ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় আটার দামে লাফ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১৬ মে ২০২২, সোমবার
mzamin

অভ্যন্তরীণ মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। এর প্রভাবে বাজারে আগে থেকেই দফায় দফায় বাড়তে থাকা আটা ও ময়দার দাম আরও বেড়েছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত এক মাসেই আটার দাম বেড়েছে ৬ থেকে ১৩ শতাংশ এবং ময়দায় বেড়েছে ৮ থেকে ১৯ শতাংশ। ওদিকে আটা-ময়দা দিয়ে তৈরি পাউরুটি, বিস্কুট, চানাচুুর, নুডলস জাতীয় খাদ্যপণ্যের দামও বেড়েছে। আবার কোনো কোনো কোম্পানি দাম না বাড়িয়ে পরিমাণে কমিয়েছে। এতে আগের চেয়ে স্বল্প আয়ের মানুষের খরচ বাড়ায় ভোক্তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। 

পণ্যের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় ভোক্তারা বলছেন, খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে গরিব মানুষ। দাম নাগালে রাখতে সরকারের তদারকির পাশাপাশি গরিবদের সহায়তাও করতে হবে।
ভারত গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও আমদানিকারকরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিকল্প উপায়ে গম আমদানির চিন্তা করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। 

রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বিক্রেতারা প্যাকেটজাত দুই কেজি আটার দাম রাখছেন ৯০ থেকে ৯৪ টাকা। সেই হিসেবে প্রতি কেজির দাম দাঁড়ায় ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা। আর প্রতি কেজি খোলা আটার খুচরা দাম ৪০ থেকে ৪২ টাকা।

বিজ্ঞাপন
মাস দেড়েক আগেও দুই কেজির আটার প্যাকেট পাওয়া যেত ৮২ থেকে ৮৫ টাকায়। অন্যদিকে দুই কেজি ওজনের ময়দার প্যাকেটের দাম ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়বে ৬৫ থেকে ৬৭ টাকা। আর খোলা ময়দার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬০ টাকায়। এক মাস আগে দুই কেজি ময়দার প্যাকেট কেনা যেত ১১০ থেকে ১২০ টাকায়।

টিসিবি’র তথ্যমতে, গত এক বছরে আটার দাম কেজিতে বেড়েছে ৬ থেকে ১৩ টাকা এবং ময়দায় বেড়েছে ১৮ থেকে ২৪ টাকা পর্যন্ত।

এদিকে বিভিন্ন কোম্পানির বিস্কুটের প্যাকেটের দাম ১০-১৫ টাকা বেড়েছে। কাওরান বাজারের মুদি দোকানি হোসেন আলী বলেন, আটা-ময়দা সম্পর্কিত সব খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। ৩০ টাকা দামের ১৫০ গ্রাম ওজনের বোম্বে সুইটসের ৩০ টাকার চানাচুরের প্যাকেটের দাম ১০ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪০ টাকা। আধা কেজি ওজনের নুডলসের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা ৪৯৬ গ্রাম ওজনের ১৩০ টাকা দামের নুডলস বিক্রি করছেন ১৪৫ টাকায়।

বাজারে আসা একজন ক্রেতা বলেন, গত এক মাসে ময়দার দাম কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়েছে। আটার দামও বাড়তি। সংসারে খরচ বাড়ছেই। কিন্তু আয় তো বাড়ছে না। এ কারণে আগের তুলনায় এখন কম পণ্য কিনতে হচ্ছে।

তালতলা বাজারের ইকবাল স্টোরের স্বত্বাধিকারী শাহাদাত হোসেন আটার দাম বাড়া প্রসঙ্গে বলেন, ঈদের আগেও আটার তেমন দাম ছিল না। হঠাৎ করেই আটার দাম বেড়েছে। দুই কেজি আটা ৯৭ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এক কেজি খোলা আটা ৩৮ টাকায় বিক্রি করতাম। সেই আটার দাম এখন ৪৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

শ্যামলী কাজী অফিস মোড়ের দোকানদার মোশাররফ বলেন, খবরে দেখলাম ভারত গম রপ্তানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কথা শোনার পরেই কোম্পানি দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আজকে তীর কোম্পানির লোক এসে বলছে, প্রতি কেজিতে ১০ টাকা বেশি। আমি বললাম, আপনারা যদি এমন শুরু করেন তাহলে মানুষ কেমনে বাঁচবে। এক কোম্পানি পণ্যের দাম বাড়ালে অন্য কোম্পানিও দাম বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, পাইকারি বাজারে আটার দুই কেজির প্যাকেট ৯২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে এখন ৯৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আটার প্রতি কেজির প্যাকেট ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

শ্যামলীর রুবেল স্টোরের বিক্রেতা রাকিব বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দু’মাস ধরে আটা-ময়দার বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর মধ্যে ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধের কারণে দাম আরেক দফা বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি জানান, পাইকারি বাজারে যে খোলা আটা ৩২ টাকা কিনেছি তা এখন ৩৭-৩৮ টাকায় কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি খোলা ময়দা ৪৭ টাকা কিনলেও এখন ৫৭ টাকায় কিনতে হচ্ছে। যে কারণে আমাদেরও খুচরা বাজারে বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেডের (ডিজিএফটি) ঘোষণায় বলা হয়, দেশের সার্বিক খাদ্য সংকট নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিবেশী ও অন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে প্রয়োজনে সহায়তা দিতে সরকার গম রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শনিবার থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয় বলে খবর প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। অন্যদিকে এনডিটিভির প্রতিবেদনে জানানো হয়, শুক্রবারের ঘোষণার আগে লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি) ইস্যু হয়েছে এমন সব রপ্তানি চালান সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠানো যাবে। এর বাইরে কোনো দেশের অনুরোধে গম রপ্তানি করা যাবে।

গমের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশ ভারত। চলতি বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি গমের অন্যতম বৃহৎ উৎপাদনকারী রাষ্ট্র ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর ভারতের দ্বারস্থ হন ক্রেতারা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরের মাস মার্চে দাবদাহে ব্যাপক ফসলহানি হয় ভারতে। এমন বাস্তবতায় গম রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১২.৩৪ লাখ টন গম। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বছরে চাহিদা রয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টনের। সেই হিসাবে বাকি ৫৮ থেকে ৬৩ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে মাত্র ৫-৬ লাখ টন সরকারিভাবে আমদানি হয়। বাকিটা আমদানি হয় বেসরকারিভাবে।

গম আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারীরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্বে গমের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দামও বেড়েছে। এসব কারণে আটা-ময়দা ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের দাম বাড়ছে।

উদ্যোক্তারা জানান, ইউক্রেনে বর্তমানে প্রতি টনের দাম পড়ছে ৪৭০ থেকে ৪৮০ ডলার। যা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ছিল ৩৫০ থেকে ৩৬০ ডলার। কানাডার গমের দাম আরও বেশি ৫০০ থেকে ৫২০ ডলার। অস্ট্রেলিয়ার গম ৪৮০ থেকে ৪৯০ ডলার। ভারতেও গমের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০ ডলারে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ৫৩ লাখ ৪২ হাজার টন গম আমদানি করা হয়। চলতি অর্থবছরের ১লা জুলাই থেকে ১১ই মে পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৭৯০ টন। বাংলাদেশ যে পরিমাণ গম আমদানি করে তার সিংহভাগই আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। এ ছাড়া ভারত, কানাডা থেকেও আমদানি হয়। তবে বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলমান থাকায় দেশ দুটি থেকে আমদানি প্রায় বন্ধ।

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে গম উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৮৫ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ২৬ হাজার টন। এ ছাড়া গত অর্থবছরে ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে ৬৫ লাখ ৬২ হাজার টন। দেশে প্রতি বছর গমের চাহিদা বাড়ছে ১১-১৫ শতাংশ। এর বিপরীতে উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ হারে।

সর্বশেষ গত ১১ই এপ্রিলের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, গমের মোট মজুত আছে ১ লাখ ১৮ হাজার টন। মজুত কমে আসায় এপ্রিলের শুরুতে চাল ও গমের বরাদ্দ বাড়াতে খাদ্য অধিদপ্তর চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে। অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী জুন সমাপনীতে নিরাপত্তা মজুত হিসেবে সরকারি গুদামে দুই থেকে আড়াই লাখ টন গম মজুত থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমানে গম আছে এক লাখ ৪৯ হাজার টন। অর্থাৎ ঘাটতি আছে ৫৩ হাজার টন। এমতাবস্থায় সারা দেশের ওএমএস চালু রাখতে জরুরিভিত্তিতে কমপক্ষে আরও ৫০ হাজার টন গমের বরাদ্দ দিতে অর্থ বিভাগে চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খাদ্য সচিব ড. মোসাম্মৎ নাজমানারা খানুম গণমাধ্যমকে বলেন, তারা বিকল্প দুটি পরিকল্পনা করেছেন এরই মধ্যে। তিনি বলেন, বুলগেরিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছি। সেখান থেকে পাবো। আর ভারত সরকারের সঙ্গে জি-টু-জি পদ্ধতিতে আমদানি করার চেষ্টা করছি। সরকারিভাবে বেশি এনে আমরা খোলা বাজারে বা ওএমএসে একটু বেশি দেয়ার চেষ্টা করবো। তিনি বলেন, গম আমদানি অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে আড়াই লাখ টন গমের ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া আছে। এর মধ্যে ভারত থেকে আগামী ১৫ বা ১৬ই মে’র মধ্যে দেশে এক লাখ টন গম এসে পৌঁছবে। তাছাড়া গম আমদানিতে কোনো শুল্ক না থাকায় বেসরকারিভাবে সব সময় আমদানি হচ্ছে। 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করায় বাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, এর ফলে শুধু যে গমের দাম বাড়বে সেটাই না অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়বে। যেকোনো ঘোষণা কার্যকর করার আগেই বাংলাদেশের বাজারগুলোতে দাম বেড়ে যায়। তাই সরকারকে এখনই যেটা করতে হবে-ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে বেসরকারিভাবে গম আমদানি করার ব্যবস্থা করা, আর দ্বিতীয় বিকল্প উৎস থেকে গম আনা। 

এদিকে ভারত সরকারিভাবে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, বেসরকারিভাবে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তারা রপ্তানি বন্ধ করলেও এতে বাংলাদেশের উপর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। রোববার দুপুরে সিলেট সদর খাদ্যগুদাম পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status