প্রথম পাতা
সুখবর নেই কোথাও
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও এম এম মাসুদ
১২ অক্টোবর ২০২২, বুধবার
সুখবর নেই কোথাও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস অবস্থা। সর্বশেষ আগস্টে ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব সর্বত্র। টান পড়েছে রিজার্ভে। রিজার্ভ রক্ষায় জ্বালানি আমদানিতে লাগাম টানা হয়েছে। এ জন্য বেড়েছে লোডশেডিং। তীব্র লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। শিল্পে অনেকটা ত্রাহি অবস্থা। এমন অবস্থার মধ্যে নতুন করে আগামীকাল আসছে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা। অন্তত ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে মূল্য। এই মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে পরে বাড়বে গ্রাহক পর্যায়ের দাম। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর এর প্রভাবে আরেক দফা চাপে পড়বে জনজীবন, এমন আশঙ্কাই করা হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের উপর গণশুনানিকালে বিইআরসি’র টেকনিক্যাল কমিটি পাইকারি বিদ্যুতে ২ দশমিক ৯৯ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। অর্থাৎ প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে কমিটি। বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি হলেও খুচরা কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা এমন সময় আসতে যাচ্ছে, যখন সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তার প্রভাব পড়বে ব্যয়ের অন্য খাতগুলোতেও। ফলে আরও এক দফা বাড়তি ব্যয়ের চাপে পড়বে মানুষ। সূত্র ধারণা দিয়ে বলেন, ১৫ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে। এর আগে ১৮ই মে বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্যহার বৃদ্ধি নিয়ে বিইআরসি’র সর্বশেষ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিন মাসের বেশি সময় পেরোলেও এ-সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি।
যদিও আইন অনুযায়ী গণশুনানি সম্পন্নের ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে মূল্যসংক্রান্ত বিষয়ে ঘোষণা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইনি এ বাধ্যবাধকতার কারণে বিদ্যুতের মূল্য পর্যালোচনায় সংস্থাটির হাতে আর সময় নেই। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ১৮ই মে গণশুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের সময়সীমা শেষ হবে আগামী ১৪ই অক্টোবর। এ সময়ের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া পেলে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হবে। বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে বিইআরসি সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এটি নিয়ে আমরা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামীকাল ১৩ই অক্টোবর বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্যহার পরিবর্তনের ঘোষণা হবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বর্তমান দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ৯.১৪ টাকা এবং ১২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে ৯.২৭ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি ২ দশমিক ৯৯ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। অর্থাৎ প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা নির্ধারণ করে বিইআরসি। বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। বিপিডিবি’র পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চাহিদা মতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে বিপিডিবি’র। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে মূলত বিইআরসি’র কাছে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয় বিপিডিবি।
আমদানিকৃত স্পট এলএনজি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। গত জুন থেকে দেশে স্পট এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। যদিও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজি’র দাম গত দেড় মাসে যথাক্রমে ২৫ ও ৩৫ ডলার পর্যন্ত কমেছে। সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের দামই এখন নিম্নমুখী। অন্যদিকে, করোনা মহামারির মন্দা অর্থনীতির মধ্যে আবারো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়লে সব কিছুতে এর প্রভাব পড়বে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও নাভিশ্বাস হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে জ্বালানি ও গ্যাসের দাম বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষ যখন তীব্র মূল্যস্ফীতির সঙ্গে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে, ঠিক তখনই জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়িয়ে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে বাজারে নিত্যপণ্যের দামও হু হু করে বেড়ে গেছে। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন থমকে গিয়েছিল, একইভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসাও বন্ধ হয়েছে। ফলে আয় কমে এসেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম দাম আবার বাড়ানো হয় তাহলে সাধারণ মানুষের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর বিষয়ে শুনানিতে ভোক্তা সংগঠনগুলো বলছিল, এই মূহূর্তে দাম বাড়ানো হলে তা জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কোনোভাবে দাম বাড়ানো যৌক্তিক হবে না। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর শুনানিতে অংশ নিয়ে গ্রাহকরা দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেন। শুনানিতে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি দিতে চায় কিনা। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের বিদ্যমান ভর্তুকি রয়েছে, সরকার তা অব্যাহত রাখতে চায় কিনা, তা জানা দরকার। এদিকে, গত ৫ই আগস্ট গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, বিদ্যুতের প্রাইসের অ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যাপারে আমরা অপেক্ষায় আছি। গ্যাসের ব্যাপারে আমরা আরেকটা অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে চাচ্ছি। কিছুদিন আগে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা যে দামটা বাড়িয়েছি সেটা গত বছরের ডিসেম্বরের পরিস্থিতি বিবেচনায়। সে কারণে আমি মনে করি গ্যাসে আমাদের আরেকটা অ্যাডজাস্টমেন্ট হওয়া উচিত।
গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, শিল্পে ত্রাহি অবস্থা
করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও সবশেষ জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের অর্থনীতির শীর্ষ খাত পোশাক শিল্পসহ সারা দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। উৎপাদন চরম মাত্রায় ব্যাহত হচ্ছে। খাত সংশ্লিষ্টদের হিসাবে, প্রতিদিন প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। বিশেষ করে শিল্পকারখানা সমৃদ্ধ এলাকা চট্টগ্রাম, খুলনা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট ও সাভারের কারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এতে প্রায় প্রতিদিন পাঁচশ’ থেকে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পাশাপাশি ক্ষতির মুখে রয়েছেন দেশের মার্কেট, বিপণিবিতানসহ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাস আর বিদ্যুতের সমস্যার কারণে কারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুতের মাধ্যমে যে খরচ হয় জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রাখা হলে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যায়। এতে ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। তারা জানান, জ্বালানি সংকটের কারণে সৃষ্ট অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ছে যা দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি করছে। সংকট এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যখন রপ্তানি আদেশ কমছে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ও সামগ্রিক অর্থনীতিকে স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে কারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। উৎপাদন খরচ নিয়ে পোশাক খাতের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, প্রতিদিন তিন ঘণ্টা লোডশেডিং নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এতে এক মাসে তাদের স্বাভাবিক খরচের চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭২ লাখ টাকা। যা মূল ব্যয়ের অতিরিক্ত। গ্রুপটির এক শীর্ষ কর্মকর্তার মতে, গ্যাস ও বিদ্যুতের তীব্র সংকট আমাদের মারাত্মক সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সহজ উপায় দেখতে পাচ্ছি না। শুধু তিনি একা নন। চলমান জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল মিলের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
আরেক উদ্যোক্তা জানান, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সুতা প্রস্তুতকারক একটি টেক্সটাইল মিলসের প্রতিদিন ১২০ টন উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও গ্যাস সংকট ও লোডশেডিংয়ের কারণে কোম্পানিটির দৈনিক উৎপাদন এখন মাত্র ৫০-৫৫ টনে নেমে এসেছে। জ্বালানি সংকটের কারণে সৃষ্ট অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ছে, যা দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি করছে। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন, সংকট এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যখন কমছে রপ্তানি আদেশ, নেতিবাচক রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধি। গ্যাসের ঘাটতি প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদন লাইন অলস পড়ে থাকে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমানে পোশাক খাতের ক্ষতির হিসাব করা খুবই সহজ। গত সেপ্টেম্বর মাসে শুধু নিটওয়্যার-এ রপ্তানি কমেছে ৯ শতাংশ। আর সামগ্রিকভাবে পোশাক খাতে রপ্তানি কমেছে ৭.২ শতাংশ। যেখানে আগের মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ শতাংশ। অর্থাৎ গত মাসে রপ্তানি আয় নেমে এসেছে প্রায় ৩৫ শতাংশের নিচে। অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুতের তীব্র সংকটের কারণে প্রায় প্রতিদিন ৪০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে শুধু পোশাক খাতে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই হিসাবে মাসে প্রায় ১৫০০০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমাদের ক্রেতারা অর্ডারগুলো কমিয়ে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যুৎ সংকট আমাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। জেনারেটর চালানোর জন্য আমি প্রতি মাসে ৫০ লাখ টাকার ডিজেল ব্যবহার করছি। অন্যদিকে আমরা ক্রেতাদের চাপে আছি। আমার কারখানায় প্রতিদিন অন্তত চার ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের শিকার হচ্ছি। প্রতিদিন ১৫০ লিটার ডিজেল ব্যবহার করে উৎপাদন চালানো কঠিন। ব্যয় কমাতে লোডশেডিংয়ের সময় উৎপাদন বন্ধ রাখছি। বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বিদ্যুতের সমস্যার কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। জেনারেটর দিয়ে কাজ চললে পণ্যের মান খারাপ হয়ে যায়। উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় অব্যাহত থাকলে বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়বে পোশাক খাত। সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক খাতে সার্বিক খরচ বেড়েছিল ৫ শতাংশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এর সঙ্গে আরও ১/২ শতাংশ যুক্ত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাবে অর্থনীতিতে একদিনে সেবা খাতের অবদান ৫ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা, শিল্প খাতের (বড়, মাঝারি ও ছোট) ২ হাজার ৪০১ কোটি টাকা এবং পাইকারি ও খচরা ব্যবসার অবদান ১ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতের অবদান ১১০ কোটি টাকা এবং গ্যাসের ২২ কোটি টাকা। সেই হিসেবে লোডশেডিং হলে সব ধরনের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাতে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাব্য অঙ্ক ১ হাজার কোটি টাকার মতো হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে তখন বিশ্বব্যাপী গ্যাস এবং অপরিশোধিত তেল সরবরাহ ব্যাহত হয়। আর এতে দামও বেড়ে যায়।
এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আবার এই সংকট মোকাবিলায় সরকার এলএনজি আমদানি কমিয়ে ১৯শে জুলাই থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহে রেশনিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে অনেক গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ডিজেলচালিত প্ল্যান্টগুলো রেশনিং সিস্টেমের অধীনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি
দেশে গত আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে পণ্য এবং সেবার দর বৃদ্ধির হার (মূল্যস্ফীতি) ৯ শতাংশের ঘর ছাড়িয়েছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, আর সেপ্টেম্বরে তা ৯ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে বিবিএস’র প্রতিবেদনের তথ্য জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগস্টে মূল্যস্ফীতির এই হার ১১ বছর ৩ মাস বা গত ১৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির রেকর্ড ছিল। পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে নীতিমালাগত সহায়তার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার তদারকি এবং পণ্য চলাচল বাধাহীন করা হচ্ছে। তবে এখন গুদামে অভিযানের বাইরে নীতিমালা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
ফলে মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। একইসঙ্গে শ্রমিকদের মজুরি হারও বেড়েছে বলে দাবি করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। এম এ মান্নান বলেন, আগস্টে মজুরি হার ছিল ৬ দশমিক ৮০, সেপ্টেম্বরে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশে। এ সময় কৃষি, শিল্প ও সেবা সব ক্ষেত্রেই মজুরি হার বেড়েছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম জানান, বিশ্বে অন্যান্য বড় বড় অর্থনীতির দেশও মূল্যস্ফীতির শিকার। যেমন আমেরিকার মতো দেশেও ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালে ১৩ শতাংশ হতে পারে বলেও আগাম ধারণা দেয়া হয়েছে ওই দেশে। গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। শামসুল আলম আরও জানান, শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।