নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
চমকে ভরা বিশ্বকাপের শেষটা হোক আরও স্মরণীয়
তালহা বিন নজরুল
১২ ডিসেম্বর ২০২২, সোমবার
সেমিফাইনালে ফ্রান্সের মুখোমুখি হবে তারা। খুবই কাছের দেশ। অনেক মরোক্কানের বসবাস ফ্রান্সে। কোয়ার্টার ফাইনালের সবচেয়ে বড় খেলায় বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা হারায় ইংল্যান্ডকে। ইংলিশরা সেই কবে ১৯৬৬ সালে নিজেদের মাটিতে শিরোপা জিতেছিল। এরপরে আর ফাইনালে উঠতে পারেনি তারা। এবার অনেক শক্তিশালী দল ছিল তারা। কিন্তু ওই যে ভাগ্যেরও সহায়তা লাগে। না হয় যে হ্যারি কেইন গোল করে দলকে একবার সমতায় ফেরান সেই কেইন পেনাল্টিতে বলটি বারের উপর দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন
বিশ্বকাপে কাঁপছে বিশ্ব বা বলতে পারেন বিশ্ব কাঁপাচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। আনন্দ-বেদনায় ভরপুর। একদিকে উচ্ছ্বাস আরেকদিকে দীর্ঘশ্বাস। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে। কী ভেবেছিলেন আর কী দেখছেন। পাল্টে যাচ্ছে সব হিসাবনিকাশ। একেকটি দিন যাচ্ছে আর একেকটি নক্ষত্রের পতন ঘটছে। পণ্ডিতেরা বলছেন একরকম আর মাঠের খেলায় ফল হচ্ছে আরেক রকম। পাটি গণিতের সরল অঙ্কের মতো। সবার জানা থাকে যে ফল হবে ১। কিন্তু ধাপে ধাপে দেখেশুনে না এগুলে ফল মিলবেই না। সব শেষের কথাই ধরুন। কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার আগে খোদ আয়োজক সংস্থা ফিফা যা বললো তার পুরোটাই ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল। দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত খেলা দেখে তাদের কাছে মনে হয়েছে ব্রাজিলই সেরা। বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা নেইমার বাহিনীরই বেশি। দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিল যেভাবে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়েছে তাতে এর সঙ্গে দ্বিমত করার লোকও ছিল না। ফিফা র্যাঙ্কিংয়েও তারা এক নম্বর অনেক দিন। কিন্তু কী দেখলো বিশ্ব? রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই পর্তুগালের খেলোয়াড়রা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আর মরক্কোর খেলোয়াড়দের বাঁধভাঙা উল্লাস। ধারাভাষ্যকারের উচ্ছ্বাসভরা চিৎকার। হোয়াটএ ওয়ার্ল্ড কাপ! এমেইজিং! নেইমার আউট, আউট রোনালদো।
কোয়ার্টার ফাইনালের আগের দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, যিনি দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার সঙ্গে, ফাইনালের সম্ভাব্য একটা লাইন আপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন ব্রাজিল-ফ্রান্স, ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনা বা ইংল্যান্ড-ব্রাজিল, ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা এমনভাবে তিনি ১২টি বা ১৪টি সম্ভাবনার কথা লিখলেন। কিন্তু একটি বারের জন্যও তিনি ক্রোয়েশিয়া বা মরক্কোর নাম একবারও আনেননি। এ দুটি দল যে কোয়ার্টার ফাইনালের বাধা পেরোতে পারবে এমন বিশ্বাসই ছিল না তার। কেবল তিনি কেন অতি সংশয়বাদীরাও ভাবেননি যে ব্রাজিল বা পর্তুগাল হারতে পারে। দ্বিতীয় রাউন্ডে কী দাপুটে জয়ই না পেয়েছিল এই দুই দল। ৪-১ আর ৬-১ গোলে সহজ জয়। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয় বিশ্ব। ব্রাজিল আর পর্তুগাল বিদায় নিলো পরপর দু’দিনে।
বিস্ময়ের কি আরও বাকি আছে? একটা ঘোর কাটতে না কাটতেই আরেকটা ঘোরের শুরু। ক্রিকেটকে বলা হয় রহস্যময় খেলা। তার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে অনিশ্চয়তা। তবে ফুটবলকে কি বলবেন? এখানেও কি কম অনিশ্চয়তা। ম্যাচের মোড় ঘুরতে কি খুব বেশি সময় লাগে? কাগজে কলমে এগিয়ে থাকলেই কোন দলের জয় কি নিশ্চিত বলা যায়, না কি সেই দল সহজে জয়ের বেশে মাঠ ছাড়তে পারছে। এখানেই তো খেলার সৌন্দর্য। না হয় কোনো মজাই থাকতো না খেলার। তা যে খেলায়ই হোক না কেন? জয়টা ছেলের হাতের মোয়া নয়। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট মাঠে সেরাটা দিতে না পারলে জয় অধরাই থাকবে। ভাগ্য? হ্যাঁ, অবশ্যই। ভাগ্যে না থাকলে যত কারিশমাই দেখান না কেন কাজ হবে না।

ব্রাাজিলের হার আর মরক্কোর জয়কে কী বলবেন। তারকায় ভরা দল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এবারো ছিল হট ফেভারিট। এবারের বিশ্বকাপের ধারাটা কিন্তু একটু হলেও ভিন্ন বলতে হবে। গ্রুপ পর্যায়েই হার দেখেছে অনেক বড় বড় দল। বিদায় নিয়েছে অন্যতম ফেভারিট জার্মানি আর বেলজিয়াম। এরপরে বিদায় নেয় স্পেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে অন্যদের জয় খুব বিস্ময়ের ছিল না। যদিও জাপানের হারটা অস্বাভাবিক না হলেও এশিয়ানদের জন্য ছিল দুঃখজনক। তারা শেষ পর্যন্ত ছিল লড়াইয়ে। ভাগ্যের কাছে হেরে যায় তারা। সেই খেলায় হারতে হারতে জিতে যাওয়া ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারে ব্রাজিল। এদিনও কি ক্রোয়েশিয়া ভাগ্যের সহায়তা পায়নি? অবশ্যই পেয়েছে। নির্ধারিত সময়ে গোল দিতে না পারাটা ব্রাজিলের ব্যর্থতা ছিল বটে। কিন্তু যে সময়ে নেইমার গোল করে দলকে এগিয়ে দেন তখনতো খেলার বাকি ছিল মাত্র তিন মিনিট। এই তিন মিনিট যদি তারা ক্রোয়াটদের আটকে রাখতে পারতো তবে কি আর ব্রাজিলিয়ানদের মাথা হেট করে মাঠ ছাড়তে হয়। কিন্তু বিধি বাম। দর্শকদের পয়সা-উসুল করা খেলায় গোল করে ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে নিয়ে যায় ক্রোয়াটরা। প্রথম শটটি মিস করে ব্রাজিল পিছিয়ে যায়। এর পরেও সুযোগ ছিল। যে শটে খেলার মীমাংসা হয় সে শটটি কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক বুঝতেই পারেননি। তাতে কি? ওই যে ভাগ্য, বল গিয়ে আঘাত হানে সাইডবারে। তারপরেও বলটি ভেতরে যেতে পারতো, যায়নি। কারণ, ব্রাজিল হারবে এটিই ছিল নিয়তি। আগামী চার বছর ব্রাজিলিয়ানদের এই দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়াতে হবে। বাংলাদেশেরও অর্ধেক ফুটবল সমর্থকের বিশ্বকাপ আনন্দ মিইয়ে গেছে। তাদের জ্বালা আরও বেড়েছে আর্জেন্টিনার জয়ে। দক্ষিণ আমেরিকান প্রতিবেশীরা এবার হার দিয়ে শুরু করলে অনেকেই হতাশ ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা উঠে এসেছে শেষ ধাপে। অনেকটা মেসি নির্ভর দল হয়ে তারা নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে যখন ২-০ গোলে এগিয়ে যায় তখন কে ভেবেছিল খেলা গড়াবে অতিরিক্ত সময়ে। অদম্য ডাচ্রা সেখান থেকে অল্প সময়ে দুই গোল করে খেলায় ফিরে আসে। কিন্তু ভাগ্যে না থাকলে হয় কী করে। একইদিন ঘণ্টা চারেক আগে ব্রাজিল টাইব্রেকারে হারলেও আর্জেন্টাইনরা ঠিকই জয় নিয়ে ফেরে। আর এতেই বেশি বিপত্তি আমাদের দেশে। শুরু হয় পাল্টাপাল্টি খোঁচাখুঁচি। তির্যক বাক্যবানে নাজেহাল করেছে একে অপরকে। মারামারির খবরও মিলেছে। আসলে যে যাই করুন মাত্রা ছাড়ালেই বিপদ।
কোয়ার্টার ফাইনালে এসে বিস্ময় বাড়ে মরক্কোর জয়ে। মজার ব্যাপার হলো আট গ্রুপের খেলায় মরক্কো আর ক্রোয়েশিয়া ছিল একই গ্রুপে এবং প্রথম খেলাতেই একে অপরের মোকাবিলায় গোলশূন্য ড্র করে। এই গ্রুপেই মরক্কো ২-০ গোলে হারায় দুই নম্বরে থাকা বেলজিয়ামকে। তবে ক্রোয়েশিয়া বেলজিয়ামের সঙ্গে ড্র করেছিল। চার দলের মধ্যে মরক্কোই একমাত্র অপরাজিত দল। অনেক কষ্ট করে টাইব্রেকারে স্প্যানিশদের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে মরক্কো। কিন্তু পর্তুগালকে তারা পরাস্ত করে নির্ধারিত সময়ের গোলেই। পর্তুগাল যত ভালোই খেলুক গোল আদায় করতে পারেনি। কোচ-রোনালদো দ্বন্দ্বের প্রভাব কি খেলায় পড়েছিল? পড়লে পড়তেও পারে। কিন্তু ৩৭ বছর বয়সী রোনালদোও তো তার সেরা সময়েই ফাইনাল খেলতে পারেননি। অদম্য দুর্দান্ত মরক্কো আরও চমক যদি দেখায় তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। আরব দেশে প্রথম আয়োজিত বিশ্বকাপে প্রথম আরব দেশ হিসেবে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো মরক্কো। এটাই যেন এ আসরের একটি মাইলস্টোন। যেমন ২০০২ এ এশিয়ান আসরে দক্ষিণ কোরিয়া খেলেছিল সেমিফাইনালে। সেবার অপর সেমিফাইনালে খেলা তুরস্কের পর এই মরক্কোই মুসলিম দেশ হিসেবে খেলছে সেমিফাইনালে। তুরস্ক এর আগে আরও একবার ১৯৫৪ সালে সেমিফাইনালে খেলেছিল। মরক্কো যাতে আরও একধাপ উপরে উঠতে পারে সেজন্য পুরো বাংলাদেশের সমর্থকরা তাদের জন্যই প্রার্থনায় থাকবে তা নিশ্চিত বলা যায়।
সেমিফাইনালে ফ্রান্সের মুখোমুখি হবে তারা। খুবই কাছের দেশ। অনেক মরোক্কানের বসবাস ফ্রান্সে। কোয়ার্টার ফাইনালের সবচেয়ে বড় খেলায় বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা হারায় ইংল্যান্ডকে। ইংলিশরা সেই কবে ১৯৬৬ সালে নিজেদের মাটিতে শিরোপা জিতেছিল। এরপরে আর ফাইনালে উঠতে পারেনি তারা। এবার অনেক শক্তিশালী দল ছিল তারা। কিন্তু ওই যে ভাগ্যেরও সহায়তা লাগে। না হয় যে হ্যারি কেইন গোল করে দলকে একবার সমতায় ফেরান সেই কেইন পেনাল্টিতে বলটি বারের উপর দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। গোলরক্ষক পরাস্ত কিন্তু বল উড়ে গেল বারের ওপর দিয়ে। ভাবা যায় কি নির্মম পরিহাস! খেলায় আর ফিরতে পারলো না ইংলিশরা।
ক্রোয়েশিয়া গতবারের রানার্স আপ। শেষ পর্যন্ত আগের বারের দুই ফাইনালিস্ট কিন্তু এখনো বহাল আছে এবং এবারো তারাই ফাইনাল খেললে কি আপনি বিস্মিত হবেন? নিশ্চয়ই না। তবে আর্জেন্টিনাকে হারাতে হবে ক্রোয়াটদের। কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব কি? মোটেও না। ২০১৪ সালের পর আবার সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা। সেবার ফাইনালে তারা হারে জার্মানির কাছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মোহনীয় মেসির শেষ বিশ্বকাপে তার শত্রুও চাইবে আর্জেন্টিনা জিতুক। তৃতীয় বিশ্বের একমাত্র প্রতিনিধি ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনার জয় মানে তো কোটি বাংলাদেশিরও জয়। ব্রাজিলকে হারানো ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে খেলায় ব্রাজিলের সমর্থকরা থাকবে পাশে?