ঢাকা, ২২ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৭ চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, ২৯ শাবান ১৪৪৪ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

ভেতর বাহির

১০ই ডিসেম্বর কার জয়, কার পরাজয়?

ডা. জাহেদ উর রহমান
১১ ডিসেম্বর ২০২২, রবিবারmzamin

বিএনপি বিভাগীয় জনসমাবেশগুলোর ঘোষণা দেয় তখন কিছু আপাত উদ্ভট কৌশল  নেয় সরকার। বিএনপি জনসভায় জনসমাগম কমানোর জন্য প্রত্যেকটি জনসভার দুই দিন আগে থেকে পরিবহন এবং ক্ষেত্রবিশেষে নৌ ধর্মঘট ডাকা হয়। জনসভার সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয় যেন সে জনসভাগুলোর প্রচার ঠিকমতো না হয়। কিন্তু কোনোটিতেই উপচে পড়া ভিড় ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে এই কথাটাও আমরা মনে রাখবো প্রতিটি জনসভা হয়েছে অসাধারণ শান্তিপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খল


১০ই ডিসেম্বরকে ঘিরে কী হবে, না হবে সেটা নিয়ে দীর্ঘদিন আলাপ চলেছে। দেশের সবগুলো বিভাগে বিভাগীয় জনসভাগুলোর শেষটি ঢাকায় নির্ধারিত হয়েছিল বেশ আগেই দশ ডিসেম্বর। কিন্তু হঠাৎ করে পাল্টে যায় দৃশ্যপট- বিএনপি’র একজন নেতা জনাব আমানল্লাহ্‌ আমানের বক্তব্যে। আমান বলে বসেন ১০ই ডিসেম্বরের পর থেকে দেশ চলবে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের কথায়। মুহূর্তেই তার দল থেকে আমানের এই বক্তব্য প্রত্যাহার করা হয় এবং জানা যায় জনাব আমানকে সতর্ক করা হয় এই বিষয়ে। কিন্তু কথা থেমে থাকে না, কথা চলতে থাকে।

বিজ্ঞাপন
এরপর ছড়িয়ে পড়ে বেগম জিয়া ১০ই ডিসেম্বরের সমাবেশে যোগ দেবেন এমন আলাপ।  নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে এমন জমজমাট পরিস্থিতি মিডিয়া লুফে নেয়ার কথা, নিয়েছেও। মিডিয়াই নানাভাবে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল- কী হতে যাচ্ছে ১০ই ডিসেম্বর। এই  লেখাটা যখন লিখছি তখন ১০ই ডিসেম্বরের জনসভা চলছে। ঢাকার গোলাপবাগ মাঠে জনসভা হওয়ার আগে কী কী হয়েছে এগুলো আমাদের স্মৃতিতে একেবারেই তাজা। নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভা করার বিএনপি’র দাবি সরকার মেনে নেয়নি।

 সরকার একেবারে জনসভা করতে দেবে না- এই পর্যায়ে এখন আর নেই। বলা বাহুল্য এটা সরকারের কিছুটা গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠা না, এটা বরং সরকারের ওপরে প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক চাপের ফলাফল।  বিএনপিকে সরকার সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার অনুমতি দিয়েছিল। অবশ্য রাস্তায় গাড়ি পার্ক না করা, রাস্তায় মাইক না লাগানো, মিছিল করে জনসভায় না আসা, বিএনপি নিজ দায়িত্বে সিসিটিভি ক্যামেরা আর্চওয়ে স্থাপন করা, সর্বোপরি কোনোরকম ব্যাখ্যা ছাড়া সমাবেশ বাতিল করার ক্ষমতা হাতে রাখার মতো উদ্ভট এবং হাস্যকর শর্তসহ মোট ২৬ শর্ত যুক্ত করে দেয় এই অনুমতির সঙ্গে। বিএনপি রাজি হয়নি। এরপর দুই পক্ষের চাপান-উতোর চললো। কিন্তু সহসাই পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠলো। সাতই ডিসেম্বর পুলিশ বিএনপি’র পল্টন কার্যালয়ের সামনে ক্র্যাকডাউনে নামে। আহত হন অনেকেই আর নিহত হন একজন। বিএনপি’র কার্যালয় এর ভেতরে অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। ৫০০ জনের বেশি আটক করে, লণ্ডভণ্ড করে অফিসের নানা সামগ্রী এবং নিয়ে যায় বিএনপি অফিসের কম্পিউটারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র।

 

 

 তালাবদ্ধ করে কার্যালয়টি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় পুলিশ। তারপর পরিস্থিতি একটু হলেও উত্তরণের আশা দেখা গেল যখন আমরা দেখলাম কমলাপুর স্টেডিয়াম কিংবা বাঙলা কলেজ মাঠের মধ্যে কোনো একটি স্থানকে বেছে নিতে দুই পক্ষই আলোচনা করছে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবেই সেদিন গভীর রাতে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য জনাব মির্জা আব্বাসকে। সর্বশেষ বিএনপি’র পক্ষ থেকে গোলাপবাগ মাঠ চাওয়ার প্রেক্ষাপটে সেটি দিতে সরকার শেষ পর্যন্ত রাজি হয় এবং জনসভাটি সেখানে হলো।  বিএনপি’র জনসভাকে কেন্দ্র করে যা যা ঘটছে সবকিছুই ঘটছে বিশ্বকাপের প্রচণ্ড ডামাডোলের মধ্যে। নিজেরা যেমনই ফুটবল খেলুক না কেন বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে এই জাতির উন্মাদনা এখন বৈশ্বিক পর্যায়ে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়েও বিএনপি’র এই জনসভাকে কেন্দ্র করে ঘটা ঘটনাগুলো নাগরিকদের মধ্যে আলোচিত হচ্ছে। গোলাপবাগ মাঠে জনসভা করায় কার জয় হলো কিংবা কার পরাজয় সেই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।  বিশেষ করে আমাদের এই অঞ্চলের রাজনীতিতে জয়-পরাজয় শব্দগুলো খুব ব্যবহৃত হয়। 

কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনীতি আর রাজনীতির জায়গায় নেই, এটা একটা স্রেফ যুদ্ধের পরিস্থিতিতে চলে গেছে। তাই জয়-পরাজয়ের হিসাব খুব ঘটা করে হওয়ারই কথা। জয়-পরাজয় বিষয়ে মন্তব্য এর মধ্যেই চলে এসেছে ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তির কাছ থেকে। জনসভার আগের দিন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদের মহানগর নাট্যমঞ্চে একটি সমাবেশে বলেছেন- ‘নয়াপল্টনে সমাবেশ করবোই।’ আজ তারা গোলাপবাগে। তাহলে পরাজয় কার হলো? আমাদের না বিএনপি’র? আন্দোলনে অর্ধেক পরাজয় এখানেই হয়ে গেছে। জনাব কাদেরের চোখে বিএনপি’র অর্ধেক পরাজয় হয়ে গেছে।  কেউ যদি সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন তাহলে কি মনে হবে বিএনপি ‘অর্ধেক পরাজিত’ হয়েছে? এই যুদ্ধে আওয়ামী লীগের  অর্ধেক বিজয়ও কি হয়েছে, নাকি আদৌ কোনো বিজয় হয়েছে? সামপ্রতিক ‘যুদ্ধে’ আওয়ামী লীগের আসলে কী হয়েছে, সেটা বোঝার জন্য আমরা একটু পেছন থেকে দেখতে শুরু করি।  চার মাস আগে থেকেই বিএনপি যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে জনসভা করতে শুরু করে তখন থেকেই ক্ষমতাসীন দল তাতে প্রচণ্ড বাধা তৈরি করে।

 কখনো কখনো পুলিশ আবার কখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সেই জনসভাগুলোতে চরম বাধা তৈরি করে, হামলা করে। অসংখ্য বিএনপি নেতাকর্মী আহত হয়েছেন এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে সাতজন বিএনপি নেতা-কর্মী। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীনরা চরম আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আছে। সেই চাপের মুখে থেকে পরবর্তীতে বিভাগীয় জনসমাবেশগুলোতে আর আগের মতো হামলা করে চরম বাধা তৈরি করতে চেষ্টা করেনি। এরপর যখন বিএনপি বিভাগীয় জনসমাবেশগুলোর ঘোষণা দেয় তখন কিছু আপাত উদ্ভট কৌশল  নেয় সরকার। বিএনপি জনসভায় জনসমাগম কমানোর জন্য প্রত্যেকটি জনসভার দুই দিন আগে থেকে পরিবহন এবং ক্ষেত্রবিশেষে নৌ ধর্মঘট ডাকা হয়। জনসভার সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয় যেন সে জনসভাগুলোর প্রচার ঠিকমতো না হয়। কিন্তু কোনোটিতেই উপচে পড়া ভিড় ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে এই কথাটাও আমরা মনে রাখবো প্রতিটি জনসভা হয়েছে অসাধারণ শান্তিপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খল। ঢাকায় বিএনপি চেয়েছিল তার বিভাগীয় সমাবেশের সর্বশেষটি করার। এবং যে জায়গায় তারা এটি করতে চেয়েছিল সেখানে এই বছরেই গত কয়েক মাসে ১১টি সমাবেশ হয়েছে। কোনোটিতেই কোনো সমস্যা হয়নি। কিছুটা জনদুর্ভোগ হয়েছে বটে।

 এটা এমনকি সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে হলেও হয়। সাপ্তাহিক কার্যদিবসে যুবলীগ, মহিলা লীগ এবং ছাত্রলীগের পরপর তিনটি অনুষ্ঠান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে হওয়ার পরও তার আশপাশে অনেকগুলো রাস্তা বন্ধ করার কারণে সারা ঢাকায় বিরাট সমস্যা তৈরি হয়েছিল। বিএনপি’র ক্ষেত্রে অন্তত একটা যুক্তি ছিল, তারা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে জনসমাবেশটি করতে চেয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে- বিভাগীয় জনসভায় কোনো সমস্যা না করলেও, পল্টনে এতগুলো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলেও সরকার কেন বিএনপিকে এবার আর পল্টনে জনসমাবেশ করতে দেয়নি। মিডিয়াতে আসা সংবাদে দেখা গেছে সরকার বলছে তাদের কাছে খবর আছে বিএনপি তাদের ঢাকার সমাবেশটি করার পর রাস্তায় বসে পড়তে পারতো। বসে পড়ে তারা সরকারের পদত্যাগ দাবি করতে পারতো। সরকারের মরিয়া আচরণ দেখে এটা খুব স্পষ্ট হলো এই ব্যাপারটি সরকার খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করেছে।  বিভাগীয় জনসমাবেশগুলো থেকেই দেখা যাচ্ছে সরকার আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে আগের মতো আর বলপ্রয়োগ করতে পেরে উঠছে না।

 বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে তার একটা সীমা আরোপিত হয়ে গেছে। ওদিকে বিএনপি পল্টনের রাস্তায় বসে পড়ে সরকারের পদত্যাগ চাইতে পারে- এটা সরকারকে চরমভাবে ভীত করে তুলেছে। এটা যেমন দেখেছে জনগণ, তেমনি দেখেছে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিও।  এইসব ঘটনাই ঘটেছে ১০ই ডিসেম্বর আসার আগেই। একটা চরম কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার যদি তার বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে আগের মতো আর বাধাহীন না থাকে, যদি সে তার ভয় জনগণ এবং বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কাছে প্রকাশ্য করে দেয় তাহলে সেটাকে তার বিরাট পরাজয় বলেই বিশ্বাস করি আমি। গোলাপবাগ মাঠে জনসভা করে বিএনপি’র অর্ধেক পরাজয় হয়েছে বলছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু আমি তো দেখছি ১০ই ডিসেম্বর আসার আগেই যেন ‘পূর্ণ পরাজয়’ ঘটেছে ক্ষমতাসীনদের। কর্মকাণ্ডে এমনটাই বলে দেয়।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status