ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বেহুদা প্যাঁচাল

এমন দিন কি কখনো আসবে?

শামীমুল হক
২৪ নভেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার
mzamin

প্রতিবাদের ভাষা আজ মিইয়ে গেছে। ভয় আর আতঙ্ক জাপটে ধরেছে সমাজটাকে। গুটিকয়েক মানুষের কাছে বন্দি সমাজ। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও সংখ্যালঘুদের কাছে অসহায়। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে সবাই বসবাস করবে। কথা বলবে। কিন্তু কেন এমন হলো? এর জন্য দায়ী কে? আসলে কোনো বিষয়ে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে। থাকবে মতের ভিন্নতাও। কিন্তু তাই বলে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নামতে হবে? নাকি ওই বিষয় নিয়ে এক টেবিলে বসে আলোচনা করতে হবে।

বিজ্ঞাপন
হ্যাঁ, এই আলোচনা করতে গিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে। যুক্তি পাল্টা যুক্তি তুলে ধরা হবে। শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষ এক হয়ে হাসিমুখে আলোচনার টেবিল থেকে একমত হয়ে বের হবে। হাতে হাত রেখে বলবে দেশকে এগিয়ে নিতে আমরা বদ্ধপরিকর। আর পেছনে যাওয়া নয়, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে সামনে। সকল অপশক্তিকে উড়িয়ে দিয়ে আমরা গাইবো জয়ের গান। ভাবছি, এমন দিন কি কখনো আসবে?


সহজ কথা যায় না বলা সহজে। তাই তো স্বাভাবিক ঘটনা রূপ নেয় অস্বাভাবিকে। সমাজে দূষিতরা সারা শরীরে দুর্গন্ধ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সমাজও তাদের সমীহ করে। কদর করে। আর শরীরে যাদের সুগন্ধ তারা মুখ লুকিয়ে চলাফেরা করে। নীরবে নিভৃতে দিন কাটায়। তাদের সুগন্ধ মিইয়ে যায় দুর্গন্ধের কাছে। এ কোন জগৎ? এ কোন পৃথিবী? অন্যায় অনিয়ম প্রকাশ্যে করছে। তারপরও বুক ফুলিয়ে হাঁটছে। সততার মূল্যায়ন হয় না কোথাও। একেবারে গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে একই অবস্থা। গ্রাম্য মোড়লদের কথা দিয়েই শুরু হউক। টাকা ছাড়া তারা বিচার করেন না। টাকা হলে ন্যায়কে অন্যায় আর অন্যায়কে ন্যায় বানানো তাদের হাতের খেলা। মোড়লরা আবার বুক ফুলিয়ে তা বলেনও। তাদের কথা আদালতে গেলে উকিলকে টাকা দিতে হতো না? আমরা সমাধান করে দিচ্ছি, তাই আমরা টাকা নিচ্ছি এতে দোষের কি? আজব দুনিয়ায় লাজ শরমও তলিয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে। অথচ এক সময় ন্যায় বিচারকের নামডাক ছিল গোটা জেলাজুড়ে। জেলার কোথায় কোনো সালিশ হলে তার ডাক পড়তো। এসব এখন রূপকথার গল্পতেই ঠাঁই করে নিয়েছে। এখন প্রভাব প্রতিপত্তি আর অর্থকড়ি সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। মানুষ মাপার যন্ত্রও এসব। কীভাবে অর্থ উপার্জন সেদিকে খেয়াল নেই কারও। কার ক’টা বাড়ি আছে? কে গাড়িতে চড়ে? এসবই এখন মুখ্য। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। জামাইর বাবা কোটিপতি। ছেলে বসে খেলেও টাকা ফুরাবে না। 

আবার কেউ কেউ ছেলে পছন্দ করে উপরি আয়ের চাকরি দেখে। এতে করে মেয়ে অর্থের উপর ঘুমাবে। মানুষে বাহবা দিবে। অমুকের মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। জামাই অমুক অফিসার। ঢাকায় তিনটা বাড়ি আছে। অর্থের অভাব নেই। চারদিকে শোরগোল পড়ে যায়। কোথায় আছে এখন সততা। বড় বড় হুজুরেরা ওয়াজ করেন সুদের বিরুদ্ধে। অথচ অনেক ইমাম সাহেবকে দেখা গেছে সুদের কারবারি করতে। অনেক মাওলানাকে দেখেছি বাবা-মাকে ভাত না দিতে। এসব যারা দেখেন তারা কি শিখবেন?  চাকরির বাজারে ঘুষের লেনদেন ওপেন সিক্রেট। টাকা হলে চাকরি মিলবে। টাকা না হলে চাকরি নেই। ব্যতিক্রম যে নেই, তা কিন্তু নয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়া চাকরি মেলে না। সরকারের তরফ থেকে কড়া বার্তা দেয়া থাকলেও কে মানে এসব। আর তা দেখভাল করবেন যারা তারাই তো এসব করেন। তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে চাকরি প্রার্থীদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের ধরছে। টাকা না হলে সেবাও মেলে না অনেক ক্ষেত্রে। পত্রপত্রিকা খুললে এসব এখন প্রতিদিনের চিত্র। রাজনীতিতেও এখন ভালোর চেয়ে খারাপের সংখ্যা বেশি। পদ-পদবি বিক্রি এখন ওপেন সিক্রেট। একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু। ওয়ার্ড নেতা হতে গেলেও টাকা দিতে হয়।

 টাকা না দিলে পদ পাওয়া যায় না। টাকা দিয়ে যারা পদ কেনেন তাদের দিয়ে রাজনীতির কি হবে? তারা তো রাজনীতিকে দূষিতই করবে। এ দূষণ থেকে বের হওয়া আর সম্ভব নয়। প্রকাশ্য দিবালোকে টাকার খেলা চলে। নির্বাচনে টাকার বস্তা নিয়ে নামে প্রার্থীরা। ভোটাররা চেয়ে থাকে প্রার্থীর হাতের দিকে। এ প্রথা চালু হওয়ার পরই রাজনীতি আর রাজনীতি নেই। অপরাজনীতি হয়ে গেছে।  কোন সেক্টরটা ভালো আছে? এমন একটি সেক্টর নেই যেখানে অপশক্তির প্রভাব নেই। এই অপশক্তির হাতে জিম্মি গোটা সেক্টর। সৎ যে ক’জন আছেন তারা সংখ্যায় সামান্য। তারা চোখ দিয়ে তাকালেও দোষ। এমন এক সমাজ, যে সমাজ ঘুণে ধরা। ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে সবকিছু করছে। ভোক্তার দিকে খেয়াল নেই। সিন্ডিকেটে বন্দি বাজার। আজ চালের বাজারে নজর তো কাল চিনির বাজারে। পরশু আবার তেলের ড্রামে। পিয়াজ, রসুন আর আদাই বাদ যাবে কেন? সেখানেও আড়চোখে দৃষ্টি আছে সিন্ডিকেটের। দালালের আধিপত্য সব জায়গায়। ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন এক উদ্যোক্তা সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, আমি একসময় মুরগির খামার দিয়েছিলাম। নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল লক্ষ্য। অর্থ, শ্রম আর মেধা দিয়ে একেকটি মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে লাভ পেতাম দুই থেকে তিন টাকা। ওদিকে দালালরা একেকটি মুরগি বিক্রি করে লাভ করতো দশ টাকা। ব্যারিস্টার সুমন বলেন, সেদিনই বুঝে গেছি এ দেশে উদ্যোক্তার চেয়ে দালালের দাম বেশি।

  পত্রপত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায়, ধর্ষণের বিচার করতে গিয়ে গ্রাম্য মোড়লরা ধর্ষকের জরিমানা করে। আর যে টাকা জরিমানা করা হয় সে টাকা মোড়লের হাতে দিতে বলা হয়। মোড়লের হাতেই থেকে যায় জরিমানার টাকা। ধর্ষিতা আর পায় না। এমন ঘটনা বহু। কিন্তু জরিমানা করা কি জায়েজ? এটা কি সঠিক বিচার? এ প্রশ্ন করার মানুষও কমে গেছে সমাজে। বহুদিন আগের এক ঘটনা প্রায়ই উদাহরণ হিসেবে বলে থাকি। তখন মেঘনা নদীতে ভৈরব ও আশুগঞ্জ প্রান্তে ফেরি চলাচল করতো। গাড়ি পার হতো এ ফেরি দিয়ে। একদিন ঢাকায় আসার পথে আশুগঞ্জ প্রান্তে দেখা যায় লম্বা লাইন। প্রায় দুই তিন কিলোমিটার গাড়ির জট। গাড়ি থেকে নেমে ফেরিঘাটের দিকে হাঁটছি। ঘাটের কাছাকাছি একটি সেলুন। সেখানে রেস্ট নিতে বসলাম। বিশ কিংবা বাইশ বছরের এক যুবক সেলুনে কাজ করছেন। কথায় কথায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি কোথায়? বললো, নদীর ওপারে কিশোরগঞ্জ। কাজ শেষে বুঝি বাড়ি চলে যাও? যুবক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয় না। যেতে পারি না। কেন? প্রাণের ভয়ে। ঘটনা কি? যুবক বলতে থাকে-আমাদের গ্রামের দরিদ্র পরিবারের এক কিশোরী কন্যাকে ধর্ষণ করেছে প্রভাবশালীর লম্পট পুত্র। এ নিয়ে গ্রাম উত্তাল। চেয়ারম্যান এতে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি সবার সঙ্গে কথা বলে মামলা করতে নিষেধ করেন। পরদিন এ ব্যাপারে সালিশের ঘোষণা দেন। এ অনুযায়ী সন্ধ্যায় সালিশ বসে। গ্রামের লোকজন জমায়েত হয়।

 সালিশে সবার কথা শোনা হয়। এরপর চেয়ারম্যান তার রায় দেন। রায়ে ঘোষণা দেন যেহেতু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পরিবারটিও দরিদ্র। তাই ধর্ষককে বিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো। রায় শুনে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে সেখানে। আমি রাগ সামলাতে না পেরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠি- ধর্ষণের বিচার যদি এমনই হয়, তাহলে আমি আজ রাতেই চেয়ারম্যানের মেয়েকে ধর্ষণ করবো। আর এর জন্য কাল বিশ হাজার টাকা জরিমানা দেবো। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারম্যান তার লোকজনকে হুকুম করেন, আমাকে ধরার জন্য। আমি সেখান থেকে এক দৌড়ে গ্রাম ছেড়ে পালাই। সেই যে আসা আর গ্রামে যাওয়া হয়নি। গেলেই আমাকে মেরে ফেলা হবে। দীর্ঘদিন আগে শোনা এ কথা এখনো আমার মনে হয়। ওই নরসুন্দর কি গ্রামে যেতে পেরেছে? নাকি প্রতিবাদ করার জন্য নিজ গ্রাম ছেড়ে পরবাসী হয়েছেন? এমন শত শত ঘটনা ঘটছে দেশে। প্রতিবাদের ভাষা আজ মিইয়ে গেছে। ভয় আর আতঙ্ক জাপটে ধরেছে সমাজটাকে। গুটিকয়েক মানুষের কাছে বন্দি সমাজ। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও সংখ্যালঘুদের কাছে অসহায়। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে সবাই বসবাস করবে।

 কথা বলবে। কিন্তু কেন এমন হলো? এর জন্য দায়ী কে?  আসলে কোনো বিষয়ে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে। থাকবে মতের ভিন্নতাও। কিন্তু তাই বলে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নামতে হবে? নাকি ওই বিষয় নিয়ে এক টেবিলে বসে আলোচনা করতে হবে। হ্যাঁ, এই আলোচনা করতে গিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে। যুক্তি পাল্টা যুক্তি তুলে ধরা হবে। শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষ এক হয়ে হাসিমুখে আলোচনার টেবিল থেকে একমত হয়ে বের হবে। হাতে হাত রেখে বলবে দেশকে এগিয়ে নিতে আমরা বদ্ধপরিকর। আর পেছনে যাওয়া নয়, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে সামনে। সকল অপশক্তিকে উড়িয়ে দিয়ে আমরা গাইবো জয়ের গান। ভাবছি, এমন দিন কি কখনো আসবে?

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status