ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাফ কথা

মরিয়মকে আর কতো কাঁদতে হবে?

কাজল ঘোষ
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, রবিবার
mzamin

পুলিশ ইচ্ছা করলেই সব পারে। এটা অনুমান নয়, বাস্তবতা। এমন বহু উদাহরণ দেশের পুলিশ বাহিনী রেখেছে। এমন অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা বলা যায়। নিদারাবাদ হত্যার অন্যতম আসামি তাজুলকেও রায়ের চার বছর পর কাকরাইল মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। কাজেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে মরিয়ম মান্নানের মাকে উদ্ধার অথবা এ ঘটনার নেপথ্যে যারা তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন কাজ নয়। আমাদের প্রত্যাশা মায়ের জন্য আর কোনো মরিয়মকে যেন কাঁদতে না হয়  


তখন খুব ছোট। বাসায় নিয়মিত পত্রিকা নিয়ে আসতেন বাবা। দু’ তিনটি কাগজ বগলদাবা করে দুপুরে ফিরতেন। যতদূর মনে পড়ে নিয়মিত ইত্তেফাক, বাংলার বাণী আর মাঝেমধ্যেই সংবাদ।

বিজ্ঞাপন
আমার কাজ ছিল বাবাকে পত্রিকার শিরোনাম পড়ে শোনানো। দ্বিতীয় দফায় বাবার পছন্দের বা আগ্রহের খবরগুলো বিস্তারিত পাঠ করা। এই করে করে কী করে যেন আমিও নানান খবরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলি। অনেক ঘটনার খবর পড়ার পর এর কী হলো তার ফলোআপ দেখার জন্যও চোখ রাখতাম। তেমনি একটি ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিদারাবাদ হত্যাকাণ্ড।  একটি হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি দখলের জন্য সকল সদস্যকে রাতের অন্ধকারে হত্যা করে তাজুল ইসলাম গং। এখনো এই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা মনে হলে গা শিউরে ওঠে। মানুষ কতোটা পাষণ্ড হলে সম্পত্তির জন্য এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালায়।  কি ঘটেছিল সেখানে? ১৯৮৭ সালের ১৬ই অক্টোবরের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে শশাঙ্ক  দেবনাথকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় একই গ্রামের পূর্ব পরিচিত তাজুল ইসলাম।

 সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে গুড় নিয়ে ফিরে আসার কথা বলে বাড়ি  থেকে বের হন মুড়ির মোয়া বিক্রেতা শশাঙ্ক দেবনাথ। এরপর দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে। আর ফিরে না শশাঙ্ক। তাজুল ইসলামসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী বিরজাবালা। মামলার রায়  ঘোষণার দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে। তাজুল আর তার সহযোগী বাদশাসহ সবার অপরাধই প্রমাণ হতে থাকে আদালতে। নিশ্চিত বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ হয় তাজুল। শশাঙ্কের পরিবারের সবাইকে খুনের পরিকল্পনা আঁটে। ১৯৮৯ সালের ৬ই  সেপ্টেম্বর রাত। ঘুমিয়ে নিদারাবাদ গ্রাম। শুধু জেগে আছে কসাই তাজুলের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত। গভীর রাতে ৩০  থেকে ৪০ জনের ওই দুর্বৃত্তের দল হামলা চালায় শশাঙ্কের পরিবারের ওপর। জানালার  লোহার রড ভেঙে ঘরে ঢুকে দুর্বৃত্তরা পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তারা অপহরণ করে নিয়ে যায় শশাঙ্কের স্ত্রী বিরজাবালা সহ ৫ সন্তানকে। বাঁচার জন্য তারা গগনবিদারী চিৎকার শুরু করেন। তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলেও সংঘবদ্ধ দলের সামনে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। গ্রামবাসীর সামনে দিয়েই অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। 

বড় একটি নৌকায় তুলে নেয় তাদের। নৌকার ওপরই তাদের ছয়জনকে কুপিয়ে হত্যার পর টুকরা টুকরা করে। পরে ড্রামে ভরে ফেলে  দেয় ধুপাজুরি বিলে। অপহরণ ঘটনার ১০ দিন পর ১৬ই  সেপ্টেম্বর অপহৃত ছয়জনের লাশ মেলে। এ ঘটনা সে সময় দেশজুড়ে আলোচনায় আসে। এ নিয়ে প্রতিদিনই খবরের কাগজে একাধিক শিরোনাম হতে থাকে। তাজুল গং-এর বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এক মুহূর্তও এই খবর থেকে দৃষ্টি এড়ায়নি। মর্মান্তিক এ ঘটনায় তাজুল গং-এর ৯ জনের ফাঁসি হয়েছিল।  একটি ঘটনায় এই ঘটনার ছবি বারবার চোখে ভেসে আসছে। গত তিন সপ্তাহ ধরে মরিয়ম মান্নান নামে একজন কলেজ শিক্ষার্থী তার মাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। মায়ের জন্য তার গগনবিদারী কান্নার ছবি ও ভিডিও সর্বত্র ঘুরছে। কি অসহায়! মা রহিমা বেগমকে ফিরে পেতে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে ঘুরছেন মরিয়ম ও তার পরিবার। গত বাইশ দিনেও পুলিশ বা তদন্ত সংস্থা এ ঘটনার কোনো সুরাহা করতে পারেনি।  মরিয়মের পরিবার র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি’র কাছে গিয়েছে। প্রথমে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে। মামলাও হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তারা তদন্ত করছে। র‌্যাব, ডিবি পুলিশ জানিয়েছে,  তারা তদন্ত করছে। শুরু থেকেই পুলিশ বলে আসছে মরিয়মের মা আত্মগোপনে আছেন। অন্যদিকে মরিয়মদের পরিবারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেশীরা দীর্ঘদিন থেকেই তাদের সম্পত্তির জন্য নানা অজুহাতে পিছে লেগেছে। আর সবশেষ তার মাকেই গায়েব করে দিয়েছে।

 

 

মরিয়মের চাওয়া একটাই- মা। কিন্তু তার মা  কোথায়? ঘটনার ২২ দিন পার হয়ে গেছে কিন্তু এখনো মরিয়মের মায়ের খোঁজ নেই। মানবজমিনকে মরিয়ম জানিয়েছেন, থানার ওসি প্রথম দিন থেকেই বলে আসছে তার মা আত্মগোপন করেছে। মরিয়মের প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে পুলিশ জানে আমার মা কোথায় আছে? যদি আত্মগোপনে থাকে তাহলে তাকে প্রকাশ্যে আনা হোক। এর জন্য প্রচলিত বিধি অনুযায়ী সাজা দেয়া হোক। কিন্তু এতদিন পরও মায়ের কোনো খোঁজ নেই। জীবিত না হোক আমার মায়ের লাশ হলেও চাই। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলায় উল্টো আমাকে এবং আমার ভাইবোনদের বিভিন্ন স্থান থেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে, যেন আমরা চুপ হয়ে যাই। ঘটনার পর থেকে যেখানেই যাচ্ছি মায়ের খোঁজে, সকলেই বলছে চেষ্টা করছে। সবাই কাজ করছে কিন্তু আমার মাকে তো এখনো পাচ্ছি না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ঘটনার আগে পরে থানা পুলিশের সঙ্গেই অবস্থান করেছে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ক’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে পর্যন্তই। কিন্তু আমার মায়ের হদিস নেই।  প্রসঙ্গ ক্রমে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।

 চার মাস আগে সিনিয়র সাংবাদিক আমির খসরুর মা নিজ বাড়িতেই খুন হন। কিন্তু এতদিন পরও এখনো পর্যন্ত এ ঘটনার কোনো সুরাহা হয়নি। একজন খ্যাতনামা সাংবাদিকের মায়ের জীবন গেল কিন্তু প্রশাসন বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোথাও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আমির খসরুর পরিবার পুরো পরিস্থিতিতে হতাশ। তিনি নিজে গ্রামের বাড়িতে দিনের পর দিন অবস্থান করে, তদন্ত সংস্থার কাছে  দৌড়ঝাঁপ করেছেন কিন্তু এখনো তার মাকে কেন জীবন দিতে হলো তার কোনো কূলকিনারা করতে পারেন নি। শুরু থেকে পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থা যা বলে এসেছেন এখনো সেই অবস্থানেই ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছে।  সাংবাদিক আমির খসরুর মায়ের মর্মান্তিক হত্যার পেছনে কারা? মরিয়ম মান্নানের মায়ের জন্য কান্না কি শুধুই তার একার? অথবা নিদারাবাদে শশাঙ্ক দেবনাথের পরিবারের সঙ্গে যা ঘটেছিল তা কি শুধুই সেখানে সীমাবদ্ধ। এ ধরনের ঘটনার বিচার না হওয়া বা বিচার প্রলম্বিত হওয়া সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রসার ঘটায়। সাম্প্রতিককালে গুম-খুন নিয়ে সর্বত্র আতঙ্ক। অনেকের পরিবার তাদের স্বজনকে পাচ্ছেন না। বছরের পর বছর পরিবারগুলো অপেক্ষায় আছে তাদের স্বজনদের জন্য।

তারা এখন আর জীবিত মানুষ চান না, আর কিছু না হোক একটি বারের জন্য তার স্বজনের লাশ দেখতে চান। কিছু কিছু ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির প্রশ্ন যুক্ত বা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ছুঁতোয় প্রশাসন টালবাহানা করে। কিন্তু যে সব ঘটনার সঙ্গে সম্পত্তি দখলের প্রশ্ন জড়িত সেসব ঘটনার সুরাহা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এত শৈথিল্য কেন? এক্ষেত্রে খুব স্বভাবতই প্রশ্ন আসে তাহলে এই ভূমিদস্যু দুর্বৃত্তদের সঙ্গে মহলবিশেষ যুক্ত। নইলে একটি ঘটনা ঘটার পর তার সুরাহা করতে এতটা কালক্ষেপণ প্রশ্নের জন্ম দিয়ে থাকে।  অতি সম্প্রতি একটি ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করে লেখাটির ইতি টানতে চাই। ঈশ্বরদী থেকে নারায়ণঞ্জগামী একটি নৈশকোচে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় যেভাবে পুলিশ তৎপর হয়ে দোষীদের গ্রেপ্তার এবং শাস্তির আওতায় এনেছে তাতে পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা প্রমাণিত। পুলিশ ইচ্ছা করলেই সব পারে। এটা অনুমান নয়, বাস্তবতা।

 এমন বহু উদাহরণ দেশের পুলিশ বাহিনী রেখেছে। এমন অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা বলা যায়। নিদারাবাদ হত্যার অন্যতম আসামি তাজুলকেও রায়ের চার বছর পর কাকরাইল মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। কাজেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে মরিয়ম মান্নানের মাকে উদ্ধার অথবা এ ঘটনার নেপথ্যে যারা তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন কাজ নয়। আমাদের প্রত্যাশা মায়ের জন্য আর কোনো মরিয়মকে যেন কাঁদতে না হয়।    

নোট: মরিয়মের পরিবার মায়ের এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে ইতিমধ্যে মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তরের জন্য কোর্টের কাছে আবেদন করেছে।  

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status