ঢাকা, ২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

কারিগরি শিক্ষা

৭৮% আসন ফাঁকা, তারপরও ১০০ নতুন প্রতিষ্ঠান

পিয়াস সরকার
৬ অক্টোবর ২০২২, বৃহস্পতিবার

কারিগরি শিক্ষায় জোর দেয়ার কথা বলা হলেও পরিস্থিতি ঠিক যেন উল্টো দিকে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭৮ শতাংশ আসনই থাকছে খালি। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানে এসব আসন  খালি থাকলেও নতুন করে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ১০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি ৫৬৪টি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে আসন রয়েছে ৩ লাখ ৬৭ হাজার। চলতি বছরে এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন মাত্র ৮১ হাজার শিক্ষার্থী। এই হিসাবে কারিগরিতে মাত্র ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের চাহিদা থাকলেও একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে বেসরকারিগুলো থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়ন আগে জরুরি। এখানে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া দরকার।

বিজ্ঞাপন
প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগার স্থাপন দরকার। এগুলো করা হলে দেশ বেশি উপকৃত হবে। পাশাপাশি নতুন প্রতিষ্ঠান হতে পারে। তবে মান উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।  ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের সিভিল বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান বলেন, আমরা দেশসেরা পলিটেকনিক্যালে পড়ছি এরপরও মেলে না পর্যাপ্ত ব্যবহারিকের সুযোগ। যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে আসেন। আমাদেরকে তাদের সহযোগী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে হয়। আমাদেরকে কর্মক্ষেত্রে শুরুতেই পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী হিসেবে পিছিয়ে যেতে হয়। 

তিনি বলেন, একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে গতবছর চাকরির জন্য যাই। আমার অভিজ্ঞতা ছিল আড়াই বছরের। আবার আমার প্রতিযোগী হিসেবে ছিল সদ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হওয়া প্রার্থীরা। ভাইভাতে সব ধরনের প্রশ্নের জবাব দিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও আমার চাকরি হলো না। বর্তমানে সরকারি পলিটেকনিক আছে ৪৯টি। যাতে আসন সংখ্যা ৪৩ হাজার ৪শ’। চলতি বছরে ভর্তি হয়েছেন ৪১ হাজার শিক্ষার্থী। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ঢের কম। দেশের রেজিস্টার্ড ৫১৫টি বেসরকারি কারিগরিতে আসন তিন লাখ ২৫ হাজার। বিপরীতে ভর্তি হয়েছেন মাত্র ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থী টানতে সরকারিতে এসএসসিতে ন্যূনতম স্কোর রাখা হয় ২.৫। আর বেসরকারিতে জিপিএ- ২। বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা করুণ। রাজশাহী আইডিয়াল পলিটেকনিক্যালের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা টেক্সটাইলের মতো সহজলভ্য বিষয়ের প্র্যাকটিক্যালও করতে পারি না। আমাদের মুখস্থ করতে হয়। আমাদের নামমাত্র একটা ল্যাব আছে। যেখানে টেক্সটাইলে সাধারণ যে শ্রমিকের কাজ এই ধরনের প্রাথমিক কাজগুলোও শিখতে পারছি না। বর্তমান সময়ে চাহিদা থাকায় কারিগরিতে যোগ করা হয় ট্যুরিজম অ্যান্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট বিষয়টি। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও কাজের সুযোগ মেলে এই বিষয়ে অধ্যয়নের মাধ্যমে। বগুড়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মোত্তাসিম ফাইয়াজ বলেন, আমাদের শুধুমাত্র বিষয়টাই খোলা হলো।

 প্রতিষ্ঠান সিলেবাস ঠিক করতে করতেই চলে যায় এক বছর। আমরা প্রথম তিন বছরে পাইনি এই বিষয়ের কোনো শিক্ষক। অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষকরা বই দেখে যতোটুকু পেরেছেন শুধুমাত্র আমাদের পার করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এরপর আমরা যখন চাকরি বাজারে যাই আমাদের বাস্তবধর্মী কোন জ্ঞানই ছিল না। আমাদের চাকরি অফার করা হয় সাধারণ এইচএসসি পাস ক্যাটাগরিতে। আপনি বলেন, এই সেক্টরে অধ্যয়নের পরও আমরা কোন সুবিধাই পেলাম না। একটা সাজানো গোছানো টেবিলও পাইনি। শুধু তাই নয়, আমরাওতো আসলে সার্টিফিকেটটাই নিয়ে এসেছিলাম। ব্যবহারিক ধারণাতো আমাদের শূন্যের কোঠায়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, সরকারি কারিগরিতে শিক্ষার্থীরা এখন ভর্তি হচ্ছেন শুধুমাত্র বিনামূল্যে ভর্তি হতে পাচ্ছেন এজন্য। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আর কোনো কাজেই আসবে না এসব প্রতিষ্ঠান। তবে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর সুখ্যাতি আছে বেশ। দিনাজপুর টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের ব্যবহারিক ক্লাসের সুবিধা আছে। তবে এটা পর্যাপ্ত না। আর সেইসঙ্গে আধুনিকায়ন প্রয়োজন। আবার বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস’র সাবেক শিক্ষার্থী আলেয়া আমেরিনও বলেন, আমরা একটি নির্দিষ্ট সেক্টরের শিক্ষার্থী। কিন্তু আমরা চাকরির বাজারে এগিয়ে থাকার কথা কিন্তু তা হচ্ছে না। 

আমাদের থেকে অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি এগিয়ে থাকছেন। এর একটাই কারণ আমাদের শুধু সার্টিফিকেটে বিশেষত্ব আছে। আমরা বাস্তবতা সম্পন্ন কোনো জ্ঞানার্জন করতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের দলাকৃত পদার্থকে সিরামিক বলা হয়। এগুলোকে উচ্চ তাপে সিন্টারিং করা হয়। এগুলো আমাদের প্রাথমিক জ্ঞান। এগুলো ঢালাই লৌহ, কার্বন স্টিল, হার্ড স্টিল মেশিনিং করতে কাটিং টুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমরা ব্যবহারিক ক্লাসেও করেছি। কিন্তু বাস্তবে চাকরি ক্ষেত্রে যে মেশিনারিজ ব্যবহার করা হয় সেগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক ধারণাটুকুও থাকে না।  কারিগরিতে নানা প্রতিবন্ধকাতার পাশাপাশি আছে ভয়াবহ শিক্ষক সংকট। ২০৫০ সালে কারিগরি শিক্ষাকে মূল ধারায় আনতে চায় সরকার। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। গতি ধীর হলেও পরিবর্তন আসছে কোর্স-কারিকুলামে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোতেও রয়েছে ভয়াবহ শিক্ষক সংকট।

 আছে ল্যাব সংকট। বর্তমানে ট্রেড ও শর্ট কোর্স মিলিয়ে অধ্যয়নরত আছেন প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী। ডিপ্লোমা কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী রয়েছেন ৩৬টি বিষয়ে। এর বাইরে বিদেশমুখী জনশক্তি, ব্যবসা, চাকরিতে মানোন্নয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে তিন মাস, ছয় মাস ও এক বছর মেয়াদি কোর্স চালু রয়েছে। সেইসঙ্গে দেশের প্রায় দুই হাজার স্কুলে নবম-দশম শ্রেণি এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ভোকেশনাল শিক্ষা চালু আছে। উচ্চ মাধ্যমিকে আছে এইচএসসি বিএম (ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা)। সবমিলে এসব কোর্স ও ট্রেডে কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয় সারা দেশে প্রায় নয় হাজার প্রতিষ্ঠানে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য নেই শক্ত ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। অনেক প্রতিষ্ঠান কোনো প্রকার ব্যবহারিক ক্লাসের ব্যবস্থা না রেখেই চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নামে, খ্যাতিতে অনন্য ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট। রাজধানীর বুকে এই ইন্সটিটিউটে ভর্তির জন্য প্রতিবছরই লড়াইয়ে নাম লেখান হাজার হাজার শিক্ষার্থী। বর্তমানে এতে অধ্যয়নরত আছেন প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী। 

যাতে শিক্ষক থাকার কথা ছিল ৩৯৪ জন। কিন্তু মাত্র ১০১ জন শিক্ষক দিয়েই চালানো হচ্ছে শিক্ষাকার্যক্রম। তাও দুই শিফটে। এদিকে সরকারের উচ্চ মহল থেকে বরাবরই কারিগরিতে প্রাধ্যান্য দেবার কথা বলা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় ২০ শতাংশ, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে মোট শিক্ষার্থীর ৫০ শতাংশ আনার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত এবিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লক্ষণীয় কোনো উদ্যোগ নেই। মানোন্নয়ন, ব্যবহারিক সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষক সংকট, মানসম্মত সিলেবাস-কোর্স, কারিগরি শিক্ষা নিয়ে প্রচারণার উদ্যোগ নেয়া না হলেও নতুন ১০০ প্রতিষ্ঠান করতে যাচ্ছে সরকার। বলা হয়- দেশের ১০০টি উপজেলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সুবিধা সমপ্রসারণে অবকাঠামোও স্থাপন করা হবে। চলতি বছরের ১০ই মে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় সংশোধিত প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়। এই প্রকল্পের জন্য ৪৮৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়।  নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুলে আগের স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়নের অধিক প্রয়োজন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে এগুলো আধুনিকায়ন ও শিক্ষক সংকট প্রথমে দূর করা জরুরি। কারিগরি শিক্ষা একটা মানে আসার পরই নতুন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। আর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত হওয়াটাও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। 

কারণ প্রতিষ্ঠান নির্মাণে অসৎ আয় নতুন কোনো ঘটনা নয়। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী ও কারিগরি শিক্ষা পরিষদের সাবেক সদস্য রেজা আহমদ বলেন, কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি উদ্যোগের কথা বলা হয়েছিল। যাতে ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ইন্টারনেট অব থিংসসহ আধুনিক সব বিষয় যুক্ত করার কথা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর কোনো বাস্তবায়ন নেই। এগুলো যুক্ত করা অতীব জরুরি। আবার সেইসঙ্গে রোবোটিক্স মেইনটেনেন্স, কন্ট্রোল সিস্টেম মেইনটেনেন্স সাপোর্ট, ওয়েস্ট রি-সাইক্লিং,  সোলার এনার্জি ও রিনিউএবল এনার্জির এগুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। তিনি বলেন, নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি না করে যেগুলো প্রতিষ্ঠান আছে এগুলোই উন্নত করা উচিত। আমাদের যেসব প্রতিষ্ঠান আছে এগুলোতে যদি এই অর্থ ইনভেস্ট করা যায় আমি বলবো বিশ্বের কারিগরি প্রশিক্ষিত জনবল বিদেশে পাঠিয়ে তাদের কাজে লাগানো যাবে।   বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামো উন্নত করার বিষয়ে জোর দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি বলেন, আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত বিদ্যমান শিক্ষাকে মানোন্নয়ন করা। তবে আমি জানি না কিসের ভিত্তিতে এই প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হচ্ছে। নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত। তবে আমি বলবো আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজালে কাঠামোগুলো জোরদার করলে গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরটা এগিয়ে যাবে। আগে পূর্বের প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন করা জরুরি। এতে আমরা যোগ্য লোক দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো এবং বাইরে থেকেও বিনিয়োগ আনা সম্ভব হবে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status