ঢাকা, ২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

স্টেশন-টার্মিনাল যাদের ঠিকানা

নাজমুল হুদা ও মো. আল-আমিন
১৬ নভেম্বর ২০২২, বুধবার
mzamin

গাবতলী বাস টার্মিনালে রাতের দৃশ্য -নিজস্ব ছবি

রাত সাড়ে ১১টা। হালকা শীতের অনুভূতি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন কিছুটা নিশ্চুপ। স্টেশন ঘিরে অনেকগুলো বিছানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাতে ঘুমিয়ে আছেন ছিন্নমূল মানুষ। রাত যতই গভীর হচ্ছে তাদের সংখ্যাও বাড়ছে। ছেঁড়া চাদর, লুঙ্গি কিংবা ময়লা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে  তারা প্রতিদিনই সেখানে ঘুমান। বশির মিয়াও তাদের একজন। তিন মাস হলো স্টেশনে ঘুমানো শুরু করেছেন। সপ্তাহে ২-৩ দিন তিনি স্টেশনের ছাউনির নিচে ঘুমান।

বিজ্ঞাপন
বশির বলেন, রাতে কাজ করি। মাঝে মধ্যে এখানে থাকি। কন্টেইনারে পণ্য আসে। সেগুলো নামাই। 

ঢাকায় ৪০ বছর ধরে বসবাস বশির মিয়ার। বছর তিনেক আগেও সবকিছু ছিল তার। নিজের একটি কারখানাও ছিল। বাচ্চাদের কাপড় বানানো হতো কারখানায়। ভালোভাবেই দিন যাচ্ছিলো। কিন্তু তিন বছর আগে তার স্ত্রীর লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসা করাতে সর্বস্ব হারান। তিনি বলেন, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ১৪-১৫ লাখ টাকা খরচ করছি। কারখানা বিক্রি করলাম; জমি বিক্রি করলাম। কিন্তু স্ত্রী আর বাঁচলো না। এখন আমি একাই আছি। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাসা ছাইড়া দিছি। আমার মেয়ে পুরান ঢাকায় থাকে। তারাও জানে না আমি রাতে এখানে থাকি। বশির জানান, রাতে কন্টেইনারে পণ্য আসে। সেগুলো নামালে প্রতিদিন ৬০০-৭০০ টাকা পাই। সপ্তাহে ২-৩ দিন কাজ হয়। তা দিয়েই জীবন চলছে। 

বশির মিয়ার মতোই ফুটপাথ, বাস ও রেলস্টেশনে এমন অসংখ্য মানুষ রাত কাটান। তাদের কেউ দিনে কাজ করেন। কেউবা ভাসমান ছিন্নমূল মানুষ। এই মানুষের ঘর সংসার বলতে এই স্টেশন, টার্মিনাল বা ফুটপাথ। এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে ছিন্নমূল মানুষের আনাগোনা বাড়ছে এসব স্থানে। তাদের মধ্যে অনেকেই দিনে কিংবা রাতে দিনমজুরি করেন কিংবা গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করেন। কেউ কেউ পড়ে থাকা বোতল কিংবা ভাঙারি সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী, ভিক্ষা করে চলেন এমন মানুষও আছেন যাদের ঠিকানা এসব স্থান। এসব মানুষের দিনের চেয়ে রাতে কষ্ট বাড়ে। শীত কিংবা ঝড়-বৃষ্টি তাদের ঘুম কেড়ে নেয়।

আব্দুস সামাদ। বয়স ৭৫ পেরিয়েছে। বৃদ্ধ বয়সে কোথাও মাথা গোঁজার জায়গা নেই। রাতে থাকেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ফুটপাথে। ৫-৬ বছর ধরে তার সেখানে রাত কাটে। একটা পাতলা চাদর, একটা পুরনো বালিশ আর একটা ছেঁড়া ময়লা কাঁথা রয়েছে তার। আর ছোট একটা ব্যাগ রয়েছে। ব্যাগের মধ্যে রুটি আর পানির বোতল রাখা। এগুলোই তার নিত্যসঙ্গী। সামাদ বলেন, এহানেই থাকি। যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। ছেলেরা আছে। কিস্তি নিছিলো। এহন পয়সা-কড়ি জমা দিতে পারে না। নিজেরাই চলতে পারে না। তাই আমি এহানে পইড়া আছি। এহানেই ঘুমাই। আগে এহানে এত মানুষ আছিল না। এখন বাড়ছে। তার পাশেই বিছানা করা কবির হোসেনের। এতিমখানায় বড় হয়েছেন। লেখাপড়া করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আগে পত্রিকার হকারি করতেন। কিন্তু তা দিয়ে দু’বেলা খাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো তার। পরে রাস্তার বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করা শুরু করেন। কবির বলেন, মাঝেমধ্যে এখানে আসি। থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে। রাস্তায় বোতল টোকাইয়া খাই। ২০০-৩০০ টাকা হয়। এটা দিয়েই হোটেলে ভাত খাই। পরিবার নাই। একাই থাকি। 

গাবতলী পাথর ঘাটে দিনমজুরি কাজ করেন আব্দুল জলিল। গ্রামের বাড়ি বগুড়া। প্রতি মাসে পরিবারের জন্য ৫-৬ হাজার টাকা পাঠাতেও কষ্ট হয় তার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পর এখন ব্যয় মেটাতে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। তাই অর্থের অভাবে এখন বাধ্য হয়ে গাবতলী বাস টার্মিনালে ঘুমান। তিনি বলেন, গাবতলী পাথর ঘাটে মাল লোড-আনলোডের কাম করি। যা কামাই করি তা দিয়া ঘর ভাড়া করে থাকা যায় না। তাই এক বছর ধইরা এহানেই থাকি। এহানে থাকতে থাকতে অভ্যাস হইয়া গেছে। এহন আর কোনো সমস্যা হয় না। দিন দিন টার্মিনালে মানুষের সংখ্যা বাড়তাছে। কোনো কোনো দিন এহানেও জায়গা হয় না অনেকের। রিকশাচালক বাদশা মিয়াও থাকেন গাবতলী বাস টার্মিনালে। পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। এ জন্য ছয় মাস ধরে টার্মিনালের ছাউনির নিচেই থাকছেন। বাদশা বলেন, ঢাকায় তিন বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছি। আগে মেসে থাকতাম। কিন্তু জিনিসের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার পরে মেস ছেড়েছি। তিন সন্তানের সবাইকে লেখাপড়া করাতে হচ্ছে।

 তাদের খরচ চালানোর জন্য এখানে থাকি। কিছু টাকা বাঁচলে তাদের পড়ার খরচটা দিতে পারি। বাদশা জানান, তার সঙ্গে আরও অনেক মানুষই এখন গাবতলী টার্মিনালে থাকা শুরু করেছেন। 
দুই মাস ধরে মহাখালী বাস টার্মিনালে রাতযাপন করছেন গাজীপুরের রুবেল। তিনি বলেন, আমি প্রতিবন্ধী মানুষ। মানুষের কাছে চেয়ে-চিন্তে (ভিক্ষাবৃত্তি) খেতে হয়। এখানে এসেছি দুই মাস হলো। খুব কষ্টে দিন কাটছে। টার্মিনালে ঘুমালে পুলিশ এসে মাঝে মাঝে উঠিয়ে দেয়। তখন এখান থেকে কিছুক্ষণের জন্য চলে যেতে হয়। পুলিশ চলে গেলে আবারো এখানে এসে ঘুমাই। এখন অনেক মানুষ ঘুমায় এখানে। আগে এত মানুষ ছিল না। বাস শ্রমিক বেলায়েত হোসেনও রাত কাটান মহাখালী টার্মিনালে। তিনি বলেন, প্রতিদিন যা ইনকাম করি তা দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকা সম্ভব না। জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। প্রতিদিনের খাবার কিনতেই সব টাকা ফুরিয়ে যায়। এজন্য এখানেই থাকতে হয়। তিনি বলেন, দিন যত বাড়ছে এখানে ঘুমানো মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। টার্মিনালের কোনে জায়গা খালি থাকে না।

 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status