল যারা দেখেছেন তারা স্বীকার করবেন কীভাবে তিনি নিজের দ্বিতীয় গোলটি করে অতিরিক্ত সময়ে আর্জেন্টিনাকে আবার এগিয়ে নেন। ডি মারিয়া যে গোলটি করলেন তা কার সুবাদে?  মেসি বিশ্বকাপে ১৩টি গোল করেছেন পাশাপাশি আরও আটটি গোলে তার অবদান আছে। ১৯৬৬ সালের পরে আর কোনো খেলোয়াড়ের এ কৃতিত্ব নেই। এরপরে আর নিশ্চয়ই কোনো কথা থাকে না।

মেসি তার ক্যারিয়ারে যতগুলো প্রতিযোগিতায় একাধিকবার অংশ নিয়েছেন তার সবক’টিতেই শিরোপা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছেন। জিততে পারেননি কেবল কোপা ডি ফ্রান্স শিরোপা। কারণ এ আসরে তিনি মাত্র একবারই অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া কোপা আমেরিকা, কোপা দেল রে, বিশ্ব ক্লাব কাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, উয়েফা কাপ, স্প্যানিশ লীগ, স্প্যানিশ সুপার লীগ, ফ্রেঞ্চ লীগ। সব ট্রফিই আছে তার শো কেসে।

ভক্তদের ভালোবাসার মূল্যায়ন করতেও ভোলেন না মেসি। বিশ্বকাপে ফাইনালের আগে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অবসরে চলে যাওয়ার। কিন্তু শিরোপা জেতার পরে সরে এসেছেন সে সিদ্ধান্ত থেকে। বললেন, আর্জেন্টিনার হয়ে আরও কিছুদিন খেলা চালিয়ে যেতে চান। বিশ্বকাপে হয়তো আর খেলা হবে না এই মহানায়কের কিন্তু বিশ্বকাপ যতদিন থাকবে ততদিন তার নাম উচ্চারিত হবে সমীহের সঙ্গেই। মেসির সময়ে আরেকজন তারকা তার পাশাপাশি হেঁটেছেন অনেক দিন কিন্তু সেই রোনালদো কী সমান আসনে নিজেকে বসাতে  পেরেছেন? রোনালদো নিজেকে অনেকবারই সেরা হিসেবে বলার চেষ্টা করেছেন। মনে হয় না এখন আর তা বলবেন। ক্লাব ফুটবলে যেমন তেমন আন্তর্জাতিক ফুটবলে মেসির পাশে দাঁড়াতেও পারবেন না সিআর সেভেন।
মেসির মতো খেলোয়াড় যুগে যুগে জন্মায় না। তাদের জন্ম শতাব্দিতেই কদাচিৎ দেখা যায়।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status