ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

সিলেট সেটেলমেন্টের কাণ্ড

পলাতক সাজিয়ে অবসরে পাঠানো হলো সুজিতকে

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
২৩ নভেম্বর ২০২২, বুধবার
mzamin

সিলেট সেটেলমেন্ট অফিসে নানা বিতর্কিত ঘটনায় প্রতিবাদী প্রসেস সার্ভার সুজিত কমার দে। কুলাউড়ায় বাড়ি এ কর্মচারী সংঘবদ্ধ চক্রের অবাধ লুটপাটের বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন। এ কারণে ওই চক্র ‘পলাতক’ দেখিয়ে তাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠিয়েছে। তিনি এ ঘটনার বিচার চেয়েও পাননি। এখন তার জিপিএফ ফান্ডের টাকা উত্তোলনে অনুমতি দিচ্ছে না। এ ঘটনায় হতবাক সুজিত কুমার দে। ৩৬ বছর ধরে চাকরি করছেন ভূমি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। সর্বশেষ চাকরিস্থল ছিল নবীগঞ্জে। ১৯৮৭ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন সুজিত। প্রথমে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করলেও পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে আসেন।

বিজ্ঞাপন
এরপর থেকে সিলেট ও কুমিল্লা বিভাগের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করেছেন। নবীগঞ্জ অফিসে প্রসেস সার্ভার হিসেবে কাজ করার সময় সিলেট সেটেলমেন্ট অফিসে শুরু হয় খতিয়ান টেম্পারিংয়ের ঘটনা।

 বর্তমান সেটেলমেন্ট কর্মকর্তার নেতৃত্বে ৬ জনের চক্র টেম্পারিং শুরু করলে তিনি ডিপার্টমেন্টালি প্রতিবাদ শুরু করেন। বিষয়টিকে ‘অবৈধ’ বলে টেম্পারিং করে মানুষের জমিজমা বেহাত না করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন। এদিকে, অবৈধ টেম্পারিং কার্যক্রম শুরু হলে প্রতিবাদও শুরু করেন ভুক্তভোগীর ভূমির মালিকরা। এ নিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে সিলেট সেটেলমেন্ট অফিসে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা ইতিমধ্যে সিলেটে সংবাদ সম্মেলনসহ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। 

এই অবস্থায় প্রতিবাদী সুজিতের উপর চোখ পড়ে সিলেট সেটেলমেন্ট কার্যালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা ওই সিন্ডিকেটের। এরপর থেকে নানাভাবে সুজিতকে হয়রানি করা শুরু হয়। চলতি বছরের ১১ই জানুয়ারি সুজিতকে নবীগঞ্জ থেকে সিলেটের জোনাল সেটেলমেন্ট কার্যালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু বদলির নির্দেশনাপত্র তাৎক্ষণিক হাতে পাননি সুজিত। এমনকি তাকে মৌখিকভাবে জানানোও হয়নি। ১৭ই জানুয়ারি তাকে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের কথা জানানো হলে বদলি পত্র ২৫শে জানুয়ারি হাতে পান সুজিত কুমার দেব। 

এরপর তিনি ২৬শে জানুয়ারি সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট কার্যালয়ে যোগদান করতে যান। কিন্তু ব্যাক ডেটে অর্থাৎ ১৭ই জানুয়ারি যোগদানের নির্দেশ দেয়া হলেও সুজিত সেটি মানেননি। তিনি উল্টো জানিয়ে দেন, ২৫শে জানুয়ারি বদলির নির্দেশ হাতে পেলে ১৭ তারিখ যোগদানের নিয়মের মধ্যে পড়ে না। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ সুজিত পরবর্তীতে পূর্বের কর্মস্থল নবীগঞ্জে চলে যান এবং সেখানে তিনি কাজ করতে থাকেন। এদিকে- নবীগঞ্জ কার্যালয়ে কাজ করার সময় ৬ই ফেব্রুয়ারি বদলির আদেশ পুনর্বিচেনার আবেদন জানান। 

এতে সুজিত পেনশনের স্বার্থে তাকে নবীগঞ্জ অথবা নিজ জেলায় বদলি করার অনুরোধ জানান। এই অবস্থায় জোনাল সেটেলমেন্ট অফিস থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। পরে ৮ই মার্চ যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্যাখ্যার জবাব দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন সুজিত। এই ব্যাখ্যার জবাব পাওয়ার পরও গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তার বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়। 

এরপর ২১শে মার্চ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে বিভাগীয় মামলা দায়ের করার জন্য অভিযোগ বিবরণী পাঠান সিলেট সেটেলমেন্ট অফিসার। এই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, সুজিত কর্মস্থলে নেই। তিনি অনুপস্থিত রয়েছেন। তার এই বিবরণী পাঠানোর পর ২৭শে মার্চ সুজিতের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয় এবং ১০ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। এ ঘটনার পর ২রা এপ্রিল বেতন-ভাতা প্রদানের দাবিতে সুজিত নবীগঞ্জের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের কাছে পত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু এই পত্রের কোনো সাড়া দেয়া হয়নি। এদিকে, ২৪শে মে এপ্রিল সুজিত বিভাগীয় মামলা দায়ের করার জবাব দাখিল করেন। এই জবাবে পুরো ঘটনা উল্লেখ করেন সুজিত। জানান, তিনি চাকরিতে পলাতক ছিলেন না। নবীগঞ্জে কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারে অফিস করছেন। এবং এই সময়ের মধ্যে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের চাওয়া জবাবের উত্তরও তিনি প্রদান করে আসছেন। লিখিত জবাব প্রাপ্তির পর ২০শে জুলাই মহাপরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন ব্যক্তিগত শুনানির জন্য ডাকেন। সেখানে সুজিত জানান, তিনি নবীগঞ্জ অফিসে কর্মরত রয়েছেন। 

শুনানি করার পর মহাপরিচালক এ বিষয়ে তদন্তের জন্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার সর্দার মো. মোস্তফা কামালকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। গত ১লা আগষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা সিলেট সেটেলমেন্ট অফিসের প্রতিনিধি এবং অভিযুক্ত সুজিতকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদে সেটেলমেন্ট অফিসের প্রতিনিধি অনেক বিষয় এড়িয়ে যান। পরে গত ৪ঠা আগষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা সুজিতকেই অভিযুক্ত করে রিপোর্ট প্রদান করেন। 

এদিকে, তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হওয়ার পর ফিরে এসে হাজিরা খাতা পরিবর্তনের ঘটনায় মূল হাজিরা খাতা উদ্ধার এবং মূল হাজিরা খাতা গোপনকারী ও স্বাক্ষর জাল করে অবৈধভাবে নতুন হাজিরা খাতা প্রস্তুতকারী দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। এতে তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন জানান। কিন্তু মহাপরিচালক তার এই আবেদনে সাড়া না দিয়ে দ্বিতীয়বার ৮ই সেপ্টেম্বর কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। এবং ৭ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দাখিলের জন্য সুজিতকে নির্দেশ দেন। এই নোটিশের পর সুজিত ১৫ই সেপ্টেম্বর জবাব দাখিল করেন। এই জবাবে তিনি তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে অনাস্থা জানান। এবং হাজিরা খাতা উদ্ধার ও তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। মহাপরিচালক সুজিতের জবাবের কোনো কিছুই আমলে না নিয়ে গত ৪ঠা অক্টোবর সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা) ২০১৮’র ৩ (ঘ) বিধিতে বর্ণিত পলায়নের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এবং একই বিধি মামলার অনুসারে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। তবে, মহাপরিচালক তার আদেশে কবে থেকে অবসর প্রদান করা হচ্ছে সেটি অস্পষ্টই রাখেন। ফলে সুজিতের অবসরকালীন সময় নিয়েও বিভ্রান্তি চলছে। 

সুজিত কুমার দে জানিয়েছেন, ‘সিলেট সেটেলমেন্ট অফিসের ভেতরে খতিয়ান টেম্পারিংসহ নানা ঘটনায় প্রতিবাদ করায় তাকে ৬ সদস্যের সিন্ডিকেট মহাপরিচালককে ভুল বুঝিয়ে জোরপূর্বক অবসরে পাঠিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তার অবসর শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। অথচ ৩ বছর আগে তাকে জোরপূর্বকই অবসরে পাঠানো হলো।’ তিনি জানান, ‘তাকে অবসরে পাঠানোর বিষয়টি বিধি সম্মত হয়নি। এজন্য তিনি আইনি লড়াই করবেন। তবে, তার আগে তার সরকারি চাকরি জীবনের জিপিএফ ফান্ডের টাকা উত্তোলনের জন্য জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে তার আবেদনটি ফাইলবন্দি করে রাখা হয়েছে। তার সঙ্গে জোনাল সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা অন্যায়ভাবে এসব কর্মকাণ্ড করছেন বলে দাবি করেন তিনি।’    
 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status