ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

রোহানের আর কেউ রইলো না

ফাহিমা আক্তার সুমি
৪ ডিসেম্বর ২০২২, রবিবার
mzamin

স্তব্ধ রোহান। যেন মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। দু’-চোখে ঝরছে পানি। সড়ক দুর্ঘটনায় মায়ের  মর্মান্তিক মৃত্যু যেন তাকে পাথর করে রেখেছে। ব্যথা বুকে চেপে অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। প্রিয় মানুষটিকে হারানোর কান্না যেন থামছে না তার। মা রুবিনা আক্তার ছিল রোহানের সবকিছু। এক বছর আগে রোহানের বাবা মারা গেছেন। বাবাকে হারানোর পর মা ছিলেন ভরসা। বাবা হারানোর কষ্ট সন্তানকে কখনো বুঝতে দেননি মা।

বিজ্ঞাপন
বাবা-মা দু’জনকে হারিয়ে রোহান একা হয়ে গেল আজ। শনিবার গতকাল দুপুর ১২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। নিহত রুবিনার স্বজনদের কান্না যেন থামছিলো না।  এদিকে রুবিনার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে আছে সবকিছু। তার হাতে সাজানো-গোছানো সংসার পড়ে আছে, নেই শুধু তিনি। তেজগাঁওয়ের হোন্ডা গলির ৭৫/২ স্বামীর বাড়িতে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া একমাত্র ছেলে রোহানকে নিয়ে থাকতেন তিনি। স্বামী মাহবুবুর রহমানের মৃত্যুর পর কিছুটা একা হয়ে গেলেও বাবা ও শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে সময় কাটতো তার। বাড়িভাড়া ও স্বজনদের সহযোগিতায় ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।

 তার বাবার বাড়ি হাজারীবাগে ভাগলপুর লেনে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের ২২ তারিখ স্বামীকে হারান রুবিনা। তাদের ২৩ বছরের সংসার ছিল। পাঁচ তলা ভবনের দোতলায় গিয়ে দেখা গেছে, শুক্রবার সকালে রুবিনার করে রাখা বাজার পড়ে আছে। আচার তৈরি করার জন্য জলপাই ও বিভিন্ন সবজি কিনে এনেছিলেন।  রুবিনা আক্তারের ভাই জাকির হোসেন মিলন মানবজমিনকে বলেন, আমরা পাঁচ বোন দুই ভাই। রুবিনা ভাই-বোনের মধ্যে ৬ নম্বর ছিল। প্রতি শুক্রবার সে আমাদের বাসায় চলে আসতো। আমরা সব ভাই-বোন মিলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে আড্ডা দিতাম। আমি সব ভাই বোনের প্রিয় ছিলাম। সবাই আমাকে দেখতে ছুটে আসতো। এখন আমার বোন আর আসবে না। আমার বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে আমি সবার অভিভাবক ছিলাম। ঘটনার দিনে দুপুরে আমাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়ার কথা ছিল। প্রতিবার সে চলে যাওয়ার সময় আমি বোনের ছেলের জন্য অনেককিছু কিনে দিতাম। আমার বোনটা একদম সবার চেয়ে ভিন্ন ছিল। অনেক সহজ সরল ছিল। তার মনে কোনো অহংকার ছিল না। সে হোম ইকোনোমিক্স কলেজে পড়াশোনা করেছে। তাকে কোনোদিন আমরা বাসা থেকে একা ছাড়তাম না। 

সে কোনোকিছু তেমন চিনতো না। ছেলেটাও তার মতো সরল-সোজা হয়েছে। ঢাকায় বড় হলেও এই বাসা থেকে ওই বাসা চেনে না। তিনি বলেন, ওসি সাহেব বলেছেন হাসপাতালে আনার পর মারা যাওয়ার আগে সে নাকি কিছু বলতে চেয়েছিল তখন আমরা কেউ কাছে ছিলাম না। হয়তো বলতে চেয়েছিল ‘আমার ছেলেটিকে দেখে রেখো।’ সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। গাড়িটি থামালে আমার বোন বেঁচে যেতো। এভাবে তার মৃত্যু হতো না। তাকে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পরেই আমার ভাগ্নে রোহানকে তাদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। না হলে ও একা ওই বাসায় কী করবে। নিয়ে আসার পরে শুধু কান্না করছে বসে বসে। সে একদম চুপ হয়ে গেছে। কোনো কথা বলে না। এত ছোট বয়সে গত বছরে বাবাকে হারিয়েছে এখন মাকে হারালো। ওর তো আর কেউ রইলো না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাকির হোসেন বলেন, সবার ভালোবাসা পেলেও মায়ের ভালোবাসা তো আর পাবে না রোহান। ওর মা স্কুলে নিয়ে না গেলে সে যেতো না। বড্ড অভিমান করতো। স্কুলে গেলে তার মাকে সবসময় বসে থাকতে হতো। 

রোহান কোথাও যেতো না। তার কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই।  রুবিনার বোন সুলতানা লিপি বলেন, প্রতিদিন বোনের সঙ্গে ফোনে কথা হতো। সে আর ফোন দিবে না, আর কখনো বলবে না ওষুধ খেয়েছি কিনা। মারা যাওয়ার একদিন আগে ফোন দিয়ে বলতেছে কখনো আমার কিছু হয়ে গেলে তোমরা ছেলেটিকে দেখে রেখো। তার মনের ভিতর আগেই কামড় দিয়েছিল। আমার ভাগ্নেটাকে এতিম করে রেখে গেল। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় রুবিনা আমাকে ফোন দিয়ে বলে কোথায় আছো? আমি তখন অফিসিয়ালি একটা মিটিংয়ে ছিলাম। তখন আমাকে বলে সাবধানে থেকো। তারপর আমি তাকে পরে ফোন দেয়ার কথা বলে রেখে দেই। এই ছিল তার সঙ্গে শেষ কথা আমার। ৩টার দিকে আমার মেঝো আপু আমাকে ফোন দিয়ে বলে রুবি এক্সিডেন্ট করেছে। তখন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এরপর শুনতে পাই বোনের মৃত্যুর খবর। তিনি আরও বলেন, আমি রাস্তায় গিয়ে দেখে এসেছি আমার বোনের রক্ত। এর কী কোনো বিচার হবে না? আমার বাবা রক্ত দিয়ে দেশকে স্বাধীন করে গেছেন। আমি হাসপাতালে গিয়ে বোনের চেহারা চিনতে পারিনি। আমার বোনের চেহারা রক্তে ভরা ছিল। মুখে রক্ত জমে কালো হয়ে গিয়েছিল।

 আমার বোন হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। ওই চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। রুবিনার ননদ আবিদা সুলতানা ডলি বলেন, রুবিনা খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। সে আমার সঙ্গেই থাকতো। আমরা যৌথ পরিবার হিসেবে ছিলাম। প্রতি সপ্তাহে বাবার বাড়িতে যেতেন। তবে সেখানে বেশি সময় থাকতেন না। আর কোথাও একা যেতেন না সঙ্গে কেউ না কেউ থাকতো। তার বাবার বাসায় যাওয়ার সময় আমার স্বামী নুরুল আমিনকে নিয়ে যেতো আবার নিয়ে আসতো। খুবই ভালো মানুষ ছিল। শুক্রবার রুবিনার ননদের স্বামী নুরুল আমিনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে হাজারীবাগে বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন। 

এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে আসামাত্র একটি প্রাইভেটকার তাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিলে ছিটকে ওই গাড়ির সামনে পড়ে যান রুবিনা। আর রাস্তার পাশে তার বোন জামাইও পড়ে যান। কিন্তু গাড়ির সামনে রুবিনা পড়লেও চালক গাড়ি না থামিয়ে চালাতে শুরু করেন। এতে করে রুবিনার ওড়না গাড়ির চাকার সঙ্গে পেঁচিয়ে আটকা পড়ে যান। এভাবে ওই গাড়িচালক আটকে পড়া রুবিনাকে নিয়েই টিএসসি মোড় হয়ে নীলক্ষেতের দিকে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকেন। আর তার পেছনে  পেছনে প্রত্যক্ষদর্শীরা ছুটতে থাকেন। পরে নীলক্ষেতের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ থেকে পলাশী অভিমুখী সড়কের মুখে চালককে আটকে রুবিনাকে উদ্ধার করেন পথচারীরা। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status