শেষের পাতা
জলবায়ু পরিবর্তনে শহরমুখী মানুষ মুদ্রাস্ফীতির ফাঁদে
মানবজমিন ডেস্ক
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, বুধবার
কাজ কমেছে ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষের। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে তাদের ছবি: রয়টার্স
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শহরমুখী মানুষ ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির ফাঁদে পড়ছেন। তাদের কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং জীবনধারণের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মধ্যে উদ্বেগ, শঙ্কা বাড়ছে। অনেকেই বলেছেন, এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়িঘর ছেড়ে শহরে আসা মানুষদের নিয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। মোবাশ্বের হোসেন এবং মো. তাহমিদ জামির লেখা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টে দেশে জ্বালানির মূল্য এবং অন্যান্য খাতে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে অর্থনীতি হয়েছে ধীরগতির। দরিদ্রদের কাঁধে চেপেছে ডাবল বোঝা। প্রথমত উচ্চমূল্য। দ্বিতীয়ত কমেছে আয়। এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে যমুনা নদী বাড়িঘর, কৃষিজমি ভাসিয়ে নেয়ার পর দু’বছর আগে ঢাকা এসেছেন আবুল কাশেম। তিনি কাজ নেন মেন্তির। লোকজনের কেনা পণ্য বহন করে পৌঁছে দেন গন্তব্যে। তাতে যে আয় হয় তাতে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ এবং বাসা ভাড়া দিতে পারতেন। কিন্তু আগস্টে সরকার জ্বালানির মূল্য শতকরা ৫০ ভাগ বাড়িয়ে দেয়ার পর মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতি ধীরগতির হওয়ার কারণে তার জন্য এখন এসবের যোগান দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে খুব ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোর এ অবস্থা। এর মধ্যে আছেন ওইসব মানুষ, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রাম থেকে অভিবাসী হয়ে রাজধানীমুখী হয়েছেন। আবুল কাশেম বলেন, এখন তার সার্ভিস নেয়ার সক্ষমতা রাখেন খুবই কম মানুষ। যারা তার মতো মানুষের সার্ভিস নেন, তারা পাওনা পরিশোধ করেন কম। এর অর্থ দিনে তার আয় আগের চেয়ে অর্ধেকের কম হচ্ছে। একই সঙ্গে তার বাসা ভাড়া এবং জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে তিনি দিনে আয় করতেন এক হাজার থেকে এক হাজার দুই শত টাকা পর্যন্ত। সেই আয় কমে অর্ধেকে আসার ফলে তার পরিবারকে খাবার কমাতে হয়েছে। গত মাসে তিনি বাধ্য হয়ে কর্মস্থল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নতুন বাসস্থানে সরে গিয়েছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, এত ক্ষতির পর আমি আর বেঁচে থাকতে পারবো না।
জীবনধারণের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সবচেয়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলো বড় রকমের মূল্য দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপর্যয়ে বাড়িঘর ও জমিজমা হারানোর পর যেসব মানুষ বেঁচে থাকার জন্য এরই মধ্যে সংগ্রাম করছেন- তারা রয়েছেন এর মধ্যে। ইউক্রেন যুদ্ধের ফল হিসেবে বিশ্বজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বৃদ্ধির মুখে বাংলাদেশ সরকার নাটকীয়ভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে। এরপর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির শতকরা হার প্রায় ৭.৫ ভাগ।
অপ্রত্যাশিত এই মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে উৎপাদন ধীরগতির হয়েছে। এতে খাদ্যপণ্য এবং অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট রিজওয়ান রহমান বলেছেন, এসব পরিস্থিতি শিল্প এবং প্রবৃদ্ধিকে বিকল করে দিয়েছে।
শ্রমিকরা বিশেষ করে এর প্রভাব অনুভব করছেন। ঢাকার পশ্চিমে হেমায়েতপুরে একটি গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করেন ৫০ বছর বয়সী আরজিনা বেগম। একটি স্যাঁতসেঁতে ছোট্ট একরুমের ভাড়া বাসায় বসবাস করেন তিনি। বলেছেন, নিজেকে এবং তার ছেলের জন্য মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন, মূল্য যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই বেতনে বাস্তবেই বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই আয় বাড়াতে আমার ১৫ বছর বয়সী ছেলেকে একটি ওয়ার্কশপে যোগ দিতে হয়েছে।
গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স রাইটস মুভমেন্টের নেত্রী তাসলিমা আখতার বিউটি বলেন, পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য এখন মাসে শ্রমিকদের বেতন বাড়িয়ে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা করা উচিত। এটা যে করা হবে- এমন কোনো ইঙ্গিত এখনো দেখা মিলছে না। আরজিনার বাসার কাছেই বসবাস করেন হযরত আলি নামে আরেকজন কর্মী। তিনি মাসে আয় করেন ৯ হাজার টাকা। বলেছেন, এর ফলে তার পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমেই উদ্বেগ বাড়ছে। হযরত আলি বলেন, যদি মূল্য এভাবে বাড়তেই থাকে তবে মজুরি দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে। চাল, ডাল এবং তেলের মতো খাদ্যপণ্যের নিয়মিত রেশন প্রয়োজন আমাদের।
রয়টার্স আরও লিখেছে, বর্ধিত মূল্যের ধাক্কা সাধারণ মানুষ কীভাবে ভোগ করছে সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এই বোঝা লাঘব করার জন্য সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভর্তুকি মূল্যে জনগণের কাছে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য তাৎক্ষণিকভাবে বিক্রি করছে সরকার। কিন্তু যাদের প্রয়োজন তাদের সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না এই ভর্তুকি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বহু মানুষ এখন তাদের খরচ কমাচ্ছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিবাসীদের লড়াইয়ে সহায়তা এবং এ বছর বন্যায় আক্রান্ত অন্য পরিবারগুলোর জন্য সহায়তার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য সহায়তা থেকে নগদ অর্থ সহায়তা। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
কাজ নেই, বেতন কম: অর্থনীতির ধীরগতির কারণে কাজ খুঁজে পাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে যেকোনো একটা কাজ জোটানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় মিরপুর ব্রিজের নিচে প্রতিদিন সকাল ৬টায় জমায়েত হন নির্মাণ শ্রমিকদের বিভিন্ন গ্রুপ। তাদের সঙ্গে থাকে কাজের সরঞ্জাম। তারা নির্মাণ কাজের সুপারভাইজারদের সঙ্গে কাজ নিয়ে দরদাম করেন। সাধারণত সকাল ৮টার দিকে এই জমায়েত আর থাকতো না। কারণ এ সময়ের মধ্যে কাজের জন্য শ্রমিকরা ছুটে যান। কিন্তু কয়েক সপ্তাহে বহু শ্রমিক কোনো কাজ পান না। ফলে তাদেরকে খালি হাতেই বাসায় ফিরতে হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির ফলে আমদানিকৃত নির্মাণসামগ্রীর মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথা জানিয়ে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট শফিকুল হক তালুকদার বলেন, এসব কারণে নির্মাণ বিষয়ক প্রকল্পগুলো ধীরগতির হয়েছে। ফলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন শ্রমিকরাও।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়ার পর খুলনা থেকে ঢাকা এসেছেন রহিম মিয়া (৫০)। বলেছেন, ভাগ্য পক্ষে ছিল না। তাই কাজের সন্ধানে আটদিন ঘুরতে হয়েছে। এ বিষয়টি অস্বাভাবিক। তিনি বলেন, এক মাস আগেও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ আমাদেরকে দিনে এক হাজার দুই শত টাকা দিতো। কিন্তু এখন চিত্র বদলে গেছে। এখন অনেকে দিনে ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত দিতে চায়, যা হতাশাজনক। মিরপুর ব্রিজের নিচে অপেক্ষায় ছিলেন আরেকজন শ্রমিক ময়না বেগম। বলেছেন, তিনিও পাঁচদিন ধরে কোনো কাজ পান না। খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্টোদিকে আমাদের মজুরি কমেছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রফেসর সেলিম রায়হান বলেছেন, এই পরিবর্তন এমনিতেই খুব ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোর জন্য উল্লেখযোগ্য এক নতুন হুমকি। দরিদ্র মানুষগুলো এমনিতেই বিপদের মুখে। এখন বিপুল পরিমাণ নতুন করে চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। নতুন এই চাপে পরিবারগুলোকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে খরচ কমাতে বাধ্য করছে। যেমন তাদের প্রকৃত আয় কমছে, তেমনি সরকারের উচিত নিয়োগকারীদের সঙ্গে এসব শ্রমিক যাতে মৌলিক রেশন পায় তা নিশ্চিত করতে কাজ করা।
প্রতিবাদ: মূল্যবৃদ্ধি এবং ক্রমশ সামর্থ্যের অযোগ্য মূল্যের কারণে বাংলাদেশের অনেক স্থানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃত চা খাতে, ২০২১ সালে সরকার প্রতিদিন একজন চা শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি বেঁধে দেয় ১২০ টাকা। এর ফলে দেশে সবচেয়ে কম বেতনের যেসব শ্রমিক আছেন, তেমনি তারা বসবাস করছেন। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন জ্বালানি ও খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পায় তখন প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার চা শ্রমিক অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন। তারা দাবি তোলেন প্রতিদিনের মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করতে হবে। এক সাক্ষাৎকারে কোনোমতে কান্না থামিয়ে শ্রমিক প্রকাশ বড়ুয়া বলেন- যথাযথ চিকিৎসাসেবা, আবাসন এবং শিক্ষা ছাড়াই মানবেতর অবস্থায় বেঁচে আছি।
প্রতিবাদের জবাবে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন চা শ্রমিকদের দিনে নতুন মজুরি হবে ১৭০ টাকা। দাবি করা অর্থের তুলনায় এই অর্থ প্রায় অর্ধেক। তবে এর ফলে ন্যূনতমভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে ধর্মঘট স্থগিত হয়েছে। চা শিল্পে কমপক্ষে ১৫০ বছর ধরে কাজ করছে এমন একটি পরিবারের স্থানীয় করণিক জনক লাল দেশওয়ারা। তিনি বলেন, বছরের শেষে আবার বেতন বৃদ্ধি হবে বলে আশা করছেন শ্রমিকরা। অন্য কর্মীদের উন্নতির আশা নেই বললেই চলে।
গৃহপরিচারিকার কাজ করেন শান্তি দাশ। বন্যা এবং লবণাক্ত পানি তাদের গ্রামের বাড়ি ও জমিজমা ধ্বংস করে দেয়ার ফলে ঢাকায় ছুটে এসেছেন। তিনি ঢাকার কল্যাণপুরে এক বস্তিতে ছোট্ট একটি রুমে স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন। খাদ্য এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি শুরুর পর তিনি দুটি বাড়িতে কাজ হারিয়েছেন। সেখানে তিনি পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তার স্বামী একজন মুচি। তারও কাজ কমে গেছে। আয় কমে যাওয়ার ফলে এরই মধ্যে তারা সন্তানদেরকে স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছেন। দিন শেষে বাজারে যে সবজি পড়ে থাকে শুধু তাই কেনেন। এখন আরও কম ভাড়ার ঘর খুঁজছেন তারা। শান্তি দাশ বলেন, মানুষ এখন বাড়ির কাজের লোকও বাদ দিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দেয়ায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
সামান্য ধনী ব্যক্তিরাও এই ধাক্কা অনুভব করছেন। রাজধানীর কড়াইল বস্তির এসএম মাহমুদুল হাসান। তিনি ওই বস্তিতে ১০টি রুমের মালিক এবং তা ভাড়া দেন। তিনি বলেছেন, চার জন ভাড়াটে বলে দিয়েছেন তারা আর সেখানে থাকতে পারছেন না। তাদের সামর্থ্যে কুলাচ্ছে না। ঢাকায় যাত্রীবাহী বাসের হেলপার হিসেবে কাজ করেন ৩২ বছর বয়সী শামসুল আলম। বলেছেন, কিছু যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করতে গিয়ে আগের চেয়ে বেশি কথাকাটাকাটি করতে হয়। একজন বয়সী যাত্রীকে তিনি বলেন, বাসভাড়া বাড়ানো তো আমার সিদ্ধান্তে হয়নি। আগের ভাড়ার কথা ভুলে যান।