ঢাকা, ২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

আলোর চোখে কালো ঠুলি

শুভ কিবরিয়া
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, শুক্রবার
mzamin

উন্নয়ন বলতেই আমরা এখন বুঝি কিছু দালানকোঠা আর অবকাঠামো। সেই অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও আমাদের সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে বড় বড় দেয়াল আর বিভাজন রেখা। দেয়াল সর্বত্র। কেননা আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি অথবা আমাদের বোধে স্থায়ী হয়ে গেছে বিচ্ছিন্নতার মনস্তত্ত্ব। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দখল, দূষণ, আর দেখনদারি। আমরা যে আলাদা কেউ, বিচ্ছিন্ন হয়ে, দেয়াল তুলে নিজেদের গণ্ডি দেখিয়ে নিত্য তা প্রমাণ করছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি আমরা এক বৃহতের অংশ। খণ্ডিত হয়ে, বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা কেউ আলাদা করে বাঁচতে পারবো না- এই সত্যকে যেন সবাই হারিয়ে ফেলছি। পরিবেশকে দূষণ করে, খাল-বিল-মাঠ-জলাশয়-নদীকে দখল করে, যে দেশ আমরা গড়তে চাইছি সেটা আদতেই আমাদের মুখোশ হয়ে থাকবে, এটা মুখশ্রী হবে না- এই ভাবনাও আমরা ভুলতে বসেছি


অভিজ্ঞতা-১ 

বহু বছর পর দিনাজপুর শহরে গিয়েছিলাম। নিজের কাজটা সেরে শহরে আমার পরিচিত জায়গাগুলো দেখতে গেলাম।

বিজ্ঞাপন
আশির দশকে দিনাজপুর শহর ছেড়েছিলাম। দিনাজপুর শহরের পৌরসভা ভবন, দিনাজপুর জিলা স্কুল প্রাঙ্গণ আর গোরাশহীদ ময়দান ছিল আমার শৈশবের বিস্ময়। ঐতিহাসিক স্মৃতিধন্য দিনাজপুর পৌরসভা ভবনের রাজসিক অবয়ব সবসময় আমাকে আবেশিত ও বিস্মিত করে রাখতো। প্রায় পুরাকীর্তির আদলে থাকা এই ভবনের দিকে তাকালেই সেই শৈশবে মনে হতো একটা অনেক বড় কিছু আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বহু বছর পর এবার সেই ভবনটির দিকে তাকিয়ে, তার চারপাশ দেখে, তার মলিন দশা দেখে শৈশবের হৃদয়ে যেন মোচড় লাগলো। মনে হলো আমার শৈশবের স্বপ্নের ওপর কে যেন একটা বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছে। হতাশ এবং বিপন্ন বোধ করলাম দিনাজপুর জেলা স্কুলের কম্পাউন্ড দেখে। ওখানে যে জিলা স্কুল ছিল সেটা খুঁজে পেতেই আমার সময় লাগলো। চারপাশে দেয়াল আর দেয়াল। যে স্কুলে প্রায় ছয় বছর আমি শিক্ষার্থী ছিলাম, সেই স্কুলে চারপাশের খোলা পরিসর দেয়ালে ভরে উঠেছে। স্কুলের সামনে বড় গেটটায় নাম লেখা না থাকলে স্কুলটাকেই আর খুঁজে পেতাম কিনা সন্দেহ জাগলো। খুব ইচ্ছে ছিল স্কুলের ভেতরটা পুরোটা ঘুরে দেখবো। কিন্তু মন টানলো না। 

ভাবলাম যে স্মৃতি আছে তাতে আর রক্তক্ষরণ না ঘটাই। পুরনো ভালোলাগার স্মৃতিটাই বহাল থাকুক। ভগ্ন মন নিয়ে হাঁটতে লাগলাম দিনাজপুর শহরের সবচাইতে বড় সম্পদ গোরাশহীদ ময়দান যা বড় মাঠ নামে পরিচিত, সেটা দেখতে। এটাকে এই শহরের ফুসফুস বলা যায়। অন্তত আমাদের শৈশবে তাই ছিল। কিন্তু বড় মাঠের দশা দেখে তো আমার চোখ ছানাবড়া। নানারকম দেয়াল আর অবকাঠামো এখন এই ময়দানজুড়ে। মাঠটার বড় সুকৃতি ছিল যে বৃহৎ খোলা পরিসর, তাতেই যেন সবাই হামলে পড়েছে। নানারকম দেয়াল আর অবকাঠামো মাঠটার সেই বৃহৎ পরিসরকেই যেন খণ্ড-বিকৃত করেছে। এটা বলার অবকাশ নেই, সময়ের পরিবর্তনে, জনসংখ্যার আধিক্যে, নানারকম প্রয়োজন বেড়েছে- তাতে হয়তো এই মাঠটাতে অনেকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাতে কি একটা সমন্বিত আয়োজন, সুপরিকল্পনা আর সৌন্দর্যের ছোঁয়া থাকবে না? যেখানে সেখানে অবকাঠামো আর দেয়াল তুলে মাঠটার বারোটা না বাজালে কি চলতো না? একজন স্থপতি বা নন্দনবিদকে কাজে লাগিয়ে কি এই মাঠটা নিয়ে একটা সমন্বিত পরিকল্পনা করা যেত না? কি জানি?  

 

 

অভিজ্ঞতা-২ 

চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে কক্সবাজার ঘুরে এলাম সম্প্রতি। বহু বছর পর সড়ক পথে কক্সবাজার যাওয়ার ফলে উৎসুক চোখে চারপাশ দেখতে দেখতে গেলাম। আমার সহযাত্রী যিনি ছিলেন, তিনি চট্টগ্রামের মানুষ। কর্মপ্রয়োজনে এ এলাকায় তাকে বারবার আসতে হয়। ফলে এখানকার সবকিছুই তার নখদর্পণে। তার কাছ থেকে নানারকম খবরাখবর শুনতে শুনতে চলছি। খেয়াল করলাম চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক এখনো সেই মান্ধাতা আমলেই পড়ে রয়েছে। যেকোনো জেলা শহরের রাস্তা এর চাইতে উন্নততর। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার একটা সিঙ্গেল রোড। সড়কে ভ্যান থেকে শুরু করে দ্রুতগতির বাস সব ধরনের নিম্ন-উচ্চগতির যানবাহন একসঙ্গেই চলাচল করা। সড়কের যত্রতত্র বাজার-দোকানপাটের সমাগম। ফলে জায়গায় যানজট অবধারিত। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের সড়কপথে দূরত্ব মাত্র ১৫০ কিলোমিটার। এই সড়ক অতিক্রম করতেই ন্যূনতম সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগেই। অথচ কক্সবাজার আমাদের পর্যটন শহর। এই শহরে যাওয়ার সড়কপথ উন্নয়ন কাজটা হওয়া উচিত ছিল সবার আগে। এটাই হওয়া উচিত ছিল আমাদের উন্নয়নের বড় অগ্রাধিকার। এখানে রেলপথ থাকাটাও ছিল প্রয়োজনীয়।

 হালে সেই কাজে পালের হাওয়া লেগেছে যদিও। শুধু পর্যটন শহরই নয়, রোহিঙ্গাদের জায়গা দেয়ার কারণে কক্সবাজারের গুরুত্ব দারুণভাবে বেড়েছে। সেখানে দেশি-বিদেশি মানুষের যাত্রাও বেড়েছে বহুগুণে ও বহুভাবেই। অথচ সড়কপথ সেই পেছনেই পড়ে রয়েছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে ঢাকা-কক্সবাজার বিমানপথের পসার ঘটেছে। কক্সবাজার পৌঁছে স্মৃতিচোখে সমুদ্র সৈকত খুঁজতে যেয়ে ধাক্কাটা খেলাম বড়ভাবে। আমার দেখা কক্সবাজার সম্পূর্ণ বদলে গেছে। নানারকম দেয়াল, টাওয়ার, বিল্ডিং আর বহুতল ভবনের অপরিকল্পিত উন্নয়নের জোয়ারে ঢাকা পড়ে গেছে সমুদ্র সৈকত। বিদঘুটে সব অবকাঠামো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে প্রায় ঢেকেই ফেলেছে। এক পরিবেশকর্মী হতাশাভরা কণ্ঠে সবিস্তারের জানালেন উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব দিক থেকেই পরিবেশবিনাশি ও সৌন্দর্যহানিকর দখল-দূষণের চাপ এখন কীভাবে বহন করতে হচ্ছে কক্সবাজারবাসীকে। এর পরিণতি ও ভয়াবহতার কথাও তিনি বললেন উৎকণ্ঠাসহকারে। মহেশখালী-মাতারবাড়ি সরজমিন ঘুরে দেখলাম এই পরিবেশকর্মীর উৎকণ্ঠার মতো স্থানীয় অধিবাসীরাও বহুমাত্রিক শঙ্কার মধ্যেই আছে। এসবের আপাতত সমাধান কি আমি জানি না। কিন্তু আমার মনে হলো আমাদের উন্নয়ন মনস্তত্ত্বে ‘দেয়াল’ একটা বড় জায়গা নিয়ে ফেলেছে।  

রোগটা কোথায়?

 শুধু দিনাজপুর বা কক্সবাজার নয় রোগটা সারা দেশজুড়েই। উন্নয়ন বলতেই আমরা এখন বুঝি কিছু দালানকোঠা আর অবকাঠামো। সেই অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও আমাদের সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে বড় বড় দেয়াল আর বিভাজন রেখা। দেয়াল সর্বত্র। কেননা আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি অথবা আমাদের বোধে স্থায়ী হয়ে গেছে বিচ্ছিন্নতার মনস্তত্ত্ব। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দখল, দূষণ, আর দেখনদারি। আমরা যে আলাদা কেউ, বিচ্ছিন্ন হয়ে, দেয়াল তুলে নিজেদের গণ্ডি দেখিয়ে নিত্য তা প্রমাণ করছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি আমরা এক বৃহতের অংশ। খণ্ডিত হয়ে, বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা কেউ আলাদা করে বাঁচতে পারবো না- এই সত্যকে যেন সবাই হারিয়ে ফেলছি। পরিবেশকে দূষণ করে, খাল-বিল-মাঠ-জলাশয়-নদীকে দখল করে, যে দেশ আমরা গড়তে চাইছি সেটা আদতেই আমাদের মুখোশ হয়ে থাকবে, এটা মুখশ্রী হবে না- এই ভাবনাও আমরা ভুলতে বসেছি। এক ধরনের মিথ্যা অহংবোধ আর কর্তৃত্ববাদী চিন্তা আমাদের তাড়িত করছে। কর্তৃত্বপরায়ণতার স্বৈরতান্ত্রিক ভাবনায় ছোট-বড়, ব্যক্তি-সমাজ আমরা সবাই মশগুল। রাষ্ট্র নিজে এই ভাবনাকে উৎসাহিত করছে। ফলে তার সকল প্রতিষ্ঠানে এই ভাবনা, এই দর্শন বিকটভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, বিকাশ লাভ করছে। প্রতিষ্ঠান যারা চালাচ্ছেন নিজ নিজ সীমানায় তারা জনসেবক না হয়ে জনপ্রভু হওয়ার তালিম নিচ্ছেন। ফলে, চাইলেও সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগও কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না। তাই এখন দরকার, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের উন্নয়নচিন্তা, আমাদের রাষ্ট্রচিন্তায় একটা আমূল পরিবর্তন দরকার। ‘আমি’ না, ‘আমরা’- ‘খণ্ডিত’ না ‘সমগ্র’ এই দর্শনকে এখন তুলে ধরা দরকার সর্বত্রই। 

পুনশ্চ, এবং 

লেখাটি লিখে শেষ করেছি প্রায়। কিন্তু কিছুতেই শিরোনাম পছন্দের হচ্ছে না। অবশেষে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের একটা লাইন খুব মনে ধরলো। সেটাই চূড়ান্ত করলাম। কবিতার নামটা বলছি না। বলা মাত্রই সবাই চিনে যাবেন বলে! তবে, অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গেল, এই কবিতাটায় চোখ বুলানোর পর। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কিত একটা রচনার কথা মনে পড়ে গেল আচানক। ঘটনাটা আমাদের কীর্তিমান শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার ‘বিপুলা পৃথিবী’ নামের বইয়ে উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটির বহুমাত্রিকতা পাঠকদের সঙ্গে সেটা শেয়ার করতে উৎসাহিত করলো।  অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন:-  ‘১৯৮৯ সালের শেষদিকে একবার কলকাতায় গিয়েছিলাম। কাজ ছিল টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দেয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গোলাম মুস্তাফাও সেখানে আমন্ত্রিত বক্তা ছিল। এক ফাঁকে মুস্তাফাকে নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যাই। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘এবার ঢাকায় যাচ্ছি।’ উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলাম,‘তাই নাকি? কি উপলক্ষে?’ কবি বললেন, ‘এশীয় কবিতা উৎসবে।’ আমার উৎসাহে ভাটা পড়লো। বললাম,‘এ তো প্রেসিডেন্ট এরশাদের শো। আপনি যাবেন?’ সুভাষ বললেন, ‘কতোদিন ধরে তোমরা এরশাদকে সরাবে-সরাবে বলছো। কিছু তো করতে পারছো না! আমি আর কতোদিন ঢাকায় না গিয়ে থাকবো!’ তার কথার সত্যতা স্বীকার করতেই হয়। দ্বিতীয় এশীয় কবিতা-উৎসবে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন নভেম্বর মাসে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।’ 

 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status