ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

কাওরান বাজারের চিঠি

ব্যালট বাক্স, বিদেশি অতিথিদের তৎপরতা, এবং...

সাজেদুল হক
১৯ নভেম্বর ২০২২, শনিবার
mzamin

রাজনীতির চেয়েও এখন অর্থনীতির প্রশ্ন জোরালো। কয়েকমাস ধরেই শিরোনামে রয়েছে ডলার, রিজার্ভ। ডলার সংকটের কারণে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা। এলসি খুলতে পারছেন না অনেক ব্যবসায়ী। কাগজের দাম আকাশচুম্বী। নতুন করে দাম বেড়েছে তেল, চিনি, আটার। অনেক দোকানে পাওয়াই যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এরইমধ্যে আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ পাওয়া নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে সরকার। ঋণ চাওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের কাছে। বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে জাপানের কাছে


রাজনীতি এরইমধ্যে মাঠে গড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন
সমাবেশ-পাল্টা সমাবেশ। বাহাস। ঢাকার বাইরে সমাবেশ গুটিয়ে আনছে বিরোধী বিএনপি। এসব সমাবেশে ব্যাপক সমাগম এরইমধ্যে দলটির নেতাদের আশাবাদী করেছে। যুগপৎ আন্দোলন নিয়েও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা চলছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। এরইমধ্যে তিনি অনেকটা লাইমলাইটে। ১০ই ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপি’র সমাবেশ ঘিরে রাজনীতির মাঠে এক ধরনের উত্তাপ তৈরি হয়েছিল। তবে তা এরই মধ্যে কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা হয়েছে, ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচির কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। বরং মহাসমাবেশই করতে চায় তারা। মহাসমাবেশে অবশ্য রেকর্ড-সংখ্যক মানুষ হাজির করার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপি’র। আওয়ামী লীগও সতর্ক অবস্থানে। ডিসেম্বর জুড়ে সরকারি দলের রয়েছে নানা কর্মসূচি। বিএনপি’র সমাবেশ ঘিরেও তৎপর থাকবেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। জাতীয় পার্টি নেতাদের বক্তব্যের সুর ইতিমধ্যে নরম। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দলটির প্রধান জিএম কাদেরের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে। জামায়াতের গন্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা চলছিল। তবে দলটির ওপর চাপ বাড়ার আলামত স্পষ্ট হচ্ছে। সামনের দিনে রাজনীতির চিত্র কেমন হবে তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। বিএনপি’র আগামী কর্মসূচি কী, দলটির ওপর চাপ কতটা বাড়বে, চাপের মুখে তারা কী করবেন এ নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নানা আলোচনা চলছে। আলোচনা রয়েছে গুলশানের বাসায় অবস্থান করা খালেদা জিয়ার ভবিষ্যৎ গন্তব্য কোথায় তা নিয়েও। তবে সামনের দিনে পরিস্থিতি যে ক্রমশ জটিল হবে তা খোলাসা হতে শুরু করেছে।  

রাজনীতি যখন আলোচনার শীর্ষে তখন খবরের শিরোনামে এসেছেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের খবরের শিরোনামে আসা একেবারে অভিনব কিছু নয়। বিশেষত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং পশ্চিমা কূটনীতিকরা প্রায়ই বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র, সুশাসনসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন। কিন্তু সাধারণত জাপানের রাষ্ট্রদূতের এসব ইস্যুতে কথা বলতে খুব একটা দেখা যায় না। বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু এবং অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন অংশীদার জাপান। দেশটির রাষ্ট্রদূত ঠিক কী বলেছেন যা নিয়ে এতো আলোচনা। প্রথম আলো’র রিপোর্ট অনুযায়ী,  জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবে বলে তাঁদের বলছে। তাই আগামী নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অংশ  নেবে বলে তাঁর আশা। 

 

 

 সোমবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক আলোচনায় নির্বাচন নিয়ে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন ইতো নাওকি। ২০১৮ সালের নির্বাচন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে ইতো নাওকি বলেন, ‘আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য  কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি।’ রাষ্ট্রদূতের এ বক্তব্য সরকারের ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। একাধিক মন্ত্রী এ নিয়ে কথা বলেন। জাপানি রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলবও করা হয়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম লিখেন, আমরা বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের এম্বাসেডরকে ডেকেছিলাম। তাকে যা যা বলা দরকার আমরা বলেছি। সবকিছু  বিস্তারিত গণমাধ্যমে বলার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না, তাই এই বিষয়ে কোনো গণমাধ্যমে আমরা আর কোনো বক্তব্য দিতে চাই না। শাহরিয়ার আলম আরও বলেন, বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক আরও গভীর হবে আসন্ন প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই প্রত্যাশায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। 

এই সফর বাংলাদেশের এবং জাপানের সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে বলে আশা করি। পোস্টের শেষ অংশে ভিয়েনা কনভেনশনের উদ্ধৃতি দিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লিখেন, আপনারা যদি কেউ ভুলে যান: ১৯৬১ সনের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের আর্টিকেল ৪১ এর অনুচ্ছেদ- ১ কূটনীতিকদের স্বাগতিক দেশের আইন ও বিধির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং জাতির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সরব রয়েছেন বিশেষত পশ্চিমা কূটনীতিকরা। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ অন্য কূটনীতিকরা একাধিকবার এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে বরাবরই তারা বলে আসছেন। এসব মন্তব্য অবশ্য বাংলাদেশ সরকার ভালোভাবে নেয়নি।  গত জুলাইয়ে ঢাকায় বিদেশি মিশনগুলোতে নোট ভারবাল পাঠিয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী একাধিকবার এসব নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। বিরোধী শিবির থেকে দৃশ্যত কূটনীতিক তৎপরতাকেও স্বাগতই জানানো হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষত নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিদেশি দূতদের নানা মন্তব্য, কার্যক্রম অভিনব কোনো ঘটনা নয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের তখনকার কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষদূত স্যার নিনিয়ান স্টেফান। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের নেপথ্যে কূটনীতিকদের ভূমিকা অনেকটাই স্পষ্ট। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হয়ে ঢাকায় এসেছিলেন অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো।

 আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছিলেন তিনি। তবে তার সমঝোতার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।  আরেকটি নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। সম্ভবত, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি-না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। গত দু’টি নির্বাচনে বিএনপি দুই ধরনের কৌশল নিয়েছিল। একটি অংশ না নিয়ে এবং অন্যটিতে অংশ নিয়ে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই সফলতা মেলেনি। এখন বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হলে তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।  রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে সরকার ও বিরোধীদলের অবস্থান বরাবরই আলাদা। বিরোধীদল সবসময়ই এসব তৎপরতাকে স্বাগত জানায়। এবারও যেমন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখ খুলে গেছে। বিবিসি বাংলাকে, ফখরুল বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য তাদের চেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাবে বলেই আশা করছেন। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকরা একটি ভূমিকা রাখবেন তা উল্লেখ না করলেও চলে। তবে সে ভূমিকা কেমন হবে এবং কাদের ভূমিকা কেমন হবে সে আলোচনা জোরদার হচ্ছে। এটি বিলিয়ন ডলারের প্রশ্নও বটে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী নতুন বিভক্তি তৈরি করেছে।

 স্নায়ুযুদ্ধের পর পৃথিবী হয়তো এমনটা আর ভাগ হয়নি। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রে ফিরেছে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার। দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা এ প্রশ্নে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ বলছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটি নতুন সমীকরণ। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা একই সুরে কথা বলছে। শেষ পর্যন্ত তাদের ভূমিকা কী হবে তার দিকে খেয়াল রাখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের এক ধরনের চাপে রাখার চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। চীনের ভূমিকা যে আলাদা হবে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত এরইমধ্যে তা স্পষ্ট করেছেন। গত দু’টি নির্বাচনে ভারতের ভূমিতা ছিল পরিষ্কার। নতুন করে অবশ্য দেশটি কোনো মন্তব্য করেনি। রাজনীতির চেয়েও এখন অর্থনীতির প্রশ্ন জোরালো। কয়েকমাস ধরেই শিরোনামে রয়েছে ডলার, রিজার্ভ। ডলার সংকটের কারণে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা। 

এলসি খুলতে পারছেন না অনেক ব্যবসায়ী। কাগজের দাম আকাশচুম্বী। নতুন করে দাম বেড়েছে তেল, চিনি, আটার। অনেক দোকানে পাওয়াই যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এরইমধ্যে আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ পাওয়া নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে সরকার। ঋণ চাওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের কাছে। বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে জাপানের কাছে। অর্থনীতি এবং রাজনীতি। আগামী কয়েকমাস বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জিং। চ্যালেঞ্জ উতরাতে তৎপর শাসক দল। বিএনপি চেষ্টা করছে চাপ তৈরির। 

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মানবজমিন।  

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status