শেষের পাতা
সিলেটে ছদ্মবেশী হিজড়া তুষার খুন নিয়ে কৌতূহল
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, সোমবারতুষার আহমদ। লিঙ্গ পুরুষ। কিন্তু সাজতেন হিজড়া। হিজড়াদের সঙ্গেই তার ওঠাবসা। প্রায় রাতেই ‘হিজড়া বন্ধুরা’ এসে তাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যায়। ফেরেন পরদিন সকালে। রাতে কোথায় থাকেন, কী করেন- কেউ জানে না। পরিবারের শত বারণ। এই বারণে কান দেননি তুষার। হিজড়া
বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতেন। সেই ছদ্মবেশী হিজড়া তুষারের লাশ মিলেছে গতকাল সকালে। সিলেট নগরীর সুবহানীঘাটের বনফুলের সিঁড়ির দ্বিতীয় তলায়। এই খুনের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশকে। অনেকদিন ধরেই অভিযোগ আসছে সিলেটের হিজড়াদের একটি অংশ পুরুষ। তারা হিজড়া সেজে নগরে চাঁদাবাজি করছে; কেউ কেউ অপরাধ কর্মকাণ্ডেও জড়িত। পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডটিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। লাশ উদ্ধারের পরপরই শুরু হয়েছে তদন্ত। তুষার আহমদের মূল বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরিপুরের শ্যামবাজার গ্রামে। অনেকদিন ধরে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন নগরীর খাসদবিরের তরঙ্গ-৩৮ আবাসিক এলাকায়। পুলিশ জানায়, গতকাল সকাল ৯টার দিকে খবর আসে সুবহানীঘাটের বনফুলের দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে একটি লাশ পড়ে আছে। খবর পেয়ে সুবহানীঘাট ফাঁড়ি পুলিশ গিয়ে ওই লাশ উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। পরে ছদ্মবেশী হিজড়া তুষারের মা হাসপাতালে গিয়ে ছেলের লাশ শনাক্ত করেন। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তুষারের বয়স প্রায় ২০ বছর। সে একজন পুরুষ। অথচ নারী বেশে সে হিজড়া সেজে চলাফেলা করতো। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বার বার বারণ করা হলেও সে মানেনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সে হিজরাদের সঙ্গেই নগরে চলাফেরা করতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই নারী সাজে থাকা শুরু করে তুষার। এরপর কিশোর হওয়ার পর নারী সাজার প্রবণতা তার আরও বেড়ে যায়। এ কারণে সে পড়ালেখাও বেশিদূর এগোয়নি। বয়স ১৫-১৬ হওয়ার পরপরই তার সঙ্গে হিজড়াদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওদের সঙ্গেই সে শুরু করে চলাফেরা। বাড়ি থেকে হিজড়ার সাজে ঘর ছাড়তো। ফিরেও আসতো হিজড়ার সাজে। এরপর বাসাতে সে সাধারণ ভাবেই চলাফেরা করতো। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে এ নিয়ে বারণ করা হয়। বার বার চাপও দেয়া হয়। উল্টো বাড়ি ছেলে চলে যাওয়ার হুমকি দিতো। এ কারণে পরিবারের সদস্যরা তাকে বেশি চাপ দিতেন না। গত দুই বছর ধরে প্রায় প্রতি রাতেই হিজড়া বন্ধুদের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো তুষার। ফিরতো পরদিন সকালে। এমনভাবে গত শনিবার রাতে তুষারের এক হিজড়া বন্ধু তার বাসার সামনে আসে। সে তুষারকে ডাক দেয়। তুষারও তার ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাতে সে বাসায় ফিরেনি। সকাল ১০টার দিকে পরিবারের সদস্যরা লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে হাসপাতালে যান। সেখানে মাসহ পরিবারের সদস্যরা লাশ শনাক্ত করেন। এদিকে নিহত তুষারের ভাই হিমেল আহমদ রাফি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘তার ছোটো ভাই তুষার হিজড়া নয়। ছোটবেলায় একসঙ্গে আমাদের খতনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু খাসদবির প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় সে অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে। কিশোর বয়স থেকে সে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করতে থাকে।’ তিনি জানান, ‘প্রায় প্রতি রাতই তুষার তার হিজড়া বন্ধুদের সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ফেরে পরদিন সকালে। এ ব্যাপারে তাকে বার বার নিষেধ করেও কথা মানানো যায়নি। শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকেও এভাবে তার এক হিজড়া বন্ধু তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তবে ওই হিজড়াকে আমি কখনো তার সঙ্গে দেখিনি। রাতে ওই হিজড়ার সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে আর ঘরে ফেরেনি তুষার। সকালেই জানতে পারি তার লাশ সোবহানীঘাটের ওই জায়গা থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।’ গতকাল বিকালে জানাজা শেষে তুষারের মরদেহ হযরত মানিকপীর (রহ.) কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তুষার আহমদকে হত্যা করা হয়েছে। তার গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে লাশ উদ্ধারের পরপরই তদন্ত শুরু করেছে। তারা ইতিমধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কোতোয়ালি থানার ওসি আলী মাহমুদ গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ‘সিলেটে অনেক পুরুষ হিজড়া সেজে রয়েছে; এমন অভিযোগ অনেক আগে থেকেই আমাদের কাছে ছিল। ছদ্মবেশী হিজড়া তুষারের লাশ উদ্ধারের পর আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। তদন্তও অনেকদূর এগিয়েছে। আশা করছি দ্রুতই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারবো।’ তিনি জানান, ‘তুষারের সঙ্গে কার কার যোগাযোগ রয়েছে সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে। একইসঙ্গে সিলেটে ছদ্মবেশী হিজড়া সেজে যারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।’