প্রথম পাতা
যেভাবে প্রধানমন্ত্রী হলেন আনোয়ার ইব্রাহিম
মানবজমিন ডেস্ক
২৫ নভেম্বর ২০২২, শুক্রবার
তিন দশকের অপেক্ষা। মাহাথির মোহাম্মদের কারণে কারাবাস। অবশেষে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর মালয়েশিয়ার
প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। নাটকীয় রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি কখনো প্রায় ক্ষমতার চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন আবার কখনো সেখান থেকে আছড়ে পড়েছিলেন মাটিতে। মালয়েশিয়ার দীর্ঘ সময়ের বিরোধী নেতা ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক গুরু মাহাথির মোহাম্মদের হিংসার শিকার হয়েছেন। কারাগারে যেতে হয়েছে একাধিকবার। তবু দমেননি তিনি। অবশেষে দশকের পর দশক ধরে যে স্বপ্নের পেছনে ছুটেছেন তা এখন বাস্তব।
২০১৮ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছিলেন, এই মুহূর্তে আমার জীবনের ট্যাগলাইন হতে পারে ‘কারাগার থেকে প্রাসাদে’। তবে এরপরেও ক্ষমতার চূড়ায় উঠতে আনোয়ার ইব্রাহিমকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও চার বছর।
মালয়েশিয়ার সুলতান আবদুল্লাহ রিয়াতউদ্দিন আল মোস্তাফার উপস্থিতিতে শপথ নিয়েছেন তিনি। কুয়ালালামপুরে সুলতান আবদুল্লাহ’র প্রশাসনিক ভবন ‘আসতানা নেগারা’ প্রাসাদে স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জোটের চেয়ারম্যান আনোয়ার ইব্রাহিম শপথ নিয়েছেন। গত ১৯শে নভেম্বর মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে পিএইচ জোট ২২২ আসনের পার্লামেন্টে সবচেয়ে বেশি ৮২ আসন পেয়েছে। নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পেরিকাতান ন্যাসিওনাল (পিএন) জোট পেয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৩ আসন ও ক্ষমতাসীন জোট বারিসান ন্যাসিওনালের (বিএন) পেয়েছে ৩০ আসন।
তবে সরকার গঠনে যেকোনো দল বা জোটের প্রয়োজন ১১২ আসন। কোনো দল বা জোট প্রয়োজনীয় আসন না পাওয়ায় সুলতান আবদুল্লাহ আঞ্চলিক রাজাদের নিয়ে সরকার গঠনে সহায়তার জন্য বৈঠক করেন। বৈঠকের পর ঘোষণা আসে মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিম বিকালে শপথ নেবেন।
আর এর মধ্যদিয়েই আনোয়ারের বহু বছরের স্বপ্ন অবশেষে বাস্তবে পরিণত হয়। তবে তার এই যাত্রা সহজ ছিল না। বহুবার তাকে বিশ্বাসঘাতকার শিকার হতে হয়েছে। তবু লড়াইয়ে হার মানেননি তিনি। ১৯৯০’র দশকেই ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। কিন্তু সমকামিতার অভিযোগে তাকে পদচ্যুত করা হয়েছিল। যেতে হয়েছিল কারাগারেও। তার সমর্থনে মালয়েশিয়ার রাস্তায় নেমে এসেছিল লাখ লাখ মানুষ।
সমকামিতার অভিযোগে ১৯৯৯ সালে তাকে ৬ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরপরের বছর দুর্নীতির অভিযোগে আরও ৯ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি। তবে আনোয়ার বরাবরই বলে আসছেন, ওই মামলা ছিল মাহাথির মোহাম্মদের ষড়যন্ত্র। মাহাথির তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে যা যা করা দরকার তাই করেছিলেন। সে সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে তার মামলা নিয়ে ব্যাপক চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল মালয়েশিয়াকে।
তবে মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করার পর ২০০৪ সালে আনোয়ার ইব্রাহিমকে অগ্রিম মুক্তি দেয় আদালত। এরপর তিনি বহুদিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। ২০১৩ সালে রাজনীতিতে ফিরে এসে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতৃত্ব হাতে নেন। নির্বাচনে তার দল সব থেকে বেশি ভোট পেলেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ভোট তার ছিল না। ২০১৫ সালে তাকে আবারো সমকামিতার অভিযোগে জেলে নেয়া হয়। তবে তাতেও দমে যাননি তিনি।
২০১৮ সালের নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের দল ‘পিপলস জাস্টিস পার্টি’র জোট ক্ষমতায় এলে তার মুক্তির পথ খুলে যায়। মালয়েশিয়ার রাজার নির্দেশে মুক্তি দেয়া হয় তাকে। ইব্রাহিম বরাবরই দাবি করে আসছিলেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ী, মুক্তি পাওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত কেউ প্রশাসনিক পদে থাকতে পারবেন না, যদি না রাজা তাকে মার্জনা করেন৷ এই পরিস্থিতিতে তিন বছর আগে সাজাপ্রাপ্ত ইব্রাহিমের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সবদিক থেকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তবে রাজার নির্দেশের পর তার সামনে থাকা বাধা দূর হয়ে যায়। সে সময় মাহাথিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার পরিচালনার ঘোষণা দেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তিনি বলেন, আমার লক্ষ্য দেশের মঙ্গল। মাহাথির আমার মুক্তির জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সংস্কারের লক্ষ্যেও তিনি অবিচল। তার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই।
তবে মাহাথিরের সঙ্গে দ্রুতই আবার টানাপড়েন শুরু হয় আনোয়ারের। জোটের মধ্যে অন্তর্কোন্দল থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত আর জোটবদ্ধ থাকতে পারেননি তারা। ফলশ্রুতিতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকাতান হারাপান জোটের পতন ঘটে। মাহাথির ও আনোয়ারের মধ্যে চুক্তি ছিল যে, আড়াই বছর করে দুই জন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন মালয়েশিয়ার। তবে আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই এই জোটের পতন হয়।
আনোয়ারের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬০ সালে তিনি ‘মুসলিম ইয়ুথ মুভমেন্ট অফ মালয়েশিয়া’ (এবিআইএম) গঠন করেছিলেন। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইব্রাহিম। সে সময় তিনি মালয়েশিয়ার গ্রামীণ জীবনের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন। এ ছাড়া তৎকালীন শাসক বারিসান ন্যাশনালের সঙ্গে ইউনাইটেড মালয়েজ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) জোটেরও তীব্র সমালোচক ছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের পক্ষ থেকে ইউএমএও-তে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পান তিনি। ১৯৮২ সালে সেই আমন্ত্রণ স্বীকার করেন ইব্রাহিম। এরপরই তার উত্থান ঘটে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে ১৯৯৮ সালে তিনি ‘এশিয়ান অফ দ্য ইয়ার’র শিরোপাও পান।
আনোয়ারের রাজনৈতিক জীবনকে অনেকেই তুলনা করেন দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে। তারা উভয়েই দেশের গণতন্ত্রীকরণের সময় নানা নিপীড়নের মধ্যদিয়ে গেছেন। ভোটে সর্বাধিক আসন পাওয়ার পর আনোয়ার ইব্রাহিম নিজেই বলেন, আমি দেখতে পাচ্ছি মালয়েশিয়ার মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। তারা এখন নতুন পথে দেশের অগ্রগতি দেখতে চায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় দেশকে আরও উদার করে তুলবেন। পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সংস্কারে মনোযোগ দেবেন তিনি। তার হাত ধরেই হয়তো বিশ্ব মঞ্চে মালয়েশিয়ার খ্যাতি আবারো ফিরে আসবে।
মন্তব্য করুন
প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন
প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত
ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রতিক্রিয়া/ কেবল নির্বাচনে প্রভাব নয় ভাগ্যও নির্ধারণ করবে

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]